পাকিস্তানি বিষমুক্ত পৃথিবী চাই

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 8 Dec 2015, 04:45 PM
Updated : 8 Dec 2015, 04:45 PM

বাংলা ভাষায় হ-য-ব-র-ল বলে একটি ঘোরপেঁচে শব্দ আছে। এর প্রতিশব্দ হিসেবে এসেছে জগাখিচুড়ি পাকানো, জট পাকানো, শৃঙ্খলা বা বিন্যাস নষ্ট করা। বিশ্ব মানচিত্রেও এমন এক গোলমেলে রাষ্ট্র আছে। পাঞ্জাব, আফগানিয়া, কাশ্মীর, সিন্ধু, বালুচিস্তান পরগণার আদ্যক্ষর নিয়ে প-আ-ক-স-তান নিয়ে ইসলামী জুমহুরিয়াতে পাকিস্তান। এটা দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত একটি দেশ। কিন্তু এই উদ্ভট পাকিস্তান নামের সাথে সাতচল্লিশে আমাদের শান্তিপ্রিয় ও অসাম্প্রদায়িক বঙ্গভূমি কোন অর্থে জড়াতে পেরেছিল তা বোধের অগম্য!

যে দেশটির হর্তাকর্তারা ১৯৪৭ থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত আমাদের হাড়হাড্ডি জ্বালিয়ে খেয়েছে। আমাদেরকে শোষণ করে নিজেদের পরগণার ভাঁড়ারঘর ভরে ফুলে ফেপে উঠেছে। অতি বিরুদ্ধবাদীরা তাই দেশটির মানচিত্রের সাথে জিহবা বের করা সোজা লেজ বিশিষ্ট বসে থাকা কুকুর অথবা সেনা বুটের মিল খোঁজে পান। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে দেশটি পয়দা হলেও অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় জুড়েই মিলিটারি জায়ান্টরাই জোরজবরদস্তিতে এটি শাসন করেছে। ধর্মের ভিত্তিতে এমন একজন মানুষ দেশটির গোড়াপত্তন করেন যিনি ব্যক্তি জীবনে ছিলেন আপাদমস্তক অধার্মিক। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সেই ব্যক্তিটি মুখে ১৯ শতকের ব্রিটিশ উদারবাদের কথা বলে, গণতন্ত্র ও প্রগতিশীলতার বুলি আওড়িয়ে, পাশ্চাত্য ধারার লেবাস পরে পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক এক রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। জীবনের শেষভাগে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সেই নেতা জিন্নাহভাই কারাকুল টুপি পরা শুরু করে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ নাম ধারণ করে হয়ে যান উগ্র মোল্লা রাষ্ট্র পাকিস্তানের কায়েদে আজম বা বাবায়ে কওম।

এই বাবায়ে কওম আসলে কেমন রাষ্ট্র পয়দা করেছিলেন? যে রাষ্ট্রে শান্তির ধর্ম বিকৃতকারী আবুল আলা মওদুদী নামের এক ওলামা জামায়াতে ইসলামী নামে এক ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে ব্যাপক প্রাণহানির দায়ে যিনি মৃত্যুদন্ডেও দণ্ডিত হয়েছিলেন। যার ভাবশিষ্যরাই জামায়াত, আলবদর, আল শামস, রাজাকার নাম ধারণ করে একাত্তরে এই বাংলা অঞ্চলে নজিরবিহীন বিভীষিকা ছড়িয়েছিল। খুন, ধর্ষণ, জ্বালাও পোড়াওসহ হেন অপকর্ম নাই যা পাকি হানাদারদের সহযোগি হয়ে জামায়াতিরা করে নাই।

২০১৩ সালে ঢাকায় 'ধর্ম ও রাজনীতি: দক্ষিণ এশিয়া' শীর্ষক সেমিনারে যোগ দিয়ে জামায়াত ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর ছেলে সৈয়দ হায়দার ফারুক মওদুদীও একাত্তরের সেই মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যথার্থতা তোলে ধরে বলেছিলেন, জামায়াত বাংলাদেশের শুধু বিরোধিতাই করেনি, এখানে গণহত্যায় অংশ নিয়েছে। জন্ম-পরিচয়হীন সন্তানের যেমন সম্পত্তিতে কোনো অধিকার থাকে না, জামায়াতেরও এ দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। ইসলাম রক্ষায় জামায়াত হেফাজতের মতো কোনো দলের প্রয়োজন নেই।
তিনি আরও বলেছিলেন, আমার বাবা তার সন্তানদের, মানে আমাদের কাউকেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কিংবা জামায়াতের রাজনীতি করতে বলেননি। তিনি আমাদের ৯ ভাইবোনকে পড়াশোনা করিয়েছেন দেশের বাইরে। আমার ভাইবোনদের প্রত্যেকেই দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পেশায় খুব ভালো অবস্থানে আছে। তিনি বলেন, বাবা আমাদের জামায়াত এবং জমিয়ত উভয় দল থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। বিষয়টিকে তিনি মাদক ব্যবসার সঙ্গে তুলনা করে বলেন, একজন মাদক ব্যবসায়ী যেমন চায় না তার সন্তানরা কেউ মাদক সেবন করুক, তেমনি বাবাও আমাদের জামায়াতের কর্মকান্ড থেকে দূরে রাখতেন।

