বর্বরতার শিকার রাজনঃ দায় আমাদের সবার

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 13 July 2015, 04:08 AM
Updated : 13 July 2015, 04:08 AM

এই সময় এই দেশে এক অন্ধকার অমানিশা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পথে পিছিয়ে পড়ছি আমরা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু
পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু।।
এই-যে হিয়া থরোথরো কাঁপে আজি এমনতরো
এই বেদনা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু।।

ঈষৎ আলো ফোটা ভোর অথবা সন্ধ্যা! তবে সময়টা হয়ত পূর্ণালোকিত দিন নয়। অন্ধকার ছাড়া বর্বর অমানুষের বর্বরতা জমবে কেন? এমন অসময়ে সিলেটের শহরতলীর কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডে একটি খুঁটির সাথে পিছমোড়া করে বাঁধা কিশোর সামিউল ইসলাম রাজন। অসদয় দুর্বৃত্তের নির্মম মারধরে রাজনের চোখে বাঁধভাঙা জল। ভাঙ্গা কন্ঠস্বরে 'মাইগো' বলে চিৎকারে কষ্ট ভুলবার আহাজারী।
প্রহারে প্রহারে ক্লান্ত। শরীর ক্ষতবিক্ষত।

'মাইগো, আমি মরি যাইয়ার, আমারে কেউ বাঁচাও রে বা!'
হাত জোড় করে রাজন বলছে, সে চোর না।

কিন্তু রক্ত পিপাসু হায়েনা শামীম, ইউসু্‌ফ, মুহিত ও আলীরা তা শুনবে কেন। একদিকে রাজনকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে মারতে অসভ্যদের আদিম বন্য উল্লাস, অন্যদিকে হাত বাঁধা রাজনের করজোড় বাঁচার আকুতি। কিশোরটি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে হতে সামান্য পানি খেতে চায়।

মানুষরূপী শ্বাপদ হায়েনারা তাকে বলে,
'পানি নাই, ঘাম খা'।

মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া অবধি রাজনকে মারতে থাকে তারা। আর প্রচণ্ড উল্লাসে সেই বর্বর ঘটনার ভিডিও করে সোশাল মিডিয়ায় আপলোড করে।
যিনি ওই ভিডিও ধারণ করছিলেন, তাকে নির্দেশ করে একটি কণ্ঠ জানতে চায়, ঠিকমতো ভিডিও হচ্ছে কি না।
ওপাশ থেকে উত্তর আসে, 'ফেইসবুকে ছাড়ি দিছি, অখন সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব'।
মারধরের সময় রাজনের আর্তচিৎকার এবং নির্যাতনকারীদের অট্টহাসি ও নানা কটূক্তি শোনা যায়। রাজনের নখ, মাথা ও পেটে রোল দিয়ে আঘাত করার পাশাপাশি বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মোচড়াতেও দেখা যায়।

ফেসবুকের নিউজফিডে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর নৃসংস দানবীয় সেই হত্যা দৃশ্য। এই নির্মম হত্যা দৃশ্যের ভিডিওটি ছুড়ে ফেলে দিয়েছে মানুষের মানবীয় বোধকে, ন্যূনতম সভ্যতাকে, সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষের বিবেককে। এই অমানবীয় দৃশ্য যে দেখা যায় না, হৃদয়ে সওয়াও যায় না।

এই দেশটাতো এখনও আইএস'র আবুবকর বোগদাদীর আইয়ামে জাহেলিয়াত রাজ্য হয়ে যায়নি। এখন না মুসলমানদের সবচে' পবিত্র মাস রমজান চলছে। কঠোর ধ্যান, ইবাদত বা সাধনার মাধ্যমে মহান আল্লাহকে পাওয়ার মাসে এ কেমন অধর্ম। হন্তারকদের কেউতো বৈধার্মিক বা ইহুদী নয়। হন্তারকদের সবাই যে সাচ্চা মুসলমানের বাচ্চা। সারাদেশে আজ ঘরে ঘরে কওমী মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। স্কুল, কলেজ বা বিদ্যায়তনেরও অভাব নাই। শাহজালালীয় সুফিবাদের পূণ্যভূমি সিলেটে ঐতিহাসিকভাবেই ধর্মীয় শিক্ষালয়ের সংখ্যা দেশের অপরাপর জেলার চেয়ে বেশি।
তবে সেসব শিক্ষায়তনে আসলে কি শিখছে সিলেটি যুবারা। কেমন হচ্ছে তাদের মনস্তাত্ত্বিক গঠন। কোথায় যাচ্ছে সিলেটি তরুণ প্রজন্ম?

