ধারাবাহিক মৃত্যুর মিছিলে সুশাসনের অপলাপ

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 31 Oct 2015, 06:28 PM
Updated : 31 Oct 2015, 06:28 PM

মানুষ হিসেবে অপঘাতে একটি ক্ষুদ্র পিপীলিকার অকাল প্রাণবিনাশও হৃদয় বিদীর্ণ করা বেদনা জাগায়! সেখানে ধারাবাহিক মৃত্যুর মিছিল দেখেও আমরা দ্রোহে জ্বলব ঠিকই; কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করব না! কারণ এতে না আবার সীমালঙ্ঘন হয়ে যায়! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আরক্ষা প্রধান বা মুক্তচিন্তার লেখকদের কচুকাটা করবার হুকুমদাতা শফি হুজুরের নসিহতগুলো মনে না রেখে আমাদের আর কী উপায়!

ধর্মের নামে গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতে গিয়ে রাজীব, দ্বীপ, জগৎজ্যোতি, অভিজিত, ওয়াশিকুর, অনন্ত বা নিলয়ের পর দুই বিদেশি হত্যা ও হোসেনি দালানে গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব নিয়ে চলছে জোর বিতর্ক। সরকারের তরফে আগে দেশে জঙ্গি থাকার কথা বলা হলেও এখন জঙ্গি নেই বলে সরকারের সকল এজেন্সিই সমস্বরে দাবি করে যাচ্ছে।

এই অবস্থার মধ্যেই শনিবার বিকালে লালমাটিয়ায় প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে এর কর্ণধার আহমেদুর রশিদ টুটুলসহ তিন প্রকাশক ও লেখকের ওপর হামলার চার ঘণ্টা পর রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতির স্বত্তাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপনকে গলাকেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এবং যথারীতি জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা এর দায় স্বীকার করেছে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে দীপন নিহত লেখক অভিজিত রায়ের বইয়ের প্রকাশক ছিলেন।

এ ঘটনার পর গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার দাবি করেছেন, সরকারের ভেতর থেকে একটি মহল ব্লগারসহ বিভিন্ন হত্যাকান্ডের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। তিনি বলেছেন, 'সরকারের এই হত্যাকান্ডগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার যে অপচেষ্টা, সেই অপচেষ্টা কিন্তু এই হত্যাকারীদের উৎসাহিত করেছে এবং এর ফলে এই হত্যাকারীরা সব সময় নির্বিঘ্নে থেকেছে, তাদের কোনো টিকিটি পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুঁজে পায়নি।'

সম্প্রতি দেশের একটি জাতীয় পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে ইউনিভার্সিটি অব হাইডেলবার্গের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. সিগফ্রিড ও. উলফ জানিয়েছেন, আইএস মতাদর্শগতভাবে জামায়াত বা মওদুদীবাদের অনুসারী। তাই জামায়াত পর্যুদস্তু থাকলে সেটা আইএসকেই দুর্বল করে রাখে। কিন্তু আমি বলব, এই ফলাফলটা আসে পরোক্ষভাবে। সরকার তো আইএসের উপস্থিতি প্রকাশ্যে স্বীকার না করার নীতি বা কৌশল অবলম্বন করে চলেছে। তাই আমি এই যুক্তি দেব যে, এমনটা যদিও ঘটছে বলে খালি চোখে দেখা যাচ্ছে, তবে তা ঘটছে সরকারের অজ্ঞাতসারে। আবার এটা এ ধারণারও জন্ম দিচ্ছে যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ওয়ার অন টেররের কোয়ালিশনের আওতাধীন সামরিক কার্যক্রমকে ফাঁকি দিয়ে সন্ত্রাসমূলক কর্মকান্ড চালাতে পারছে। আবার বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকেও তাদেরকে কোনো বড় ধরনের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে না। উপরন্তু তারা বাংলাদেশের সমাজে সহজে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারছে। এর ফলে এটা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সুপারিশ করা সমীচীন হবে যে ইতালীয় ত্রাণকর্মী সিজার তাবেলা ও জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যার ঘটনাকে আলাদাভাবে দেখা উচিত নয়। এবং এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকা-সংক্রান্ত আইএসের দাবি সরকারের তরফে সরাসরি নাকচ করা সমীচীন নয়।