জামায়াতের উদগাতা রাষ্ট্রটির জাতীয় পশুর নাম হলো পোখরানী ছাগল। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশিয় অতি পাকিস্তানপ্রেমী যারা ৩০ লাখ শহীদ বা ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রম উৎসর্গের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান বা হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন, যারা পাকিস্তান ক্রিকেটারদের প্রেমে পড়ে 'ম্যারি মি' বলে বিগলিত হন, তাদের দেখা পেলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ছাগল ও কাঁঠাল পাতারা স্মৃতিতে হানা দেয়! আমরা আবার ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ স্থান অধিকারী কিনা!

ঐ রাষ্ট্রে ধর্মীয় উগ্রবাদ এক ক্লাসিক মর্যাদা পেয়েছে। আইএসআই বলে ওদের একটা গোয়েন্দা সংস্থা আছে। উপমহাদেশব্যাপী সকল কুকর্মের হোতা ঐ সংস্থাটি। বর্তমান সময়ের সৌদি, কাতার, আমিরাত, ইসরাইল ও পশ্চিমাদের ক্রীড়নক অমানবিকতার বর্বর উদাহরণ আইএস'র সাথে আইএসআই নামটিরও দারুণ মিল। আলকায়েদা, তালেবান বা লস্করে তৈয়েবা টাইপ বিচিত্র নামের ধর্মান্ধ জঙ্গি সংগঠনের সূতিকাগার এই দেশটি। যেখানে সেনা ছাউনিতে ঢুকে শিশুদের হত্যা করতে পারে জঙ্গিরা। দেশটির সার্বভৌমত্বের দাঁত এতই নড়বড়ে যে, সেনা ছাউনির পাশে এ্যাবোটাবাদে লুকিয়ে থাকে বিশ্বের এক নাম্বার সন্ত্রাসী ওসামা বিন লাদেন। এবং আমেরিকা তাদের সৈন্য সামন্ত প্লেন হেলিকপ্টার নিয়ে পাকিস্তানের ভূখন্ডের ভিতরে ঢুকে সেই বাবায়ে জঙ্গিকে ধরে নিয়ে গিয়ে সাগরে ডুবায়ে দিতে পারে।

দেশটিতে প্রথম ও একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রীকে প্রকাশ্য জনসভায় ওরা খুন করতে পারে। নারী শিক্ষা অধিকার নিয়ে কথা বলায় কিশোরী মালালা ইউসুফজাইকে গুলি করতে পারে। এমনকি বিদেশি ক্রিকেট খেলোয়াড়রা পর্যন্ত ঐ দেশে যাওয়ার সাহস রাখে না, উগ্রবাদীদের গুলির ভয়ে। ওদের স্টার খেলোয়াড় শহীদ আফ্রিদী বা পরকীয়ায় জড়িত সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানী খারের সাথে এক মঞ্চেই গলাগলি করতে দেখা যায় উগ্র জঙ্গিবাদীদের।

দেশটির স্কুল কলেজে কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে একাত্তরের বাংলাদেশি মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে মিথ্যা ইতিহাস পড়ানো হয়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ওদের বই পুস্তকে বলা হয় দুষ্কৃতিকারী বা ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী।
সম্প্রতি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া প্রতিবন্ধী সেবা কেন্দ্রে সন্ত্রাসী হামলা করে যে, ১৪ জন মানুষকে মেরে ফেলা হলো। তার মূলেও রয়েছে ওয়াহাবী মতাদর্শী দুই পাকিস্তানী জঙ্গি তাশফিন মালিক ও রিজওয়ান ফারুক।

মধ্যম আয়ে উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য উৎপাদন, দুর্যোগ মোকাবেলা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয়, পোশাক শিল্প, ঔষুধ শিল্প, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ সকল সূচকে পাকিস্তান আমাদের অনেক পিছনে। এমনকি আমরা এখন বিভিন্ন ইস্যুতে মতদ্বৈততা দেখা দিলে আমেরিকা বা বিশ্বব্যাংকেও ছেড়ে কথা বলি না। পাকিস্তানকে চুয়াল্লিশ বছর আগে কবর দিয়ে আমরা এসব অর্জন করেছি। তবে ওরা পরমাণু শক্তিধর বলে নিজেদের পরিচয় দেয়। কিন্তু এই পরমানুর জনক আব্দুল কাদেরের নাম রয়েছে বিশ্ব সন্ত্রাসীর তালিকায় এবং ঐ পরমাণু বোমাগুলো ধর্মান্ধ মৌলবাদী উগ্র জঙ্গিদের হাতে পরতে সময় খুব বাকী নেই হয়ত। তখন উগ্রবাদীদের পারমাণবিক ঘৃণায় পাকিস্তান নামের ভূখন্ডটিই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যাবে না, তা কে বলতে পারে?

