ও বন্ধু… বাড়িয়ে দাও তোমার মানবিক হাত!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 5 April 2016, 04:42 PM
Updated : 5 April 2016, 04:42 PM

আমাদের কালের প্রথিতযশা শিল্পী ভূপেন হাজারিকা যখন তাঁর সুরের ইন্দ্রজালে জীবনমুখী গানে কথা সাজান, মানুষ মানুষের জন্য/ জীবন জীবনের জন্য/ একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু… আমরা বেশ প্রাণিত হই। মানুষের জন্য ভালোবাসায় উদ্বেলিত হই। কিন্তু আমাদের অনুভূতির কার্যকারিতা ওই পর্যন্তই। সুরের জাদু শেষে হৃদয়ের দ্বার বন্ধ করে চোখ মুদে আমরা যে যার পথে হাঁটি। কেউ কারও কথা মনে রাখবার জরুরত বোধ করি না। তবু ভূপেন হাজারিকার মতো করে কোনো এক অচিন গাঁয়ের বিরল দুঃখ গাঁথা শুনিয়ে দিয়ে বিবেকবান বন্ধুর কাছে সহানুভূতি যাচ্ঞা করে যেতে হয়।


গাজীপুর সদর উপজেলার বিশিয়া কুড়িবাড়ি গ্রাম। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের হোতাপাড়া স্টেশন থেকে চার কিলোমিটার দূরত্বের ঐ গ্রামে ৪০ বছর আগে সাধু পরিবারের এক গৃহবধূ হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পঙ্গু হয়ে যান। তার চার সন্তান ও চার নাতি সুস্থভাবে জন্ম নিলেও বড় হওয়ার পর এই রোগে আক্রান্ত হন। এরই মধ্যে এই দূরারোগ্য রোগে ঐ গৃহবধূ এবং তার দুই ছেলের মৃত্যু হয়েছে। দারিদ্রের কারণে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবাও পাননি তারা। পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের সুস্থতা নিয়েও তাদের মাঝে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ঐ পরিবারের ১২ জন সদস্যের মধ্যে ৭ জনই অজ্ঞাত এই বিরল পঙ্গুত্ব রোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। পরিবারের সদস্যরা বাল্যকালে সুস্থ্য স্বাভাবিক থাকলেও যৌবনে পদার্পণ করার পর ধীরে ধীরে এই অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়। প্রথমে শরীরের মাংসপেশি শুকিয়ে গিয়ে ধীরলয়ে বলশক্তিহীন হয়ে পড়েন তারা। অসচ্ছলতার কারণে পর্যাপ্ত চিকিৎসাবিহীন ওই পরিবারের দিকে সরকারী বেসরকারী কেউই বাড়িয়ে দেয়নি সাহায্যের হাত।

জানা যায়, প্রায় অর্ধশতাব্দি আগে ওই পরিবারের চার সন্তানের মা শাবজান বেগম হঠাৎ করে অসুস্থ্য হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। পরবর্তীতে তার সন্তানদের মধ্যেও একই রোগ পরিবাহিত হয়ে তিনি ও তার মেঝ সন্তান মারা যান। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ওই পরিবারে অন্য পরিবার থেকে আসা বধূরা ছাড়া বাবা ছেলে মেয়েসহ ৭ জন সদস্যই পঙ্গুত্ব নিয়ে অসহায়ভাবে দিনাতিপাত করছেন। অজ্ঞাত রোগভোগী তিনভাই ও তাদের সন্তানেরা পাড়ার মোড়ে সামান্য মুদি দোকানদারী করে জীবিকা নির্বাহ করেন। নিজেদের অচল জীবনের ভারী বোঝা বয়ে নেবার অন্যকোনো উপায় তাদের জানাও নাই। তাছাড়া ভালো ডাক্তার দেখাবেন এমন উপায় কোনোদিনই পাননি তারা। তাই কবিরাজের চিকিৎসাকে ভরসা করেই নিয়তিকে বরণ করে নিতে হয়েছে তাদের।
তাদের মনে এই বিশ্বাসের কুসংস্কার পোক্ত হয়েছে যে, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সাঁঝের বেলায় নিজের অসাবধানতায় তাদের মায়ের ওপর জিন আছর করেছিল। সেকালের সেই অভিশপ্ত জিনের নির্মমতা কাটানোর উপায় তাদের জানা নাই। জিনতত্ত্ব বা বংশবৈশিষ্ট্যের খবর যাদের জানা নাই তাদের সংস্কারের জিনকে বরণ করা ছাড়া অন্যকোনো গতি থাকবার কথাও না। তাই নিজেদের অসহনীয় যন্ত্রণায় কারো কোন সাহায্য পাবেন এমন আশা ছেড়ে দিয়ে কেবল ঈশ্বরের করুণা কামনা করে যান তারা।

এসব চলৎশক্তিহীন মানুষদের বহনের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তৈরী করা হয়েছে দুইটি তিন চাকার বাহন। আর তাদেরকে এখানে সেখানে গমনাগমনে গাড়ি টানার দায়িত্বটি সযতনে পালন করে যাচ্ছেন পরিবারের সুস্থ্য গৃহবধূরা। সরকা্রী বা বেসরকারী কোনো সাহায্য সংস্থা এখন পর্যন্ত তাদের জন্য কয়েকটি হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন বোধ করেনি।

দীর্ঘদিনেও সরকারী বা বেসরকারী পর্যায়ে কেউই এ রোগাক্রান্তদেরকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেননি। তাই ওই পরিবারে দিন দিন বাড়ছে পঙ্গুত্ব বরণকারীর সংখ্যা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই বিরল রোগটি দেখা দিলেও ওই পরিবারের সর্বশেষ প্রজন্ম ৭ বছরের সিয়াম বা ৩ বছরে নাইমুলের হাঁটাচলা নিয়ে এখনই সন্দিহান তার পঙ্গুত্ব বরণকারী স্বজনরা। তাদের ছোট্ট ছেলে দু'টিও একটু আগেভাগেই তাদের পিতা বা মাতামহীর পদাঙ্ক অনুসরণ করছে কিনা এই ভাবনায় প্রায়শ তাড়িত হন বাবা মায়েরা।

রোগটি ক্রোমোজমাল ডিসঅর্ডার বলে চিহ্নিত করে চিকিৎসকরা বলছেন, Genetic testing and Genetic counseling is recommended for that family. Only the results of Genetic test can confirm or rule out a suspected Genetic Condition and help determine a person's chance of developing or passing on this disorder. এই অবস্থায় রোগীদের পুরোপুরি ভাল করা সম্ভব না হলেও তাদের জন্য পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে ডাক্তারদের অভিমত।

বিরল রোগাক্রান্ত অসহায় ওই পরিবারের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে সহৃদয়বান কেউ এগিয়ে আসবেন এমনটা প্রত্যাশা করেন ওই পরিবার ও এলাকাবাসী। আপনি যদি হন গবেষক, চিকিৎসক অথবা নিভৃতচারী দাতা, তবে এই সাধু পরিবারের প্রতি আপনার মানবিক হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন। মিস্টিক কবি লালন ফকিরতো বলেই গিয়েছেন, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/ মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০৫ এপ্রিল ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous.bd
twitter.com/fardeenferdous

এ বিষয়ে টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদের ইউটিউব লিংক: