সেলিম আল দীন: আমার নবজন্মের পিতৃপুরুষ!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 13 Jan 2016, 11:05 AM
Updated : 13 Jan 2016, 11:05 AM

১৪ জানুয়ারি এক বিষন্ন বেদনাবিধুর দিন। ২০০৮ সালের এই দিনে আমার নবজন্মের পিতৃপুরুষ নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন আমাদের সবাইকে ছেড়ে অনন্তরে পাড়ি জমান। রেখে যান তাঁর স্নেহ, মমতা আর পরম ভালোবাসা। রেখে যান প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের অথৈ সমুদ্র। আর আমরা সেই নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকের রেখে যাওয়া দর্শন সমুদ্র মন্থনেই রোজকার দিন গুজরান করি। তাই লোকান্তরিত নন সেলিম আল দীন। আমরা অশেষ ভালোবাসায় সত্য ও সুন্দর মানুষ আপনাকে আমাদের হৃদয় ও মননে বয়ে চলেছি পিতা।

খুব ভালো থাকবেন ঊষর ধূসর জগতে হে আচার্য। দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পরীতির প্রবর্তক সেলিম আল দীন। বাঙালি সহস্র বৎসরের নন্দনতত্ত্বের আলোকে পাশ্চাত্য শিল্পের সকল বিভাজনকে অস্বীকার করে এই নবতর শিল্পরীতির প্রবর্তন করেন তিনি। বিশ্ব সাহিত্যের ধ্রুপদী ধারায় শ্রমজীবী মানুষ এবং বাঙলার আবহমান কালের সংস্কৃতিকে তাঁর নাটকে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিদানে সমর্থ হন অধ্যাপক ড. সেলিম আল দীন।

২০০৫ সালের ১৮ আগস্ট আমার শিক্ষাগুরু রবীন্দ্রোত্তর কালের বাঙলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার সেলিম আল দীন ৫৭ তম বর্ষে পা রাখেন। স্যারের জন্মদিন উপলক্ষে তৎকালে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে একটি সাক্ষাতকার নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেটি ছাপা হয়েছিল স্যারের জন্মদিনের ঠিক আগের দিন। সেটি হুবহু পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল স্যার প্রয়াত হওয়ার পর ২০০৮ সালের ১৬ জানুয়ারি। সাক্ষাতকারটি ছিল আমার পক্ষ থেকে স্যারের জন্য জন্মদিনের উপহার। সামান্যেই খুশি হতেন স্যার তবে তা প্রকাশ করতেন না।
আমরা তখন অনার্স থার্ড ইয়ারের ফাইনাল প্রোডাকশন করছি। স্যারের নির্দেশনায় শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ, তাও আবার মূল ইংরেজি ভাষায়। এই উপলক্ষে স্যারের সাথে অল্পবিস্তর খাতির হতে শুরু করেছে। তো একদিন সুযোগ বুঝে স্যারকে বললাম, জন্মদিন উপলক্ষে আপনার বর্তমান নাট্যভাবনা নিয়ে সাক্ষাতকার নিতে চাই।
স্যার খানিক ভেবে বললেন,
তুই পারবি? তারচে' বরং নূরকে পাঠা।

নূর সিদ্দিকী আমার একই বিভাগ ও একই হলের আপনজন বন্ধুবর বড় ভাই। তিনি সেকালে প্রথম আলোর প্রতিবেদক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিরোধী নিউজ করে মাঝে মাঝেই ক্যাম্পাসে ঝড় তুলছেন। কিন্তু আমার পত্রিকা প্রশাসন সমর্থক হওয়ায় আমার নিউজের কাঠিতে ঠিকঠাক আগুন জ্বলত না বা ঝড়ও উঠত না!
আমি মাথা আনত করে বললাম,
স্যার, আমি পারব।
আচ্ছা প্রশ্ন তৈরি করে আগেই আমাকে দিস। আর শোন কাল বিকেলে আমি ফোন দিলে আমার সাথে হাঁটতে বের হবি। এক নাগাড়ে বলে গেলেন স্যার।