তো এমন অপবিত্র নষ্ট রাষ্ট্র, জঙ্গি উৎপাদনের কারখানা পাকিস্তানের কি দুঃসাহস আছে বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলবার। কিন্তু ঔদ্ধত্বের সীমা ছাড়িয়ে ওরা তাই করছে। মহান একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরের পর থেকেই ঐ বেয়াদব রাষ্ট্র পাকিস্তানের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওরা মনে করিয়ে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সমাজের অনুরোধের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পাকিস্তানের ১৯৫ জন জঘন্য সেনা যুদ্ধাপরাধীদের মাপ করে দেয়াটা ভুল ছিল। ওরা আজ ওদের সকল পাপ অস্বীকার করবার সাহস দেখাচ্ছে। ওরা ভুলে যাচ্ছে একাত্তরে আমাদের বীর বাঙালির প্যাঁদানিতে পিছু হটে নাকে খত দিয়ে আত্মসমর্পণ করে প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছিল আয়ুব, ইয়াহিয়া বা টিক্কা খানদের কুলাঙ্গার বশংবদরা।

ঐ রাষ্ট্রটির বেহায়াপনা এতোটা সীমা ছাড়িয়েছে যে, ওরা এখন একাত্তরের গণহত্যার অপরাধ পুরোপুরিই অস্বীকার করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক প্রাণ ও সম্ভ্রমহানির বিরুদ্ধে কথা বলায় ওদের দেশেরই মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীর বা হিনা জিলানীকে দেশ ছাড়া করার হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২২ নভেম্বর প্রথম প্রহরে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃতুদণ্ড কার্যকর করার পর এক বিবৃতিতে উদ্বেগ জানায় পাকিস্তান। এরপর ঢাকায় দেশটির হাই কমিশনারকে তলব করে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলার কড়া প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ সরকার।
এর এক সপ্তাহ পর ইসলামাবাদে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনারকে তলব করে দেশটি। সেসময় একাত্তরের গণহত্যার অপরাধও অস্বীকার করা হয়। অথচ পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ২০০২ সালের ৩০ জুলাই বাংলাদেশ সফরে এসে একাত্তরের মর্মন্তুদ ঘটনার জন্য রিগ্রেটস (অনুতাপ) প্রকাশ করেছিলেন।

বর্তমান সময়ের পাকিস্তানীদের এমন বেয়ারাপনার প্রতিবাদে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি ওঠে।

মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ না হওয়ার পক্ষে পাকিস্তানের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপিও। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্য লে: জে: (অব:) মাহবুবুর রহমান বলেছেন, পাকিস্তান বলেছে 'মুক্তিযুদ্ধে তারা কোনো যুদ্ধাপরাধ করেনি'। পাকিস্তান সরকার বলছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছে, বাংলাদেশে তারা কোনো গণহত্যা করেনি, বাংলাদেশে কোনো অন্যায় করেনি, সেখানে কোনো যুদ্ধাপরাধ হয়নি।
এই বক্তব্যকে 'জঘন্যতম মিথ্যা' আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এর থেকে জঘন্যতম মিথ্যা কথা আর তৈরি হয়নি। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই। একাত্তর সালে পাকিস্তান সরকার ইয়াহিয়া খান ও তার বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনতার ওপর লেলিয়ে দিয়ে তখন সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ গণহত্যা চালিয়েছে। তারা পোড়ামাটির নীতি অনুসরণ করে এই নয় মাস ধরে 'কিলঅন' ও 'লুটঅন' করেছে।
দেশের গণতন্ত্র বা সুশাসন নিয়ে দুই বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে চরম মতবিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের মিথ্যাচার ও ঔদ্ধত্বের প্রতিবাদে 'হেইট পাকিস্তান' ইস্যুতে দলমত নির্বিশেষে দেশের মানুষের অবস্থান একই সমান্তরালে। এটা আশা জাগানিয়াই বটে। এমতাবস্থায় একাত্তরের গণহত্যার অপরাধ অস্বীকার করায় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক 'মূল্যায়ন' করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও।

