ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া সিলেটিয় স্বর্গ

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 30 March 2016, 07:31 PM
Updated : 30 March 2016, 07:31 PM

সার্চ ইঞ্জিন গুগলের কাছে ভ্রমণ বিষয়ে জানতে চাইলে ও জানাল, চিত্তবিনোদন, আনন্দ, পর্যটন, অবকাশ যাপন, গবেষণা, উদঘাটন, অনুসন্ধানসহ লোকজনের তুলনামূলকভাবে দূরতম ভৌগোলিক স্থানের মধ্যে গতিবিধি বা চলনই হলো ভ্রমণ। প্রাচীনকালে ভ্রমণে অনেক কষ্ট এবং প্রতিকূলতা ছিল বিধায় ভ্রমণের আদি ফরাসী শব্দ Travailler এর অর্থও করা হয়েছে পরিশ্রমের সাথে কাজ করা। আর আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে শরীর মন ভালো রাখতে হলে পরিশ্রমের বিকল্প নেই। তাই আর কি করা! আমরাও ঘামঝরাতে বেরিয়ে পড়েছিলাম সিলেট অঞ্চল ভ্রমণে।

কবিগুরুর ভাষায় এখনও চক্ষু মেলিয়া একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশিরবিন্দুই ভালো করে দেখা হয় নাই। তাই গেল ১৭ থেকে ২০ মার্চ এক ঘূর্ণনেই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অভয়ারণ্য, গ্রাণ্ড সুলতান টি রিসোর্ট এন্ড গলফ, মাগুর ছড়ার খাসিয়া পুঞ্জি, জাতীয় চা বোর্ডের চা বাগানসমেত বেগুনী শাপলা শোভিত মাধবপুর লেক, মুসলিম ধর্মীয়গুরু হযরত শাহজালাল (র.) ও শাহ পরাণ (র.)'র আধ্যাত্মিকতা এবং বিছানাকান্দির জল, পাথর আর পাহাড়ের মায়াবী হাতছানি সবই দেখা হলো বৃহত্তর সিলেটে গিয়ে।

চায়ের দেশে স্বাগতমঃ
শ্রীমঙ্গলের প্রবেশপথ সাতগাঁওয়ে এক পরিশ্রমী চা কর্মীর শ্বেতশুভ্র ভাস্কর্য আমাদের গাজীপুর টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামের সদস্যদের চায়ের দেশে স্বাগত জানালো। তারপর থেকে পাহাড় টিলার উঁচুনীচু পথে কেবল সবুজের মুগ্ধতা। কল্পনার নাসারন্দ্রে সবুজ চায়ের ঘ্রাণ এসেও ভিড় করছিল যেন। সতীর্থদের ছবি তোলার পালে হাওয়া লাগল যা শেষ দিন পর্যন্ত চলছিল; কারণ আজকাল কারো ক্যামেরায় রিল ফুরোয় না। তুলো ছবি আর আপলোড করো মার্ক জাকারবার্গের বদনবইতে। দেখিয়ে দাও বিশ্বকে হে ভ্রমণপিয়াসী তোমার একই অঙ্গে কত রূপ।

ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এর ডেপুটি ডিরেক্টর আব্দুল মুহাইমিন মিয়া ভাইয়ের মৌলভীবাজার শহরের বাংলোয় ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ রেখেই শ্রীমঙ্গল শহরের সাত রঙা চায়ের স্বাদ নিতে ভূদৌড়। কালিঘাট রোডের নীলকন্ঠ চা কেবিনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আবিষ্কারক ও চা মেকার ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার রমেশ রাম গৌড় প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। আমাদের স্বাগত জানিয়েই চা তৈরিতে বসে গেলেন। পাক্কা পৌনে এক ঘন্টা পর এলো বিখ্যাত সেই সাত স্তরের চা। ক্লোন টি ও বিভিন্ন ধরণের মসলার সংমিশ্রণে তৈরি যে চা খেয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ পদস্থ আধিকারিকরা ভূয়সী প্রশংসায় রমেশ রামকে ভাসিয়েছেন, সেখানে স্বাদ গন্ধের বর্ণনায় না হয় আমরাও প্রধানমন্ত্রীর দলেই থাকলাম। তবে সাত স্তরের চা পান শেষে স্পেশাল লেমন টি'র স্বাদ অতুলনীয়। মনে রাখতে হবে সাত স্তরের চা ৭০ টাকা আর ২ স্তরের চা ২০ টাকা। স্তরবিন্যাস অনুযায়ী দাম নির্ধারণ হবে, তবে সাত স্তরের ওপরে যাওয়া চলবে না। ওদিকে পা রাখলে সাত রঙা চা চেখে দেখবেন আশা করছি। সেইসাথে গৌড় চা কারিগরের সাথে সেলফি তুলতে ভুলবেন না যেন; আমরাতো ভুলিনি।

চা পান করে চাঙা হয়ে এনায়েতপুরের পীর সাহেব খাজা টিপু সুলতানের গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এন্ড গলফ এ গেলাম। তবে সন্ধ্যার আগে গলফ খেলার ব্যবস্থা ছিল না। সুতরাং চাইলেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হওয়ার সুযোগ ছিল না। আধুনিক সকল সুবিধাসহ একটি অসাধারণ নাইন হোল গলফ কোর্স ছাড়াও সেখানে রয়েছে লন টেনিস, ব্যাডমিন্টন, বিলিয়ার্ড ও টেবিল টেনিস খেলার আয়োজন। শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা খেলার জোন। রিসোর্টটিতে অ্যামিবা আকৃতির বিশাল সুইমিংপুলসহ সুনিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার সর্বমোট ৩টি সুইমিংপুল আছে। সেখানে আরো আছে থ্রি-ডি থিয়েটার, যেখানে ৪৪ জন একসঙ্গে বসে এই থিয়েটারে সিনেমা উপভোগ করতে পারবে। দেশের কোন আনন্দ নিবাসে এই প্রথমবারের মত সংযোজিত হয়েছে সুবিশাল পাঠাগারও। রিসোর্টে তিনটি বিশালাকৃতির দৃষ্টিনন্দন রুচিশীল মিটিং কক্ষ ছাড়াও অত্যাধুনিক সুসজ্জিত জিমনেসিয়ামসহ রয়েছে স্পা, সনা, জ্যাকুজি ও ম্যাসেজ পার্লারের ব্যবস্থা। এখানে একরাত থাকতে হলে শুধু একরুমের ভাড়াই গুণতে হবে পনের হাজার টাকা। যাই বলেন, পীর সাহেবের রিসোর্টটা কিন্তু খাসা; যেনবা ভূতলেই স্বর্গ।

পরদিন গেলাম টিলার ভাজে ভাজে চা বাগানের সৌন্দর্য সন্ধান আর মাধবপুর লেকের বেগুনী শাপলার খুঁজে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন মাধবপুর লেকের পাড় থেকে চা বাগানের শ্যামলিমায় হারিয়ে যাওয়ার মজাই আলাদা। আর পাহাড়ের চূড়ায় উঠে লেকের বেগুনী শাপলা আর নীল জলের আহবানে কে না সাড়া দিয়ে পারে। চাইলে বুনো আনারস ও স্থানীয় ঝালমুড়ির স্বাদও নেয়া যেতে পারে। আর লেক থেকে তুলে নেয়া একটি বেগুণি শাপলা চা বাগানের কোনো টিলার আড়ালের সবুজ মায়ায় গিয়ে প্রিয়তমার খোপায় গোঁজে দিতেই পারেন। এসময় আবহ সঙ্গীত হিসেবে ভাবতে পারেন, কবি নজরুল ইসলামের সেই প্রিয় গান, 'মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেব খোঁপায় তারার ফুল'। দেখবেন বাবু সোনামনিরা আবার আপনাদের রোমাঞ্চের অতি আদিখ্যেতা যেন দেখে না ফেলে!

লাউয়াছড়া উদ্যানের সবুজছায়াঃ
মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ পিয়াসীদের জন্য আদর্শ স্থান। সেখানে গেলে বাহারি বিশাল বৃক্ষ আর বাঁশ ঝাড়ের সবুজছায়ার মায়ায় পড়বেন না এমন রসবোধহীন মানুষ মেলা ভার। সংরক্ষিত এই উদ্যানটি মাত্র ২৭৪০ হেক্টর আয়তনের হলেও জীববৈচিত্র্য বিস্ময়কর রকমের সমৃদ্ধ। এই জঙ্গলে প্রায় ১৫৯ রকমের গাছগাছড়া পাওয়া যায়, পাওয়া যায় ধনেশ, বন মোরগ, হরিয়ালসহ প্রায় ১২০ রকমের পাখি। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে আছে উল্লুক, লজ্জাবতী বানর, আসামী বানর, লেজী বানরসহ ৬ প্রজাতির বানর, কমলা পেট কাঠবেড়ালী, খাটাশ, বন বেড়াল, সোনালী শেয়াল, মায়া হরিণ, নানা রকম সরিসৃপ ও সাপ।

