বঙ্গবন্ধুঃ তোমায় খুঁজি বাংলাদেশের প্রাণে

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 15 August 2015, 05:00 AM
Updated : 15 August 2015, 05:00 AM

বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই ভাবতেন। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই বঙ্গবন্ধুকে গভীরভাবে ভাবাতো। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা তাঁর রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তুলত। অস্তিত্বের এই অর্থবহতাকে সার্থক করে তুলতে তিনি নিজের জীবনের আরাম আয়েশ সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ভুলে গিয়ে বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য এক আদর্শবাদী ও আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। নিজের প্রজ্ঞা, মেধা, শ্রম, ত্যাগ, দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা দিয়ে বাংলার মানুষের এই মুক্তির মহানায়ক, অবিসংবাদিত নেতা বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন মহান স্বাধীনতা। একটি সার্বভৌম দেশ! তবে স্বাধীন দেশে এই জনপদকে গুছিয়ে তুলবার কালে আজকের এই দিনে নিজ পরিবার, পুত্র স্বজনসহযোগে ঘাতকের চরম নির্মমতার সাক্ষী হতে হয় তাঁকে। আজ শোকের দিনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর স্বজন সতীর্থদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত ও মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র ও সুযোগের সমতাসহ এ জাতীয় নানা নীতিতে সহমত হয়ে এদেশের মানুষ এক ও অভিন্ন আত্মায় রূপ নিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতা এই পরগণার হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিস্টান, আদিবাসী, বৈধার্মিক নির্বিশেষে সবার সমান মর্যাদা ও সমঅধিকারের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ এনে দিয়েছিল স্বাধীনতার বীর সন্তানেরা। আর স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব ও ঐক্যের প্রতীক এবং প্রবাদ পুরুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। রাজনীতির এমন মহান কবিকে নিয়ে আরেক প্রথিতযশা কবি অন্নদাশঙ্কর রায় যথার্থ লিখেছিলেন,

যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরি মেঘনা বহমান,
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান
দিকে দিকে আজ রক্তগঙ্গা
অশ্রুগঙ্গা বহমান
তবু নাহি ভয় হবে হবে জয়
জয় মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালী অবাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। বদনামকে এড়িয়ে গিয়ে মানুষের ভালোবাসায় আপ্লুত হতে চাইতেন তিনি। তাই তো ভাষণে, কথায় বা বৈঠকে বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয় শিষ্যদের সর্বদা আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম আর আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আদর্শ রাজনীতির শিক্ষাটাই দিতে চাইতেন। তাঁর লক্ষ্যই ছিল ন্যায়নিষ্ঠা ও আদর্শবাদিতা প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এ তাঁর মহাপ্রয়াণের মধ্য দিয়ে সুবিধাবাদী কলঙ্ক কারিগর ও নীলনকশাকার মিলিটারি জায়ান্ট জিয়া বা এরশাদদের কুক্ষিগত ও জবরদস্তিমূলক ক্ষমতা খায়েশ জাগে। দখলবাজ সেইসব শাসকের মন ও মগজে বঙ্গবন্ধুর আদর্শবাদিতা ছুড়ে ফেলে লোক দেখানো ধর্মাচারী বা মৌলবাদী হয়ে উঠবার মধ্য দিয়ে পশ্চাৎদেশে হাঁটতে হাঁটতে দেশটাকে মধ্যযুগে নিয়ে যাবার প্রাণান্ত প্রচেষ্টাই ছিল। এদের আনুকূল্যে গোঁড়া ধর্মান্ধ, কূপমুন্ডক, সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী, আলবদর, আলশামস, মানবতাবিরোধীরা চলে আসে শাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে। বিপরীতভাবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর চেতনারও নির্বাসন ঘটে। আর সেই ধারা এখনও চলমানই আছে।

হায় বঙ্গবন্ধু!
আপনি যে হানাদারের শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তি চেয়ে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা জোর কদমে পেছনেই হেঁটে চলেছে।
আপনার গড়া দলের নেতা, পাতি নেতা, অধিকাংশ সরকারী আমলা, ডাক্তার, আইনজীবী, শিক্ষক, পুলিশ, ব্যাংকার, ব্যবসায়ীর মধ্যে খাই খাই স্বভাব এখন আলোকিত সত্য। এদের কারও মধ্যে নেই আপনার আদর্শের তিন মটোঃ আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম বা আত্মশুদ্ধি। সবার ধান্ধা এখন- কেবল নিজের জন্যই তারা পৃথিবীতে এসেছেন। বঞ্চিতজন কারো দিকে নজর দেওয়ার সময় তাদের নেই। সমাজ রাষ্ট্র থেকে চক্ষু লজ্জা মরে গেছে আপনি চলে যাওয়ার সাথে সাথে।