তবে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে অবস্থান নিয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক ছেদের বিষয়টি পাস হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র বা শিক্ষক প্রতিনিধি আগামী সময়ে পাকিস্তানে যাবেন না। পাকিস্তানকে 'নির্লজ্জ রাষ্ট্র' আখ্যা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা ও জাতিসংঘ এবং সার্ক থেকে পাকিস্তানের সদস্যপদ বাতিল করার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বানও জানিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং বিজয় অর্জিত হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসররা বিভিন্ন ধরনের অন্যায়-অত্যাচারে লিপ্ত ছিল ও ঠান্ডা মাথায় অত্যন্ত নির্মমভাবে বুদ্ধিজীবীসহ অনেক সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ ছিল বিশ্ব সভ্যতার বিরুদ্ধে অপরাধ। আজ তারা নির্লজ্জ মিথ্যাচার করছে। অথচ পাকিস্তান কর্তৃক গঠিত হামিদুর রহমান কমিশনেই গণহত্যার দালিলিক তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। কাজেই সন্দেহাতীতভাবেই এটা প্রমাণিত যে পাকিস্তান একটি বিকারগ্রস্ত ভ্রষ্ট রাষ্ট্র।

'ডিনায়াল' বা অস্বীকার এবং 'প্লি অব এ্যালিবাই' বা অপরাধ সংগঠনস্থলে উপস্থিত না থাকার বাহানা চিরকালীন দাগী অপরাধীদের জন্মগত দোষ। পাকিস্তানও এমন দোষেই দুষ্ট। তবে অজুত ঘৃণা ও অগণন মিথ্যাচারের মধ্যেও সামান্য অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো কিঞ্চিৎ আশার কথা হলো, আধুনিক যুগে পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সুশিক্ষিত তরুণ পাকিস্তানীদের কারও কারও বোধোদয় হচ্ছে। 'উই পাকিস্তানিজ অ্যাপোলোজাইস টু বাংলাদেশিজ' শীর্ষক অনলাইন পিটিশন স্বাক্ষর সংগ্রহের মাধ্যমে একাত্তরের গণহত্যার কথা স্বীকার করে অবিলম্বে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার জন্যে নিজ দেশের সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন ব্রিটেনের মর্যাদাপূর্ণ বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত তরুণ/তরুণীরা। পক্ষান্তরে দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের কিছুসংখ্যক তরুণ তরুণীরা একাত্তরের করুণ চেতনা জলাঞ্জলি দিয়ে এখনও গালে চাঁদ তারা পতাকা এঁকে পাকিস্তানী আফ্রিদীদের নামে প্রেমমাল্য সাজান।

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগের বিরোধী, ইসলামী ধর্মশাস্ত্রের সুপন্ডিত ও ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর রচিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম' এ যথার্থই বলেছেন, এ কথা স্বীকার না করে পারছি না যে, পাকিস্তান শব্দটাই আমার কাছে অরুচিকর। কাজেই সেই অরুচিকর পাকিস্তানী ইবলিশের বংশধরেরা একাত্তরে ওদের জুলুম ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হাজারবার অস্বীকার করলেও ১৯৭১ এর করুণ ইতিহাস মিথ্যে হয়ে যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে ঢুকে, রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষদের ধরে পরীক্ষা করে হত্যা করা হতো। গণহত্যার সংজ্ঞা মতে, কোনও একটা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে হত্যা করা হলে, স্থানচ্যুত করা হলে সেটার সংখ্যায় একজন হলেও গণহত্যা বিবেচিত হবে। মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে দলিলে এ রকম হাজারও প্রমাণ আছে। তাই এমন পাকিস্তানের জন্য আমাদের আজন্মের ঘৃণা। বুকের ভিতর সেই ঘৃণার আগুন জ্বালিয়েই রাখব।

নির্লজ্জ, বেহায়া, মিথ্যাবাদী, জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছেদ নয় কেবল, বিশ্ব ফোরামে ওদের অপকর্মের কথা তুলে ধরে পাকিস্তানী বিষদাঁত ভেঙ্গে ফেলবার বন্দোবস্ত করাটা সময়ের দাবি। ১৯৩৪ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির অন্যতম প্রবক্তা চৌধুরী রহমত আলী 'নাউ অর নেভার' নামের পুস্তিকায় পাকিস্তান নামের অদ্ভূত শব্দের উদ্ভব করেন। আমরাও রহমত আলীর কথায় সুর মিলিয়ে বলতে পারি, এই মুহূর্তেই পৃথিবীকে পাকিস্তানী বিষমুক্ত করার মোক্ষম সময়। নাউ অর নেভার!

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০৮ ডিসেম্বর ২০১৫
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous.bd