একটা বিষয়ে খুব মন খারাপ হলো, স্যারের সাথে সারা ক্যাম্পাস হাঁটতে হবে তাই। স্যার হাঁটার শিষ্যসঙ্গি পেলে তাকে আর সহজে ছাড়তে চাইতেন না! সঙ্গত কারণেই আমরা অবোধ ছাত্ররা স্যারের সাথে হেঁটে সময় পার করতে চাইতাম না!
কিন্তু শিক্ষার্থী সহযোগে হাঁটা ও জ্ঞান বিনিময়টা স্যারের নিজস্ব ব্রান্ড ছিল। পরের সাতদিন হাঁটলাম। স্যারের বাসায় গেলাম। স্যার নিজ হাতে চা করে খাওয়ান।
কিন্তু আমার সাক্ষাতকারের খবর হয় না। অথচ প্রশ্ন ও একটা সনি টেপ রেকর্ডার আমার প্যান্টের পকেটেই থাকে। যাহোক জন্মদিনের তিনদিন আগে স্যার বাসায় ডেকে তৎক্ষণাৎ পাওয়া আমার প্রশ্নের জবাব দিতে থাকলেন।

সেদিন অনেক প্রশ্নের মধ্যে বাংলাদেশি টেলিভিশন নাটক প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন,
প্রেমের অবিরল উপস্থাপনা প্রত্যেকটি নাটকে। যা ম্লান বা পান্ডুর একটা কালকে উপস্থাপন করে।
জীবনের প্রধান প্রবণতা তো প্রেম নয়। জীবনের আরও অনেক অনুষঙ্গ আছে।
চ্যানেলের নাটকগুলো দেখলে মনে হয় ওটাই যেন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে-যুবক যুবতীদের সম্পর্ক।
তিনি আরও বলেছিলেন,
আরেকটি অশনিসংকেত হলো যে- প্রতিবেশী দেশের সিরিয়ালগুলোর খুব বাজে প্রভাব পড়ছে আমাদের দেশের নাটকগুলোতে।

পাঠ্য হিসেবে থিয়েটার বিষয়ে স্যার বলেছিলেন,
যারা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে কলেজগুলোতে থিয়েটার পাঠ্য করবে, তারা নিশ্চিতই ছেলেমেয়েদের একটা ভালো ভবিষ্যত গড়ে দিতে পারবে।

জীবন সম্পর্কে স্যারের উপলব্ধি ছিল,
জীবন ক্রমেই মৃত্যুর দিকে হামাগুড়ি দিচ্ছে।

দেশ সম্পর্কে স্যার বলেছিলেন, এক কথায় বলব আমার দেশের চেয়ে ভালো দেশ, সুন্দর দেশ পৃথিবীতে নেই।
…….
২০০৬ সালে অনার্স শেষ বর্ষে থাকাকালে মে মাসে আমাদের ঘর আলো করে এক ক্ষুদে মা এলেন।
কিন্তু আত্মীয় স্বজনদের দেয়া বাহারি নামের ভিতর সত্যিকারের নাম নিশানা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
খুব সাধ হলো স্যার যদি আমাদের কন্যার নাম রেখে দেন, তবে আমার মায়ের জীবনে তা ইতিহাস হয়।
লজ্জায় নাক ভেঙ্গে যাওয়ার ডরে স্যারকে বলতেই পারছি না বিষয়টা। আমার ক্লাসমেট বন্ধু শাহীন আক্তার স্বর্ণাকে বিষটা খুলে বললাম। স্বর্ণা সানন্দে ত্রাণকর্তীরূপে আবির্ভূত হলো। ঐ বছর অক্টোবর মাসের দিকে গুটি গুটি পায়ে স্বর্ণাসহযোগে স্যারের অফিস কক্ষে গেলাম।
স্যার আমার সবিনয় আবেদন শুনলেন। মুচকি হাসলেন।