হতে পারে আপনার সংগঠিত দল বা আপনারই আত্মজা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। কিন্তু সেই সেক্যুলার মানবতাবাদী আওয়ামীলীগে আজ উড়ে এসে জুড়ে বসা হাইব্রিড থিংক ট্যাংকারদের জয়জয়কার। তাদের কারণেই পুনরায় মুসলিমলীগের ধর্মধ্বজাধারী রূপেই পরিগণিত হচ্ছে। আপনার কন্যাকেও কপট ধর্মাচারীদের রক্তচক্ষু সামলে নিয়ে নিরন্তর হাঁটতে হচ্ছে চিকন রশির ওপর দিয়ে। যেখানে সকল জাতি গোষ্ঠীর সমান অধিকার থাকবার কথা। সেখানে দেশটা হয়ে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক মুসলিম ধর্মনগরী। একাত্তরে নিজেদের জীবনের বিনিময়ে দেশটা তাঁদের উত্তর প্রজন্মের জন্য নিরাপদ করে যেতে চেয়েছিলেন যেসব শহীদ পিতা, হেরে গেছেন তাঁরা মোল্লার বিষাক্ত ফণায়। এসব হায়েনার হুমকির মুখে নির্বিকার এই রাষ্ট্র থেকে শহীদের কন্যা পুত্রদেরও আজ দেশান্তরী হতে হচ্ছে। এ যে বড় ট্রাজেডি পিতা!

হায় পিতা!
আজ এক চরম সত্যের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা মুক্তচিন্তার মানুষেরা।
আপনার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো করে এই দেশে এখন কেউ আর বলতে পারবে না-
ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া
খোদার আসন 'আরশ' ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!

এখানে সুফিয়া কামাল বা শহীদ জননী জাহানারা ঈমামের মতো মুক্তমনা আর কেউ জন্মাবে না। আপনি যে দেশের, যে জাতির, যে পতাকার, যে মানচিত্রের স্থপতি সেই দেশে জ্ঞানের কথা, চিন্তার কথা বললেই বিনষ্ট অনুভূতির উগ্রবাদীদের চাপাতির নীচে কল্লাপাত। রক্তখুনে লালে লাল। দেশের জন্য প্রাণ দেয়া মানুষের সন্তান জাফর ইকবাল এখন বিনাভোটি সাংসদের চোখে নাস্তিক। আর সেই নাস্তিকের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে জঘন্য ব্লাসফেমি আইন চাচ্ছে আওয়ামীলীগের ভূঁইফোড় সংগঠন মৌলবাদী ওলামালীগ। অথচ ধর্ম হেফাজতের নামে যেই মোল্লা নিরীহ মাদ্রাসা ছাত্রদের আরক্ষা বাহিনীর বন্দুকের নলে এনে ফেলে, যেই মোল্লা নারী বিদ্বেষী ১৩ দফা দেয়, যেই মোল্লা ভিন্নমতের মানুষদের কল্লা ফেলে দিতে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়, সেই মোল্লা শান শওকতে হেলিকপ্টারে ঘুরে বেড়ায়। সেই মোল্লা রাষ্ট্রের কোটি টাকার জমিতে নিজের নামে মাদ্রাসা বানায়। সেই মোল্লাকে পুলিশ প্রধান, সিটি মেয়র বা জাতীয় দূতেরা তোয়াজ করে চলে। এখানে মুক্তমনাদেরকে ১৪ বছরের সাজার ভয় দেখানো হয়, কিন্তু মুক্তচিন্তকের খুনিদের সাজার ব্যাপারে কারও মুখে টু শব্দটি ফুটে না। এ এক আজব ব্যাপার পিতা!

