মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দিওনা অতিভক্তির তস্করেরা

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 7 Sept 2015, 02:42 AM
Updated : 7 Sept 2015, 02:42 AM

কথায় বলে অতিভক্তি চোরের লক্ষণ।
আর বাঙালি রাজনীতির কষ্টিপাথরে প্রমাণিত, অতি মুজিবভক্তি মোশতাকের লক্ষণ।
এই সময় আমরা সেই শ্বাপদ হায়েনারূপি মোশতাকদের আনাগোনা প্রবলভাবে দেখতে পাচ্ছি।
আজকাল দেশে তেঁতুল হুজুরের চেয়েও মাত্রাছাড়া লালাসক্ত, হেফাজত জামায়াতেরও অধিক সাম্প্রদায়িক ও মানবতাবিরোধী একটি প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছে।
যেই প্রজাতির বিষ দংশন থেকে বাদ যাচ্ছে না কেউই।
ওরা জাতের বিচার করতে ভুলে গিয়ে বিজাতের নাগপাশে দেশকে আবদ্ধ করে দিতে চাইছে।
মানুষকে নিয়ে যেতে চাইছে মধ্যযুগের অন্ধকারে।
আর সেই উগ্রবাদী জঙ্গি গোষ্ঠিটির নাম ওলামা লীগ।
এই গোষ্ঠীর আমিরের নামটি হলো মাওলানা মুহাম্মদ আখতার হুসাইন বুখারী। এই মৌলভীটি বুখারী শরীফের হাদীস জানুন আর নাই জানুন, নামটি তার বুখারী।
সেই বুখারী গোষ্ঠীর লোক দেখানো চাটুকারিতার মাত্রা এতোটা বেড়ে গেছে যে, অতিভক্তির চূড়ায় উঠে নিজেদের চোরামিটা এতোটাই প্রকাশ করবার প্রয়াসী হয়েছে যে,
আমাদের জাতির পিতার চিরচেনা ও চিরায়ত নাম 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান' বদলে দেয়ার দাবি জানাচ্ছে।
এই মৌলবাদী গোষ্ঠীটি বঙ্গবন্ধুর নামের আগে শহীদ আর নামের শেষে রহমাতুল্লাহি আলাইহি সাটিয়ে দিয়ে কেবলমাত্র একজন গোঁড়া সাম্প্রদায়িক মুজিব বানিয়ে গণমানুষের নেতা পরিচয়কে মুছে দেবার দুঃসাহসী হয়েছে।

তা বাপু বুখারী, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু কবে কোথায় বলেছিলেন, তিনি কেবল মুসলমানের নেতা? কবে কোথায় বলেছিলেন, ইসলাম ধর্ম বিকৃতকারী আবুল আলা মওদূদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি'র এই সরেস নামটি বঙ্গবন্ধুর খুব পছন্দ?
যেহেতু এই মৌলভীর আস্ফালনের কোনো প্রতিবাদ মুজিববাদী ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দেখা যায়নি, তাহলে কি অন্নদাশঙ্কর রায়ের শ্রেষ্ঠ মুজিবীয় কবিতা 'বঙ্গবন্ধু'র পয়ারও এবার পরিবর্তন করা হবে?
যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরি মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
আচ্ছা এই কবিতার শেষ লাইনটিতে কথিত ঐ বুখারী মৌলভীর দাবিটি মিলিয়ে পড়ুনতো কেমন শোনায়!

পূর্ণ হেফাজতদুষ্ট এই মৌলভীরা, খ্যাতিমান অধ্যাপক ও কিশোর সাহিত্যিক ড. জাফর ইকবালকে ইসলামবিদ্বেষী উল্লেখ করে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে বহিষ্কারের দাবি করেছে।
বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাহীন একজন সামান্য মৌলভীর কতটা স্পর্ধা হলে এমন দাবি করতে পারে।
আর কতোটা নির্বিকার ও নির্লিপ্ত হলে মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার এমন অনধিকার দাবির ব্যাপারে নিমীলিত চোখে মুখ বুজে থাকতে পারে?

সৌদি আরব বা পাকিস্তানী ভাবাদর্শের অনুগামী এবং ওয়াহাবী ও মওদূদীপন্থী এই স্বঘোষিত মাওলানার দলটি বুক টান করে বলে বেড়াচ্ছে, 'বর্তমানে পাঠ্যপুস্তকে কট্টর ইসলামবিরোধী হিন্দু ও নাস্তিক লেখকদের লেখারই বেশি প্রাধান্য। ইসলামকে কটাক্ষ করে লেখালেখি করে এদেশের জাতীয় পর্যায়ে যেসব চিহ্নিত ইসলামবিদ্বেষী লেখক নাস্তিক হুমায়ূন আজাদ, তাসলিমা নাসরিন, সেলিনা হোসেনসহ আরো অনেক নাস্তিকদের লেখাকে বর্তমানে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে'।
সেলিনা হোসেন বা ড. হুমায়ূন আজাদের মতো প্রতিথযশা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লেখকের বিরুদ্ধে এমন অভব্য ভাষায় কথা বলবার যোগ্যতা কোথায় পেলেন হে মৌলভী?

