জয় বাংলা, ভ্যাট সামলা…!
দেহ পাবি, মন পাবি, কিন্তু ভ্যাট পাবি না…!
এইসব শ্লোগানেরা আন্দোলনের বারোটা বাজাবার সমূহ দাবি রাখে।
প্রথমটিতে মুক্তিযুদ্ধের শাশ্বত শ্লোগানকে বিকৃত করে ব্যবহার করবার প্রয়াসী হয়েছেন, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ধনীর দুলাল শিক্ষার্থীরা। এ থেকে অনুধাবন করাই যাচ্ছে, বাণিজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এইসব ধনতান্ত্রিকদের মধ্যে মনোবিকারিক এক ভবিষ্যতই বেড়ে উঠছে। যাদের মধ্যে স্বাজাত্যবোধ বলে কিছু জন্মই নিচ্ছে না হয়ত।
……
দ্বিতীয়টিতে আমাদের বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় চটুল ডায়ালগকে আশ্রয় করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিদ্যানগরের সভ্যতার সাথে এই শ্লোগান সামঞ্জস্যপূর্ণ কী করে হতে পারে?
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিক শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ বা দেশাত্মবোধ কতটা জাগ্রত করতে পারছে, তা এখান থেকেই মিলিয়ে নেয়া যেতে পারে! আন্দোলনের মূল চেতনা বা স্পিরিটের সাথে এমন জনপ্রিয় স্ল্যাং যায় কিনা, তা ভাববার আছে বটে!
তবে কী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ধনী গরীব উঁচু নীচুর সাম্যতা নেই বলেই ধনবানের সন্তানদের এমন মনোবিকৃতি?
লাখ লাখ টাকা খরচ করে এসব বিশ্ববিদ্যালয় নামের বাণিজ্যিক শিক্ষায়তনে গরীবের পড়বার সুযোগই যেখানে রাখা হয়নি, সেখানে এগুলো স্রেফ ধনিক শ্রেণির পরিচয় জাগানিয়া পাঠ ফ্যাশনের শেষ আশ্রয়। এর বেশি আর কী?
অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন পাওয়া এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়টা গবেষণা আছে, কয়টা পেটেন্ট আছে তা কেউ জানে না!
২.
এই দেশের আলো বাতাস জল খেয়ে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিদ্যা বিক্রি করে ধনবান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোটি টাকার বাণিজ্য করবে, সেই শিক্ষায়তন থেকে সরকারের ভ্যাট নেয়ার অধিকার থাকবে না, এমন মনোভাবও এক ধরণের বিকার। সরকারী লাগামহীনতার সুযোগে পড়াশোনাকে স্রেফ পণ্য বা বাণিজ্যে রূপান্তর করে নিয়েছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা। কাজেই সেই সরকার এসব বেপরোয়া প্রতিষ্ঠানের লাগাম টেনে ধরে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতেই পাঠবাণিজ্যে ভ্যাট বসাতে চাইছে হয়ত- রাষ্ট্রের সে অধিকার জনগণই তাকে দিয়েছে। সেখানে 'দেহ পাবিতো ভ্যাট পাবিনা'র দোহাই দিয়ে রাস্তা সরগরম করায় কেবল একধরণের আইন না মানা সংস্কৃতির অবক্ষয়কেই ওপরে টেনে তোলা হবে, কাজের কাজ কিছুই হবে না।
কে না জানে, বাংলাদেশের একটা প্রাইভেট ভার্সিটিও শিক্ষা বিস্তারে সেবার মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠেনি!
তাদের কাছে শিক্ষা কার্যক্রম হচ্ছে এক ধরণের শিল্প কারখানা আর কোমলমতি বিত্তবান শিক্ষার্থীরা হচ্ছে সেই শিল্পের টাকা কামানোর অসহায় পণ্য!
৩.
একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি যদি মাসে একশো টাকা হয়, সেখানে প্রাইভেট ভার্সিটিতে লাগে ১০ হাজার টাকা। আবার এসব প্রাইভেট ভার্সিটিতে পাঠদান করেন পাবলিক ভার্সিটি থেকে হায়ার করা শিক্ষকরাই। শিক্ষার খরচের ক্ষেত্রে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এতোটা বৈষম্য পৃথিবীর আর কোথায় আছে, কে জানে? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন মুনাফাবৃত্তির বিরুদ্ধে সচেতন শিক্ষার্থীদের কোনদিন আন্দোলন করতে দেখলাম না। অথচ এই মুনাফাবাজিতে রাষ্ট্র যখন মাত্র সাড়ে সাত ভাগ কর আরোপ করল, তখন এর বিরুদ্ধে গিয়ে মুনাফাখোর মালিকের পক্ষ নিয়ে শিক্ষার্থীরা কিনা পুরো বাংলাদেশ অবরোধ করবার হুশিয়ারি দিচ্ছেন। এটা একধরণের হিপোক্রেসি ছাড়া আর কি হতে পারে? আমরা সরকারী বা বেসরকারী সকল পর্যায়ে শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণের বিপক্ষে। তাই আন্দোলন যদি করতেই হয়, শিক্ষার সওদাগর প্রাইভেট ভার্সিটির মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধেই প্রথমে মাঠে নামুন, প্রিয় প্রজন্ম। তারপর সরকারের ভ্যাট নিয়ে শুভঙ্করের ফাঁকি বা ভুল শোধরানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিন।
……
একজন পথের ভিক্ষুকও যদি নিকোটিনের স্বাদ নিতে বিড়িতে সুখটান দিতে গিয়ে নির্দ্বিধায় সরকার নির্ধারিত ভ্যাট পরিশোধ করতে পারেন, সেখানে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা কি আমাদের অভাজন ভিক্ষুকেরও অধম?
ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫
https://www.facebook.com/fardeen.ferdous
https://twitter.com/fardeenferdous