নিজের ডেস্ক ক্যালেন্ডারের একটি পাতা ছিড়ে স্বর্ণাকে একটি লাল কালির বলপেন দিয়ে লিখতে বললেন:
কোন্যা…
সুখপ্রীতা…
সম্প্রীতা…
আবৃতা…
আবৃতা বানানটা স্বর্ণার হচ্ছিল না দেখে নিজ হাতেই লিখে দিলেন।
'সুখপ্রীতা' নামটি পুরোদস্তুর আনকমন হওয়ায় ওটাই চুড়ান্ত হলো। আমাদের একমাত্র কন্যা সুখপ্রীতার সাথে আমার শিক্ষাগুরুর নামটিও জড়িয়ে গেল!
আমাদের সুখপ্রীতার প্রথম জন্মদিনের আগেই সেলিম স্যার শুভ কামনা জানিয়ে একটা কার্ড পাঠিয়েছিলেন।
সেখানে নিজের স্বাক্ষরে লিখে দিয়েছিলেন:
জীবনের আগাম সংহিতা অটুট রেখো ও আমাদের সুখপ্রীতা।
সেলিম আল দীন
১১.০৫.০৭।

নামকরণের পরে স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনটি নামের অর্থ বুঝলাম, কিন্তু কোন্যা শব্দটা ঠিক বুঝলাম না।
স্যার বললেন,
আরে ব্যাটা, ত্রয়োদশ শতাব্দীর আনন্দ ও ভালোবাসার কবি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি'র নাম শুনেছিস।
তুরস্কের কোন্যা শহরেই এই সুফি ও দার্শনিক কবির সমাধি করা হয়েছে।
সেখানেই তিনি মানুষের জীবন, ভালোবাসা ও বোধ নিয়ে তাঁর বৃহৎ কাব্য মসনবি রচনা করেছেন।
রুমির জীবনী পড়ে এসে আমার সাথে কথা বলবি, যাহ!
স্যারের এমন প্রজ্ঞাপূর্ণ পান্ডিত্যে শ্রদ্ধাবনত না হয়ে পারা যায়!
…….
২০০৭ সাল। স্যার সারাজীবনের নাট্যচর্চার স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক পেলেন। ক্যাম্পাসে স্যারকে নিয়ে খুব আনন্দ হৈহল্লা হলো।
কিন্তু এরপর থেকেই নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অন্য শিক্ষকদের সাথে কিঞ্চিৎ দুরত্ব সৃষ্টি হলো। আমরা তখন মাস্টার্সে। আমি নাট্যরচনা গ্রুপের বলে স্যারের সরাসরি ছাত্র। ক্লাস করছি, ভোরে স্যারের সাথে নিয়মিত হাঁটছি। স্যারের মন খারাপের ভাগিদারও হচ্ছি। জানলাম বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সিনিয়র এক শিক্ষকের সাথে, যাকে তিনি নিজেই পড়িয়েছেন, শিক্ষক বানিয়েছেন, তাঁর সাথে মতান্তর ও মনোমালিন্য হয়েছে।

একদিন ভোরে চৌরঙ্গিতে আমার সাথে একা হাঁটতে হাঁটতে স্যার একজনের নাম করে বললেন,
ওই ভাঁড়কে আমি শিক্ষক বানাব! আমি বেঁচে থাকতে তা হবে না!

