সৈয়দ মহসিন আলী : কথাগুলো ফেরত নেবেন না!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 14 Sept 2015, 11:04 AM
Updated : 14 Sept 2015, 11:04 AM

'কেবল আপনা পরান বাঁচা' -এই নীতিতে বিশ্বাসী অত্যাধুনিক মনুষ্যবহুল এই সময়ে সবাই যখন নিজেদের নিয়ে বিব্রত থেকেই সময় পার করে যাচ্ছেন, ঠিক এমন সময়ে একজন সৈয়দ মহসিন আলী স্রোতের বিপরীতে হেঁটে গ্রাম্য প্রান্তিক জনেরই সখা থেকে গিয়েছিলেন। হাইব্রিডার পলিটিশানদের দৌরাত্ম্যের এইকালে নিরেট বঙ্গবন্ধুর আদর্শবাদিতায় জীবন কাটিয়ে দেয়া পরহিতৈষী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা একজন মানুষ আজ চলে গেলেন।
আমরা শোকাভিভূত!

এই মানুষটি চাতুর্যপূর্ণ ভাষায় কথা বলতে পারেননি বলে প্রায়শই সমালোচনার জালে বন্দি থেকেছেন। তাঁর প্রান্তিক সারল্যতাই তাঁকে মাঝে মাঝেই ভুগিয়েছে। আমরা এই মানুষটির শিশুসুলভ সেই সারল্যতাই মনে রাখব।

সর্বশেষ গেল ২৬ আগস্ট নরসিংদীতে গিয়ে জেলা প্রশাসন ও সমাজসেবা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাঁরা লেখালেখি করেন তাঁদের খুব সতর্ক হয়ে লেখালেখি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী। না হলে তথ্য-প্রযুক্তি আইন আছে, এর মাধ্যমে জীবন বিপন্ন হবে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
সৈয়দ মহসিন আলী সেসময় আরও বলেছিলেন, 'এখন যদি আপনারা মনে করেন এই দেশটা আমরা এমনি বানিয়েছি আমাদের পরিশ্রম নাই, আর আপনারা যা ইচ্ছা তা লিখে যাবেন আর আমরা আপনাদেরকে ইয়ে করব। এইটা… এক কম্পিউটার দিয়ে মিথ্যা করে একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তাই লিখে দেবেন আর আপনাদেরকে ছেড়ে দেবে মন্ত্রী- সে কথা ভাববেন না। খুব সতর্ক হয়ে লেখালেখি করবেন।'

সাংবাদিকদের নিতান্ত সুহৃদ সেই সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ সৈয়দ মহসিন আলী আজ সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ৫৯ মিনিটে ৬৬ বছর বয়সে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেন। আমরা তাঁর বিদেহি আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছি।

গত বছর আগস্ট মাসেও সিলেটে আদিবাসী দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রতি অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে মাননীয় মন্ত্রী বলেছিলেন, এরা সবকটা খবিশ, চরিত্রহীন! স্বাধীন কমিশন হলে দেখে নেব তোমরা কতদূর যেতে পারো! আমার শ্বশুড় বাড়ি সিলেটে। সাংবাদিকদের পেছনে সিলেটের মানুষ লেলিয়ে দিতে আমার সময় লাগবে না। আমার সামনে থেকে দূর হও, তোমাদের মুখ দেখতে আসি নাই। এরা কেউ জার্নালিজমে পড়ে সাংবাদিক হয়নি। একমাত্র আমার মেয়ে জার্নালিজমে এমএ করেছে। আর এরা কলেজে ঘোরাঘুরি করে সাংবাদিক বনে গেছে।

একজন মন্ত্রীর প্রকাশ্য জনসমাবেশে সাংবাদিকদের নিয়ে এমন মন্তব্যে যারা মন খারাপ করে মহসিন আলীকে শাপ শাপান্ত করেছেন, আমরা তাদের দলে নই। বরং মন্ত্রীর গালাগালের দুঃখকে যাঁরা শক্তি হিসেবে নিয়েছেন আমরা তাদের দলে!

যেই মন্ত্রী ভরা মজলিশে গান শুনিয়ে সবাইকে মোহিত করতে পারতেন,
যিনি স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় না রেখে সদা সর্বত্র স্বাভাবিকভাবে বিড়ি ফুঁকে যেতে পারতেন,
যিনি ঘুম আসলেই মন্ত্রীসভাতেও একটু ঘুমিয়ে নিতে জানতেন,
তিনি আর যাই হোক, বিএনপির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বা আওয়ামীলীগের আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মতো মানুষ ছিলেন না।

তিনি মনে করতেন, সাংবাদিকরা অপ্রিয় সত্য কথা বলে, তাই মন্ত্রীর জন্য বিষফোঁড়া। এজন্য সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সামনেই ঝাল ঝাড়তেন। কিন্তু বেয়াইমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের মতো কোনো সাংবাদিককে জেলে নিয়ে রিমান্ডের ঘাইপানি খাইয়েছেন, এমন শোনা যায়না।
তিনি গান গাইতে জানতেন, তাই অবলীলায় যেখানে সেখানে গান গেয়ে সুরসুরভী ছড়াতে চাইতেন। আমাদের কালের ফোক শিল্পী মমতাজ জাতীয় সংসদেও আজকাল গান শোনান।

আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কবি কাজী নজরুল ইসলামের ধূমপানরত কোনো ছবি দেখিনা। আবার লেখক গুন্টার গ্রাস বা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাইপ খাওয়ার ছবি দেখতে পাই। পৃথিবীর তাবৎ গুণীরাই এই নিকোটিনের আস্বাদে ভেসেছেন। কিন্তু মহসিন মন্ত্রী সহজ সারল্যে তালজ্ঞান ছাড়া ধূমপানে মজে থাকতেন। এ ব্যাপারে অবশ্য তিনি নিজেই বহুবার কৈফিয়ত দিয়েছেন যে, মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর এক কিশোর সহযোদ্ধার শহীদ হওয়ার কষ্ট তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। যাকে তিনি নিজের পুত্রতুল্য মনে করে গেছেন আজীবন। সেই পুত্রশোক কাটাতে তাঁকে ধূমপানের ওপরই ভরসা করতে হয়। নিকোটিনের নেশায় পুরোদস্তুর আসক্ত ছিলেন তিনি। সেই আসক্তি কাটানোর বুদ্ধি হয়ত তাঁর মননেই আসেইনি কখনও।

অন্যদিকে সাংবাদিকদের সাবধানে লিখতে বলেছিলেন তিনি। এই মন্ত্রী আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাটা নিশ্চয় ভালো জানতেন। তাই হয়ত জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত সংবাদকর্মীদের সতর্ক করতে চাইতেন। কিন্তু তিনিতো পুলিশ প্রধান বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো ১৪ বছরের জেলের হুমকি দিতেন না।
স্বাধীন দেশে সাংবাদিকরা ঘরের মধ্যে মরে পরে থাকে, তাদের খুনিদের খুঁজে পাওয়া যায় না, নাটকের পর নাটক হয়, দিনের পর দিন যায় কিন্তু ৪৮ ঘন্টা আর শেষ হয় না। সাংবাদিকরা রাস্তায় মরে, অফিসে মরে। তারা সন্ত্রাসীদের হাতে মরে, পুলিশের মার খায় গণধোলাই খায়, এসব নিত্যনৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক ঘটনা এই স্বাধীন দেশে। যেখানে সাংবাদিক নেতারা দলদাস হয়ে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে, ঠিক এমন বাস্তবতায় মহসিন মন্ত্রী সাংবাদিকদের খানিকটা চোখ রাঙানি দিতেন; এ এমন আহামরি কিছুই ছিল না। বরং আমার সমালোচক আমার বন্ধু। এই সুত্র মেনে মহসিন মন্ত্রীকে সাংবাদিকদের বন্ধুই আখ্যা দেয়া যায়।

সেই প্রিয় বন্ধুটি আজ বিদায় নিলেন। সাংবাদিকদের আদর করে বকবার আর কেউ রইলেন না।

আবুল মাল মুহিত বা ব্যারিস্টার মওদুদদের মতো সবকালের মাখনভোজী ডিগবাজ মানুষদের পথে না হেঁটে কোনো ঘুরপ্যাঁচ না করে স্রেফ নিজ দলের জন্যই সিগারেটে সুখ টান দিতে দিতে সাংবাদিকদের বকেছেন বা আয়েশি ভঙ্গিতে সংগীত চর্চা করছেন।
কিন্তু ইয়াবা ব্যবসায়ী বদি বা লুটেরা শামীম ওসমানদের মতো কারও মাথায় বাড়ি দিয়েছেন এমনটা আমরা জানি না!

আমাদের ক্ষমতাসীন 'পরহেজগার মুসলমানগণ' কর্তৃক কান্দুপট্টি বা টানবাজারের মতই সমাজকে পঙ্কিলতামুক্ত করার অজুহাতে স্রেফ ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে টাঙ্গাইলের পতিতাপল্লী উচ্ছেদের দিন টিভি রিপোর্টে মহসিন আলী ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ চেহারা নিয়ে বলেছিলেন, 'যারা ওই পতিতাপল্লী উচ্ছেদ করেছে তাদেরকে প্রকাশ্যে শিরোচ্ছেদ করা উচিৎ'।
যদিও কথাটি প্রতীকি, কিন্তু এটা অনুধাবনযোগ্য যে, সমাজের সবচে' অভাগা ও অবহেলিত নারীদের পক্ষে প্রকাশ্যে মানবিকতার দায়বোধ থেকে কথা বলেছেন কেবলমাত্র এই মন্ত্রী। অন্য ধর্মপ্রাণরা সেসময় যেখানে পাপের ভয়ে মুখে কুলুপ এটেছিলেন। এইটুকু ঘটনা থেকেই সৈয়দ মহসিন আলীকে অন্যদের চেয়ে সহজেই আলাদা করে চেনা গিয়েছিল।

১৯৪৮ সালের ১২ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারে জন্ম নেওয়া সৈয়দ মহসিন আলী একাত্তরে সিলেট বিভাগ সিএনসি স্পেশাল ব্যাচের কমান্ডার হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
মৌলভীবাজার-৩ আসনের সাংসদ সৈয়দ মহসিন আলী কলকাতার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ ডিগ্রিধারী।
মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজসেবায় অবদানের জন্য ভারতের আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন রিসার্চ সোসাইটি সৈয়দ মহসিন আলীকে 'আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন স্মৃতি স্বর্ণপদক ২০১৪' প্রদান করে। 'হ্যালো কলকাতা' নামে কলকাতাভিত্তিক একটি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান তাঁকে 'নেহেরু সাম্য সম্মাননা ২০১৪' পুরস্কারে ভূষিত করে।

সমালোচনা বা কথাবলার উর্ধ্বে চলে গেছেন মুক্তিযোদ্ধ্বা সৈয়দ মহসিন আলী। আজ কেবল তাঁর পুরোনো কথাগুলোই রয়ে গেছে মানুষের মন বা মনের বাইরেও সর্বত্র। তাঁর ভাষায় আমরা খবিশ ও চরিত্রহীনেরাই রয়ে গেছি। আমরা যতোই মন খারাপ করি আর মন্ত্রীর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করি, তাই বলে আমাদের চরিত্রের বদল নিশ্চয় ঘটবে না।

সরল মানুষ ও স্রেফ একজন লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলী আমাদের কথা দিন, আপনার কথাগুলো ফেরত নিবেন না? কারণ আপনার ভাষা বুঝবার সাধ্য হয়ত আমাদের কারও ছিল না!

আপনার চিরতরে নিস্তব্ধতার কালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের হয়েই শেষ কথাগুলো বলে দিলেনঃ
অনেক কথা যাও যে বলে কোন কথা না বলি।
তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫
https://www.facebook.com/fardeen.ferdous
https://twitter.com/fardeenferdous