এই আদবকায়দাহীন মাওলানা ইসলাম বিদ্বেষী ও তাঁদের বিরুদ্ধে চরিত্র হরণের অভিযোগ এনে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো পত্রিকা বন্ধের দাবি জানিয়েছে।
সরকার দাবি করছে, তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করছে। বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। তুমি কার খালু যে, সংবাদপত্র বন্ধ করার অনৈতিক দাবি তুলো?
হায় ওলামা লীগ তোমার কি আদৌ কোনো চরিত্র আছে যে, চরিত্র হননের প্রশ্ন উঠবে?

এই বদ্ধ উন্মাদ গোষ্ঠীটি গৌতম ঘোষ পরিচালিত 'মনের মানুষ' চলচ্চিত্রের নায়িকা অভিনেত্রী পাওলি দামকে পতিতা উল্লেখ করে তাঁকে বাংলাদেশে না আসতে দেয়ার দাবি তুলেছে। আরে মাওলানা তুমি শিল্পের বুঝটা কি যে, একজিন শিল্পী সম্পর্কে অশালীন ও অন্যায্য মন্তব্য কর?
সব নারীকেই যদি তোমার পতিতা মনে হয়, তবে মায়ের গর্ভে না জন্ম নিয়ে তোমাদের মতো জঙ্গিবাদিতায় মত্ত কোনো কাপুরুষের পেটকেই আঁতুড়ঘর বানানোর দরকার ছিল!

মাননীয় সরকার বাহাদুর, আমরা আম জনতা আমাদেরও অনুভূতি আছে? অনুভূতি কেবল বেয়াইদের, আস্তিকদের, নাস্তিকদের বা হেজাবিদের থাকতে নেই! এইসব কূপমুণ্ডক মৌলভীরা সীমালঙ্ঘন করলে আমাদের অনুভূতিতেও আঘাত লাগে।
ওহে পুলিশ বাবু, ১৪ বছেরের জেল বা ৫৭ ধারা ওলামা লীগের ওপর প্রযুক্ত করে দেখান দেখি, আপনারা কিরকম পারেন?

হায় ভোগবিলাসী আরবীয়াদের দাসানুদাস মাওলানারা আপনাদের জেনে রাখা ভালো-
আজকের দিনে ধনতন্ত্রের দাস, সাম্রাজ্যবাদী ইজরাইল ও আমেরিকার গোলাম স্বার্থপর সৌদি আরবের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই আইন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ান এতিম শিশু বা অন্য রাষ্ট্রের মা বাপ হারা শিশুদের দত্তক নেয়া নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইরাক সিরিয়ার কোনো শিশুকে সহায়তা পর্যন্ত না করার ঘোষণা দিয়েছে সৌদি আরব।
অথচ ১৪০০ বছর আগে একজন এতিম মহামানব মক্কাবাসী তথা বিশ্বকে মানবমুক্তির সনদ এনে দিয়েছিলেন। সেই মহানবী(সা) ঘোষণা দিয়েছিলেন, মুসলিমদের ঐ বাড়ীই সর্বোত্তম যে বাড়ীতে এতিম রয়েছে এবং তার সাথে ভালো ব্যবহার করা হয়। এতিম প্রতিপালন ও তাদের প্রতি সদয় হওয়ায় অত্যাধিক সওয়াব হাসিল হয়।

অথচ আয়নাল কুর্দি ট্রাজেডির পর বিশ্ব মোড়লদের সুহৃদ ইউরোপের ইহুদি খ্রিস্টানরা যখন ইসলামিক স্টেটের তাণ্ডবে বাস্তুচ্যুত মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়ার কাজে ব্যস্ত, তখনও ভোগ বিলাসে মত্ত মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি, কাতার বা আরব আমিরাতের মুসলিম নেতারা। জঙ্গি ও স্বার্থপর রাষ্ট্রীয় দখলদারদের আত্ম বিধ্বংসী যুদ্ধে যখন হাজার হাজার মানুষ দুর্গম সমুদ্র পথে শান্তির অন্বেষণে অভিবাসী, সেইসময় সৌদি বাদশা সালমানরা থাকেন মার্কিন মুল্লুকে আরেক মুসলিম ভাই ইরানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে। এই অবিবেচক আরবীয়া শাসকরাই একাত্তরে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তানী হত্যাযজ্ঞকে নিরঙ্কুশ সমর্থন জানিয়ে গেছে।

আমাদের মহানবীর আদর্শের ধর্ম, ন্যায়নিষ্ঠার ধর্ম, ত্যাগের ধর্ম, শান্তির ধর্ম পরিহার করে বর্তমান সৌদি বা পাকিস্তানী ভাবধারার হেফাজতি জামায়াতি স্বার্থগন্ধী ধর্মাচারে মত্ত হয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে, শান্তির বিরুদ্ধে, সহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে, সম্প্রীতির বিরুদ্ধে, ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, জ্ঞানচর্চার বিরুদ্ধে বিকৃত উগ্রবাদী গোষ্ঠী ওলামা লীগের এমন বাড়াবাড়ির তীব্র নিন্দা জানাই।
সেইসাথে দীপ্ত শপথে দাবি তুলি,
মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দিওনা অতিভক্তির তস্করেরা!

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫
https://www.facebook.com/fardeen.ferdous
https://twitter.com/fardeenferdous