দেখতে দেখতে স্যারের ৫৯তম জন্মদিন চলে এলো। বিভাগের কারও এ বিষয়ে মন না থাকায়, স্যার নিজেই নিজের জন্মদিন পালনের জন্য ঘরোয়া আয়োজন করলেন। নাট্যরচনা গ্রুপের নীলা, লোপা, মুন, কাকলী ও আমি সবকিছু এরেঞ্জ করলাম।
স্যার আমাকে দায়িত্ব দিলেন বিভাগের দুইশ জনের জন্য ধামরাইয়ের যোগেন ঘোষের দোকান থেকে মিষ্টি, লুচি ও সবজির অর্ডার দিতে। ১৮ আগস্ট ২০০৭ সালে স্যারের শেষ জন্মদিনে থিয়েটার ল্যাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্যার আসলেন। শিক্ষার্থীরাও আছে।
স্যার নিজ হাতে অনেককেই মিষ্টি লুচি খাওয়ালেন।
আমাকে বললেন,
তোর ম্যাডামতো মিষ্টি খেতে পারবে না, সবজি আর লুচি পাঠিয়ে দিস।
একসময় স্যার চারপাশ ও দরজার দিকে তাকিতুকি করলেন। বিভাগের প্রত্যেক শিক্ষকই তাঁর সরাসরি ছাত্র।
কিন্তু সেলিম আল দীনের জন্মদিনের প্রোগ্রামে বিভাগের কোনো শিক্ষক উপস্থিত নাই। যে প্রোগ্রামটা স্যার কিনা নিজেই আয়োজন করেছেন। আমার বন্ধু লোপাকে পাঠানো হলো, সেলিম স্যারের পরেই সবচে' সিনিয়র শিক্ষকের কক্ষে। সেলিম স্যার তাঁকে জন্মদিনের প্রোগ্রামে চান।
লোপা গেল।
তিনি নাকি জানালেন,
বিভাগে এতো হইচই কীসের?

পরবর্তী দু'চারজন শিক্ষক এলেন বটে কিন্তু সেলিম আল দীনের সবচে' প্রিয়তর শিক্ষকটি যে এলেন না!
স্যার যারপর নাই দু:খ পেলেন। পরের তিনদিন আমাদের সাথে কথাই বললেন না।
মনে এমনতর কষ্ট নিয়েই আমাদের অনাথ করে স্যার চলে গেলেন ১৪ জানুয়ারি ২০০৮ সালে।

স্যার মৃত্যুকে অসম্ভব ভয় পেতেন কিন্তু ততোটা নিজের প্রতি খেয়াল রাখতেন না।
…….
চৌরঙ্গীতে আমাকে স্যার বেঁচে থাকতে যা হবে না বলেছিলেন।
স্যার প্রয়াত হবার পর গুরুশিষ্যের মনোমালিন্যকে উড়ায়ে দিয়ে তাই যথার্থ বাস্তবায়িত হয়েছে বলেই জেনেছি।
ভাঁড়তন্ত্রের জয় হয়েছে!
…….
স্যার আপনি ভোরে এই নগণ্য শিষ্যের সাথে ক্যাম্পাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হেঁটে বেড়াতেন। ভোরের সূর্যের স্নিগ্ধতা দেখতেন, মহুয়ার গন্ধে মাততেন। পাখপাখালির সুরশব্দ আর রঙে মুগ্ধ হতেন। ভোরের দুর্বা কুয়াশায় নিজের পদযুগল ভিজিয়ে শিশুদের মতো মজা পেতেন।
…….
স্যার বলতেন,
একটা ক্ষয়ে যাওয়া দিবসের মৃত্যু শেষে পরদিন নতুন দিন নিয়ে আসা ভোরের সূর্য যে দেখেনি, তার কাছে পৃথিবীর রূপ পুরোটাই অধরা। আচার্য সেলিম আল দীনের মতো এমন করে এতো সুন্দর ও সত্য কথা আর কে কবে বলতে পেরেছেন!
…….
অনন্ত মুক্তির অনিমেষ ছায়াপথ সেলিম আল দীন
তোমাকেই সত্য বলে মানি!
তুমি ছিলে, আছো, থাকবে!

ফারদিন ফেরদৌসঃ সেলিম আল দীনের ছাত্র ও সংবাদকর্মী মাছরাঙা টেলিভিশন
১৪ জানুয়ারি ২০১৬।