অথচ আপনিই সাংবিধানিভাবে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করে গিয়েছিলেন। প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার দিয়েছিলেন।

আমরা জানি পিতা, এই দুঃসহ দমবন্ধ অবস্থা আপনিও সইতে পারতেন না।
কিন্তু আপনার আদর্শের অনুসারী প্রাকৃতজনেরা এসবই নীরবে সয়ে যাচ্ছে।

এখন এই রাষ্ট্রে ছাত্রলীগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন করে ধর্মীয়ভাবে আপনাকে তারা জাতির পিতা মানবেন কিনা? অথচ আপনিই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার বা সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা সাংবিধানিকভাবেই রহিত করে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণ, বিভাজন, শ্রেণিবৈষম্য বা কোণঠাসা করে রাখবার সুযোগে হাজারে বিজারে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী জামায়াতিরা যখন আপনার দলে ঢুকে যায়, দায়িত্ববানের আস্কারা পায়, তখন এই ছিল ভবিতব্যই! সে আপনার সীমান্ত জয়ী, সমুদ্র জয়ী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সাজাদানকারী কন্যা প্রধানমন্ত্রী যতোই বলুন, এটা জঙ্গি রাষ্ট্র নয়, ধর্ম নিয়ে এখানে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। কিন্তু তাঁকেই আপনার আদর্শকে ছুটি দিয়ে এরশাদের মতো বকধার্মিক, পতিত স্বৈরাচার, বিশ্ববেহায়া এরশাদকে সাথে নিয়ে চলতে হয়।

আপনার আদর্শহীনতা কতোটা তুঙ্গ স্পর্শ করলে ভোটারবিহীন নির্বাচনে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে সরকার সংগঠন করতে হয়, আপনি তা নিশ্চয় অনুধাবন করবেন পিতা। কেবলমাত্র মুসলমান ধর্মভিত্তিক এমন একটা গুরুচণ্ডালি রাষ্ট্রে আপনার বদান্যতায় সংসার ফিরে পেয়ে পরবর্তীতে তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পাঁচটি জন্মদিন থেকে বেছে নিয়ে ১৫ আগস্টের মর্মন্তুদ শোক দিবসেই সাড়ম্বরে জন্মদিন পালন করতে হয়। কারণ আপনার মৃত্যুই ঐ নেত্রীকে নবজন্ম দিয়েছিল হয়ত। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই পিতা। আপনাকেই একযোগে সকলেই পিতা মানবেন, শঙ্কর বাঙালির কাছে এ আশা করবেন না পিতা।

আপনার আদর্শহীনতায় একালে আমাদের এই সমাজে এক শ্রেণির গালাগাল প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। তারা একে অপরকে প্রকাশ্যে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষবাক্য বর্ষন করে ঘৃণ্য আনন্দ কুড়ায়। এরা ভাষা ও শব্দের আকড় আপনার সেই ৭ মার্চের ভাষণ পড়েও দেখে না। নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার পরও পাকি ঘাতক হানাদারেরা আপনার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে এক মানব্বিধ্বংসী অনিবার্য যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার কালে কী অসম্ভব সুস্থিরই না ছিলেন আপনি! সেই অনিশ্চিত সময়ে কোনো অশালীন বা অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ না করেও শোষকের বিরুদ্ধে জীবনের সবচে কঠিন ও দুর্বার প্রতিবাদের কথাগুলো বলে ছিলেন এক রাজনৈতিক মহাকাব্যিক দ্যোতনায়। আপনার আদর্শচ্যুত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষাবিজ্ঞান শিখব সেই যোগ্যতা আমাদের কোথায়? আপনার আদর্শ বিনাশের প্রায়শ্চিত্ত মন্ত্র কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেনঃ

হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!
মানুষের অধিকারে
বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

তাই আজ এই ঘণায়মান অন্ধকার দিনে, দমবন্ধ দুর্বিষহ সময়ে,
ভয় শূণ্য চিত্ত, উচ্চ শির ও মুক্ত জ্ঞান নিয়ে তোমার ভরাট কন্ঠ নিজের কন্ঠকল্পনায় এঁকে নিয়ে বলি,
পিতা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনার সামনে হাজির হয়েছি। আপনি সবই জানেন এবং বোঝেন।
আমরা মুক্তমনা ও স্বাধীনচেতারা আপনার আদর্শ ধারণ করে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অন্ধকার দূর করবার শেষ আলোটাও ক্রমশ নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছে।

তাই আপনাকে আজ এই শোকের দিনে বারেবারে লালসবুজ পতাকায়, মানচিত্রে, আপনার সাধের প্রান্তিক মানুষের প্রাণে প্রাণে খুঁজে ফিরছি।
আপনি আরেকবার, পুনর্বার এসে ডাক দিয়ে যান,
বাংলার মানুষকে জাগিয়ে দিয়ে যানঃ

তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
জয় বাংলা।

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
১৫ আগস্ট ২০১৫
https://www.facebook.com/fardeen.ferdous
https://twitter.com/fardeenferdous