কিন্তু আমাদের সরকারের এখনকার ঢালাও প্রবণতার মধ্যে দেখা যাচ্ছে। একটি খুনের ঘটনা ঘটবার তদন্তের আগেই দোষী হিসেবে বিএনপির নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। এমনকি নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের মতাদর্শের সাথে জামায়াতে ইসলামের মিল থাকবার কথা বললেও সরাসরি জামায়াত, হেফাজত বা জঙ্গির নাম মুখে নিতেই অনীহা দেখা যাচ্ছে তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক সরকার সমর্থক বা এর নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। বরং সরকারের মূল থিংক ট্যাংক থেকে বলা হচ্ছে তারা চিকন সুতোর মধ্য দিয়ে হাঁটছেন। এ বিষয়টি ধর্মান্ধদের আরো বেশি অন্ধকার ধর্ম চর্চার পথ খুলে দিচ্ছে; এ কথা বলতে গিয়ে সরকারের সুহৃদ বিজ্ঞান লেখক ড. জাফর ইকবাল পর্যন্ত তাদের বিরাগভাজন হয়েছেন।

অবস্থাদৃষ্টে দেখাই যাচ্ছে জামায়াত বা হেফাজতের কট্টরপন্থীরা এখন সরকারের ওলামা লীগ হয়ে কাজ করছেন। এবং তারা প্রকাশ্যে মুক্তচিন্তা চর্চাকারীদের কতল করার নির্দেশ দিচ্ছেন; সাথে দেশে পাকিস্তানের মতো করে ধর্ম অবমাননার জন্য ব্লাসফেমি আইনও চাচ্ছেন। এমনকি এসব ওলামা নামধারীরা নিজেরাই একে অপর গ্রুপকে উগ্রবাদী আনসারুল্লাহ সাব্যস্ত করছে! কিন্ত বেঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন সরকারের টনক নড়ছেই না!

এ বিষয়গুলো ড. ইমরান এইচ সরকারের বক্তব্যকেই শাণিত করে। তার ওপর ব্লগার বা লেখক হত্যাকান্ডের পর যেমন করে দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা পুলিশবাহিনী প্রধান হত্যাকারীদের ধরা বা হুশিয়ারী না দিয়ে লেখকদেরই সীমালঙ্ঘন না করবার নির্দেশনা দেন; সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সদিচ্ছার পাল্লাটা কাদের দিকে ভারি তা সহজেই অনুমেয়।

খুনিরা যখন ছায়া হয়ে মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে ঘুরে মানুষের পেছনে পেছনে। নিঃশ্বাস ফেলে ঘারে। সেসময় অতি ধর্মচারী পুলিশও নালিশ না নিয়ে নিলয়দের বিদেশ যাওয়ার পথ দেখায়। কারণ মানুষ রক্ষার দায়িত্ব তাদের না। তারা শুধু প্রভুর ইচ্ছায় রক্ষা করে যাবে প্রভুভক্ত স্বগোত্রীয় তথাকথিত ধার্মিক উগ্রবাদী বা মৌলবাদীদের! কারণ এই মৌলবাদপুষ্ট রাষ্ট্রে লেখা বা মুক্তচিন্তার সীমারেখা অনতিক্রম্য; কিন্তু দায়িত্বহীনতার কোনো সীমারেখা থাকতে নেই। চিন্তার সীমালঙ্ঘনকারীর জন্য জেল, ফাঁস বা দেশান্তরই একালের বিধায়ক নির্ধারিত শাস্তি! আর খুনিরা আজীবনেও ধরা পড়বে না; পড়লেও কিছুদিনের মধ্যেই জামিনে খালাস পেয়ে পুনরায় চাপাতি দিয়ে মানুষ মারার অস্পৃশ্য পেশায় ফিরে যেতে পারে। সত্যি সেলুকাস! কি বিচিত্র এখনকার এই দেশ!

বাংলাদেশের এসব হত্যাকান্ডের পর প্রতিবারই ঘটনার দায় স্বীকার করে জঙ্গি সংগঠন আইএস বা আনসারুল্লাহরা বিবৃতি দেয়। কাছাকাছি সময়ে আমেরিকার 'সাইট ইন্টেলিজেন্সের' রিটা কাৎজও তাঁর নিজস্ব টুইটারে এ বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করে টুইট করেন।

এর মধ্যে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী উগ্র সংগঠনগুলোর তৎপরতা নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে যে বিতর্ক তীব্র হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস গেল ৩০ অক্টোবর 'অ্যা রিফট ইমার্জেস ইন অ্যাফোর্টস টু কুয়েল টেরোরিজম ইন সাউস এশিয়া' শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ওই প্রতিবেদনে এসব চরমপন্থী ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যকার যোগাযোগ ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশের জন্য নতুন বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে দাবি করা হয়। সেখানে আরো বলা হয়, প্রায় এক মাস আগে, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত ফাইভ আইস অ্যালায়েন্সের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্য পায় যে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। গত ২৫ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়া তার নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণের ওপর সতর্কবার্তা জারি করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে টেস্ট ম্যাচ খেলতে ঢাকায় আসার সফর পর্যন্ত বাতিল করে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দল।

ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর সঙ্গে জড়িত জঙ্গি সংগঠনগুলো বাংলাদেশের ভেতরে কাজকর্ম চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন তথ্য বাংলাদেশ সরকারকে গত মাসে জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। এর পর ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি অস্বাভাবিক হামলা ও হুমকির ঘটনা ঘটে। এতে প্রমাণিত হয়েছে যে, ওই সতর্কবার্তা ছিল সঠিক। ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ায় ইতালীয় সাহায্য সংস্থার এক কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর দেশের উত্তরাঞ্চলে গুলি করে খুন করা হয় এক জাপানী কৃষিবিদকে। এরপর শিয়া মুসলমানদের এক বিরাট জমায়েতে পুলিশি বেষ্টনীর মধ্যেই বোমা হামলা চালানো হয়। ঘটনাস্থলে এক কিশোর নিহত হয় এবং আহত হয় আরো বহু মানুষ।

প্রতিটি ঘটনার পর ইসলামিক স্টেট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে এর দায় স্বীকার করে।

কিন্তু জঙ্গি হামলা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সতর্কবার্তা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি সন্দেহ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা ইসলামিক স্টেট বা আইএস বাংলাদেশে নেই বলে বারবার দাবি করছেন।
আমেরিকা বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ দিয়ে চেষ্টা করবার প্রয়াস পাচ্ছে যে, বাংলাদেশে জঙ্গি হুমকি রয়েছে এবং গেল কিছুদিনে দেশে উপুর্যপরি মুক্ত চিন্তার মানুষ ও দুইজন বিদেশির হত্যাকান্ডের মাধ্যমেও তার প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু এমন অবস্থায় সব ঘটনার দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে সত্য অস্বীকার করবার আনাড়ি প্রচেষ্টা দেশের জন্য শুভ ফল নাও বয়ে আনতে পারে। এবং সেই লক্ষ্মণই দৃশ্যমান হলো প্রকাশক দীপন হত্যার মধ্য দিয়ে। ধারাবাহিক এমন করুণ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সরকারের সুশাসন ও উন্নয়নের কথার ফুলঝুরি অপলাপ মাত্র। সরকারি নির্বিকারতা ও নির্লিপ্ততায় যেখানে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত; সেখানে উন্নয়ন ধুয়ে জল পান করার সময় বোধহয় ফুরিয়েছে। সরকার যে সময়টাতে জঙ্গি চেতনা নিয়ে রাজনীতির বাণিজ্য করতো, সেসময় জঙ্গির তৎপরতার জোরেসোরে দেখা যায়নি। আর এখন বলছে দেশে জঙ্গির ছিটেফোটাও নেই; অথচ এসময়েই জঙ্গির আনাগোনা বেড়ে গেছে।

দেশে বাংলা ভাইয়ের উত্থানের কালে তৎকালীন বিএনপির গুটিকয়েক মন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন এসব মিডিয়ার সৃষ্টি এবং নেত্রীকে তারা এই ভুল বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তীতে সারাদেশে বোমা হামলার মাধ্যমে তার ফল দেখা গিয়েছিল। বর্তমান সরকারও যদি বাঘ না আসার কালে বাঘ এসেছে বলে গলাবাজি করে বিরোধী পক্ষকে কোণঠাসা করে দিয়ে এখন যদি বাঘ না আসার গল্পকেই পাকাপোক্ত করবার প্রয়াসী হয়। তবে সত্যিকারের জঙ্গিরুপী বাঘেরা তাদের অধিকতর হিংস্রতায় কেবল শান দেওয়ারই সুযোগ পাবে। আর এর পরিণতি হতে পারে অসম্ভব ভয়াবহ। বিচ্ছিন্ন ঘটনা আর পরিকল্পিত হামলার নাটুকে কথাবার্তার ছেড়ে এবার ঝেড়ে কাশার সময় এসেছে। অতএব অস্বীকার করে নয়, জঙ্গি আছে ধরে নিয়েই এমন ধারাবাহিক করুণ মৃত্যুর রাশ টেনে ধরা জরুরি। না হয় খামোখা গদি আকড়ে থাকবার কোনো মানে থাকতে পারে না!

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের এই অস্বীকার বিলাসী সরকার বাহাদুরের জন্যই বুঝি এই পঙক্তিখানা বহুকাল আগে রচনা করে গেছেন!
দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি
সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?

লেখক: সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০১ নভেম্বর ২০১৫
twitter.com/fardeenferdous