তবে কি মৌলবাদ, গোড়ামী, কূপমুন্ডকতা আর কুসংস্কারেই হারিয়ে যাচ্ছে সেখানকার তরুণ প্রজন্ম? এসব তরুণদের মধ্যে কেন মানবিক বোধ জাগ্রত হচ্ছে না। কওমী বা আলিয়া মাদ্রাসা বা অপরাপর ক্ষুদ্র শিক্ষায়তনে বিশ্ব সাহিত্য পড়ানো হয় না। এখানকার শিক্ষার্থীরা জানেই না হোমার, সফোক্লিস, শেক্সপীয়র, বাইরন, তলস্তয়, কাহলিল জিবরান বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে? জানে না মহাত্মা গান্ধী, আইনস্টাইন, মাদার তেরেসা বা নেলসন ম্যন্ডেলার খবর। কে তাদের আদর্শ হবেন সেটাই তারা জানবার সুযোগটুকুও পাচ্ছেন না। ডিজিটাল বাংলাদেশে এদের একমাত্র বিনোদন এখন সস্তার ফোনে ইন্টারনেট মিডিয়া। সেখানকার কদর্যতা বা নোংরামি তাদের যতটা ভালো লাগে, জ্ঞান বা মুক্ত বোধবুদ্ধির খবরে তাদের ততোটাই অনীহা। এসব তরুণরা কেউ থিয়েটার বুঝে না বা সঙ্গীত চর্চা করে না। এমনকি খেলাধুলোতেও তাদের অনীহা। তারা শিখছে কীভাবে নারীর অপমান করা যায়, কিভাবে ভিন্নমতের মানুষদের লাগামহীন কুৎসিত গালাগালে ভরিয়ে দেওয়া যায়। রাষ্ট্রের দায়িত্ববানেরা কেউ প্রয়োজন বোধ করছেন না, এসব বিপথগামী যুবাদের আলোর পথে আনতে। তাদের আদর্শ হচ্ছেন গ্রামের কলা পাতার ছাউনি দেয়া মাদ্রাসায় পাঠগ্রহণ করে দু'পাতা আলেফ বা তা সা মুখস্ত করা ফটকাবাজ মৌলভীরা। যে মৌলভীরা ওয়াজ নসিহতে মমতাময়ী সকল মাতৃশ্রেণিকে বেশ্যা বলে গালাগাল করে। টেলিভিশনে, সিনেমায় যারা আসেন তারা সকলেই নাকি বেশ্যা। এমনকি বিয়ে বাড়িতে কনে সেজে বসে থাকারাও নাকি বেশ্যা। তাদের ভাষায় এই পৃথিবীটাই বেশ্যার বাজার। এবং ঘুরে ফিরে যে এসব মৌলভী তাদের কথায় নিজেরাও কোনো এক পূণ্যবতী বেশ্যার সন্তানে পর্যবশিত হয়ে যান, তা অনুধাবন করবার বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতাও থাকছে এদের। এ জাতীয় হেজাবি মৌলভীরা বেহেস্তের হুরদের নিয়ে প্রকাশ্যে পর্ণটাইপ বর্ণনা করে যুবাদের মাথায় এক ধরণের বিবমিষার ঘুণপোকা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সেসব কথাবার্তা এসব যুবাদের ফেসবুকের নিউজফিডে ফিডে ঘুরে বেড়ায় মিনিটে মিনিটে। এভাবেই মস্তিষ্কের বিকৃতি নিয়ে বেড়ে উঠা সেইসব তরুণের কাছে আপনি তবে কী আশা করবেন?

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আপনি আমি শিশু নারী বৃদ্ধ দুর্বল চিত্ত সবল চিত্ত নির্বিশেষে এসব দেখে যতোই বেদনায় কুকড়ে যান, ঘৃণাবোধে হিম হন, আপনাকে ডিজিটাল বাংলাদেশের সংবাদ বা সোশাল মিডিয়া এসব দেখাবেই। এবং দেখতে দেখতে একসময় ভুলে যাবেন। অভ্যস্থ হয়ে সয়েও যাবেন। রোবটেও পরিণত হবেন। প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলবেন। নির্বিকারের বিকারগ্রস্ততা পেয়ে বসবে আপনাকে। রাজনদের কাছে ক্ষমা চাইবার ভাষাটিও আপনার অথর্ব মুখে আর ফুটবে না!

দেশটা অমানুষ, বর্বর, অসভ্য, নরপিশাচ ও নষ্টদের অধিকারে চলে যাওয়ার আগে কেউ কি রাশ টেনে ধরতে আসবেন? রাষ্ট্র, সমাজ বা প্রশাসনের নির্লিপ্ততাকে ধিক্কার জানাবেন সাহস করে? বিচার দাবি করবেন। দায় যে, আমাদের সবার!

হা ঈশ্বর!
রাজনদের ওপর এমন নির্মম বর্বরতা, এমন অসভ্যতা, ভয়ঙ্কর বীভৎসতা যে আর নেয়া যায় না। তুমি কোথায়?

ওয়েটিং ফর গডো..!!!

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
১২ জুলাই ২০১৫
https://www.facebook.com/fardeen.ferdous
https://twitter.com/fardeenferdous