লম্বা পথ ধরে বনের ভিতরে অনেকদূর পর্যন্ত যাওয়া যায়। নীরব নিস্তব্ধতা অনুভব করা যায়। বাদলা দিনে বনের ভীষণ ঘণ ঝোপঝাড়ে হারিয়ে গিয়ে পানিপ্রবাহী ছড়া দেখতে দেখতে পাখপাখালির সুর শব্দের সাথে অনুপম রায়ের 'গভীরে যাও আরও গভীরে যাও' গানটি শুনতে পেলে মন্দ হবে না। এভাবে ঘণ অরণ্যের সবুজ ছায়া আর বিচিত্র ঘ্রাণে প্রকৃতি প্রেমের পরীক্ষাটা সেরে ফেলা দুর্দান্ত হতে পারে!

লাউয়াছড়া অভয়ারণ্যের পাশেই রেল লাইন ঘেসে মাগুর ছড়া খাসিয়া পুঞ্জি না দেখলে সব মিস। একটা টিলার ওপরে শতাধিক আদিবাসী খাসিয়া পরিবারের বসবাস। টিলার ধাপে ধাপে কী সুন্দর গোছানো বাড়িঘর। কর্ডর নামে ওদের নিজস্ব মন্ত্রীও আছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থাটাও খুব পোক্ত। মন্ত্রী মহাশয় অনুমতি দিলেই কেবল ভিসাসহ খাসিয়া রাজ্যে প্রবেশ করে তাদের চাষ করা পানের বরজ ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রার দেখা মিলতে পারে। একটা টিলার ওপর একটা রাজ্য ভারী মজার!
সময় পেলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অনতিদূরে বণ্যপ্রাণি সংরক্ষণ কেন্দ্রেও একবার ঢু মারতে পারেন। ময়নার নিজ মুখে ময়না ডাক শুনবার সুযোগ এখানেই মিলতে পারে। আর লজ্জাবতী বানরের অপত্য সন্তানস্নেহ বা মাতৃপ্রেমও আপনার নজরে পড়তে পারে, যদি আপনি হোন খুব ভাগ্যবান।

কপালে থাকলে হতে পারে পার্টিওঃ
ভ্রমণবিলাসের দ্বিতীয় দিন দুপুরে আমাদের গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদের নিকটজন সেই মুহাইমিন ভাই মৌলভীবাজারের নিজের গ্রামের বাড়ি কচুয়াতে আমাদেরকে নানা ব্যঞ্জনায় জম্পেশ লাঞ্চ করালেন। সাথে মার্বেল পাথরে কারুকাজ করা ওনার শানদার লন্ডনি বাড়ি খানা দেখবারও ফুরসৎ হলো। সিলেট বেল্টের একটা ঐতিহ্য হলো, গ্রামের গহিনে গহিনে কোনো শস্যক্ষেতের ধারে লন্ডন প্রবাসীরা সুরম্য প্রাসাদ বানিয়ে রেখেছেন। আটেপক্ষে কখনও তারা পরিবার পরিজন নিয়ে দেশে আসলে সেখানে উঠেন। বাকী সময় নিকট স্বজনরাই এসব প্রাসাদোপম বাড়ি দেখভাল করেন।

ঐদিনই আমরা ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজে ব্যবসায়ী মুহাইমিন ভাইয়ের আতিথিয়তা থেকে বিদায় নিয়ে সিলেট শহরের নাইওরপুলের হোটেল সিলভিওতে উঠলাম। সেখানে আমাদের স্পন্সর হলেন মুহাইমিন ভাইয়ের বন্ধু ও সিলেটের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এম. আব্দুল মতিন ভাই। পরদিন রাতে যিনি সিলেট স্টেশন ক্লাবে আমাদের অনারে গ্র্যান্ড ডিনার পার্টি দিলেন। পার্টিতে আমাদের সাথে যোগ দিলেন দুবাইভিত্তিক আল হারামাইন গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফজলুর রহমান ও গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী দেলোয়ার হোসেন। মতিন ভাই সিলেটের ঐতিহ্যবাহী খাবার সাতকরাসমেত মিট ও নানা ব্যঞ্জনায় অতিথি আপ্যায়ণ করলেন। শেষে ক্লাব কালচার অনুযায়ী আমাদের ওপর ড্রিংক পার্টিও আরোপ করতে ভুললেন না। তবে বিদেশ বিভূইয়ে আমরা একদমই ড্রাংক হলাম না। তবে পার্টির গল্পেসল্পে জানা, সিলেটে ফজলুর রহমান ভাইয়ের সাড়ে পাঁচশো কোটি টাকা খরচে নির্মিত বাড়িখানা খুব মিস করলাম। সময়াভাবে হলো না দেখা; আরেকবার নিশ্চয় হবে। ভ্রমণবৃত্তান্তের সকল কৃতজ্ঞতা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, বিজনেসম্যান আব্দুল মুহাইমিন মিয়া ও মিশুকমানুষ এম. মতিন ভাইয়ের জন্য তোলা থাকল।

রোমাঞ্চকর বিছানাকান্দি সবিশেষঃ
সিলেটের সীমান্তবর্তী তামাবিল পার হয়ে পিয়াইন নদী বরাবর জাফলং এর নাম সবার মুখস্ত। তবে জাফলং এর সহোদরা প্রকৃতি কন্যা বিছানাকান্দির নামও বাঙালির মনন মস্তিষ্কে পৌছতে শুরু করেছে। স্ফটিকবৎ স্বচ্ছ জল, রংবেরং এর পাথরের গোলক ধাঁধা আর নীল পাহাড়ের হাতছানি সব এক সাথে মেলে বিছানাকান্দিতে। সিলেট থেকে লাফনাউট, গোয়াইনঘাট, হাঁদারপাড় হয়ে মায়াবী সেই ভ্রমণতীর্থ। তবে বর্ষা বা শুষ্ক মৌসুমের চেয়ে হেমন্তে যাওয়া ভালো। পাহাড়ের চূড়ায় বসে নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে মন ভাসানোটা তাহলে সম্ভব হতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে কাছাকাছি গেলেই এখানে সেখানে চোখে পড়বে অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলনের ভূমিবিধ্বংসী বিশাল বিশাল গর্ত। আর দেখা মিলবে প্রসাধনী ও চকোলেট সামগ্রির ছোট্ট একটি বাজার। আমার দেশের কোনো পণ্য সেখানে মিলবে না একমাত্র ভারতীয় পণ্য ছাড়া। এসবের পাড় ঘেষেই রাস্তা খুঁজে নিয়ে পৌছতে হয় সেই জাদুকরি বিছানাকান্দিতে।

কিন্তু ধুলোর রাজ্য মাড়িয়ে বহু প্যাচঁগোছের রাস্তা পেরিয়ে সেখানে পৌছবার পর দেহ, মনপ্রাণ ও নয়ন জুড়ানোর আগেই মন খারাপের হালকা হাওয়া চারপাশে বয়ে যেতে পারে। কারণ অপরূপা বিছানাকান্দির মূল সৌন্দর্যটাই পড়েছে ভারতের মেঘালয় অংশে। সেদিকে যাওয়া মানা। আমাদের বর্ডার গার্ডের জোয়ানরাই কড়া পাহারা বসিয়েছে। বিএসএফে'র গুলিতে হৃদয় খুড়ে কে হায় বেদনা জাগাতে চায়? সুন্দরের কাছে গিয়েও যখন না ছুঁয়ে ফিরবেন, মনে মনে 'রাডক্লিফ লাইন'কে গালি দেবেন। কে বলেছিল, গগনচুম্বী পাহাড়গুলোকে ভারতের দিকে ফেলে শুধু সমতল ভূমিটাকে আমাদের দিতে।

ব্রিটিশ চাকর সেকালের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা স্যার সিরিল জন রাডক্লিফ যে ঘরে বসে আকন্ঠ সুরায় নিমগ্ন হয়ে তাড়াহুড়ো করে সীমানা চিহ্নিত করেছিলেন তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।

ব্রিটিশরা ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ১৯০ বছর এই বিশাল ভূখণ্ডের ওপর শাসন-শোষণ ও কর্তৃত্ব বজায় রাখে। অবশেষে এ অঞ্চলের মানুষের অব্যাহত আন্দোলন আর দাবির মুখে ভারতের সর্বশেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবি মেনে নেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে 'ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্ট অ্যাক্ট-'৪৭ অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। দেশভাগের শর্ত অনুযায়ী মুসলিমপ্রধান এলাকা পাকিস্তানের আর হিন্দুপ্রধান অঞ্চল ভারতের অংশ হলো। স্যার সিরিল রাডক্লিফের নেতৃত্বে লর্ড ব্যাটেন গঠিত 'বাউন্ডারি কমিশন' সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজ সমাপ্ত করে ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট। তাঁর নামানুসারে চার লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সীমান্তরেখার নাম হয় 'রাডক্লিফ লাইন'।

বিছানাকান্দিতে গিয়ে আফসোস হবেই, আহা দু'একটা পাহাড় যদি আমাদেরও থাকত। মনে পড়বেই ১৯০৬ সালে কেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ করার প্রস্তাবকদের জন্য এই মর্মস্পর্শী গান লিখেছিলেন- 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'।

কংগ্রেস প্রভাবিত রাডক্লিফ ভারতের স্বার্থ দেখতে গিয়ে আমাদেরকে বঞ্চিত করেছেন। তাই ঐ ভদ্রলোকের বাউন্ডারি কমিশনের প্রহসনিক ডিমারকেশন মানতে এই মন সায় দেয় না। আমাদের সকল সুন্দরেরাই কিনা পরাধীন। অতীত রাজনীতিবিদগণ যারাই এসব ভাগাভাগিকান্ডে জড়িত ছিলেন তাদের অদূরদর্শী কাজকে ধিক্কার জানাই। আর ভাবি আহা, বিছানাকান্দির অপূর্ব শোভা আর মন ভোলানো রোমাঞ্চ তুমি যদি পরিপূর্ণভাবে আমাদের হতে? আচ্ছা নাইবা হলে আমার, তবু ভালো থেকো প্রকৃতি কন্যা।


শেষবেলায় এতোকাছে এসেও বিছানাকান্দির শীতলজলে ডুবসাঁতারে প্রাণ জুড়াতে না পেরে আমাদের টেলিভিশন ফোরামের সভাপতি ও এনটিভির স্টাফ করেসপন্ডেন্ট নাসির আহমেদ একখানা লুডিক্রাস গল্প শুনিয়ে দিলেন।
মেঘালয়-সিলেটের রাডক্লিফ লাইনের ওপরে পড়া একটি ইঁদুরের গর্তবাড়ি প্রতিদিন সকালে এসে ভেঙ্গে দিয়ে যান জনৈক লোভী ব্রাহ্মণ পুরোহিত। যিনি কিনা ভুলভাল কাগজপত্র দিয়ে পাহাড়গুলোকে ভারতের অংশে ফেলতে রাডক্লিফ সাহেবকে প্রলুব্ধ করেছিলেন। সেই তিনি বাংলাদেশি একটি ইঁদুরকে কোনোমতেই তার দেশে ঢুকতে দেবেন না। বড় বিরক্ত হয়ে একদিন সুযোগ বুঝে এই বাঙালি ইঁদুর ব্রাহ্মণ মহাশয়ের সম্ভ্রম বিনাশ করে দিয়ে এল। ব্রাহ্মণ টের পেয়ে তড়িঘরি করে ইঁদুরকে খুঁজতে বের হলেন। বহু সময় ধরে বহু পথ ঘুরে অবশেষে এক চলন্ত ট্রেনে এসে উপনীত হলেন সেই ব্রাহ্মণ। সেখানে এক ধারি ইঁদুরকে খবরের কাগজে মুখ লুকিয়ে অতি মনোনিবেশে খবর পড়তে দেখলেন ব্রাহ্মণ।
ব্রাহ্মণ গম্ভীর কন্ঠে শুধালেন: হেই, এই ট্রেন দিয়ে এক ইঁদুরকে পালাতে দেখেছ নাকি?
ইঁদুর ততোধিক গম্ভীর গলায় উত্তর দিল, কোন ইঁদুর? সেই যে রাতে ব্রাহ্মণকে মেরে দিয়ে এসেছে সেই ইঁদুর?
ব্রাহ্মণের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, রাতের ঐ খবর পেপারেওনি উঠছে। সাড়ে সব্বোনাশ!

এভাবেই নটে গাছটি মুড়োল আর প্রকৃতি বন্দনায় আমাদের অমৃত ভ্রমণ কথাও ফুরোল।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
৩০ মার্চ ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous.bd
twitter.com/fardeenferdous