বাংলা ব্র্যান্ড মুস্তাফিজুর রহমান

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 26 April 2016, 01:42 AM
Updated : 26 April 2016, 01:42 AM

আমরা যেখানে দু' চারটে ইংরেজি শব্দ বলতে পারলে নিজেকে জাতে তুলতে পেরেছি মনে করে আত্মম্ভরিতায় ভুগি, সেখানে আমাদের ক্রিকেটের লিটল জিনিয়াস মুস্তাফিজুর রহমান পুরো পৃথিবীকে বাংলা শিখিয়ে ছাড়ছেন। একেই বুঝি বলে নিজের সত্যিকারের জাত চেনানো।

অল্প কিছুদিনই হলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের নাম লিখিয়েছেন সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত গ্রাম তেঁতুলিয়ার বামহাতি পেসার মুস্তাফিজ। ইতোমধ্যে ক্রিকেট বিশ্বে যিনি ম্যাজিক্যাল বয় নামে স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন। ইংরেজ কবি জন মিল্টন যেমনটি বলেছেন, 'The Childhood shows the man, As morning shows the day.' এই কথার সুর ধরেই যেন বিশ্বের একমাত্র খেলোয়ার হিসেবে তিনি তাঁর প্রথম দুই ম্যাচে এগারোটি উইকেট লাভ করে বিশ্ব পরিমন্ডলে নিজের যাত্রার ভিত তৈরি করে নিয়েছিলেন। এরপর একের পর এক ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছেন। দিনের পর দিন নিজেকে মেলে ধরছেন আর তাঁর নিজস্ব বাংলা ব্র্যান্ডকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিচ্ছেন মাত্র ২০ বছর বয়সী মুস্তাফিজ। এরমধ্যে যাঁর আদুরে নাম হয়ে গেছে ফিজ।

এই বিস্ময় বালক সদ্যই নাম লিখিয়েছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগে। দল পেয়েছেন হায়দরাবাদ সানরাইজার্স। এবং এরই মধ্যে নিজের যোগ্যতা ও প্রতিভায় পুরো আইপিএলকেই মুগ্ধতায় ভাসাচ্ছেন।


অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ডেভিড ওয়ার্নার যিনি কিনা হায়দরাবাদ সানরাইজার্সের কিপার, নিজের ব্যাটিং এর কথা ভুলে তাঁর মুখে সারাক্ষণ চলছে মুস্তাফিজ বন্দনা। কারণ ইতোমধ্যে হায়দরাবাদের প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছেন মুস্তাফিজ। ওয়ার্নারের ভাষায়, 'মুস্তাফিজ সবসময় বলে, নো প্রবলেম বোলিং, টকিং অ্যান্ড ব্যাটিং প্রবলেম!

মানে হলো আমাদের মুস্তাফিজ ততটা ইংরেজি বলাটা এখনও রপ্ত করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর এই ভাষার ব্যারিয়ারটাকেই বাংলা ভাষা তথা বাংলাদেশকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। মুস্তাফিজের এখনকার কোচ, অধিনায়ক, মেন্টর, দলের সতীর্থ বা ভিনদেশি ভক্তরা রীতিমতো বাংলা শিখতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ভাবখানা এরকম যে, তুমি তোমার খেলাটা চালিয়ে যাও, ভাষাটা আমরা নিজ দায়িত্বে বুঝে নেব।

প্রতিটি ম্যাচেই ধারাভাষ্যকারদের প্রশংসায় ভাসতে ভাসতে অভিধানের বিশেষণ নিঃশেষ করে ফেলছেন মুস্তাফিজ। ম্যাজিক্যাল, মিস্ট্রিয়াস, ম্যাগনিফিসেন্ট, আনরিয়েল, আমুদে চমৎকার, আজিমুশ্বান শাহানশাহ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর বলবেনই না কেন, মুস্তাফিজের পিঠে সওয়ার হয়ে হায়দরাবাদের জয়রথ যে এগিয়েই চলছে। এখন পর্যন্ত আইপিএলে পাঁচ ম্যাচে মাঠে নেমে মুস্তাফিজ দিয়েছেন মাত্র ১১৫ রান। ওভারপ্রতি গড় ৫.৭৫। উইকেট পেয়েছেন ৭টি। মুস্তাফিজ নিজেকে কান্ডারি হিসেবে প্রমাণ করে চলেছেন বারবার।

খুব স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচ শেষে সবকথার আগে অধিনায়ক ওয়ার্নারকে বলে নিতে হয়, মুস্তাফিজের মতো প্রতিভা ক্ষণজন্মা। বিরল। বাংলাদেশের সৌভাগ্য, এই প্রতিভা অন্য কোনো দেশ নয়, পেয়েছে বাংলাদেশ। ভিন্ন ভিন্ন গতিতে বল করতে পারা আর বিভিন্ন গোপন অস্ত্রের ব্যবহার এক কথায় অসাধারণ! মুস্তাফিজের মতো প্রতিভা পেয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতেই পারে।'

২৩ এপ্রিল শনিবার কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে প্রথম ৯ বলে কোনো রান না দিয়ে তাঁর উইকেট তুলে নেওয়ার ঘটনাটিও আইপিএলের ইতিহাসে প্রথম ঘটল। প্রথম ১২ বলের ১১টিই ডট। তিন ওভার শেষেও নামের পাশে রান মাত্র ৩। ইনিংসেও নিজের শেষ ওভারটায় দিলেন ৬ রান, নিলেন আরও এক উইকেট। সব মিলিয়ে চার ওভার বল করে সতের বলই ডট, মাত্র ০৯ রান খরচে তুলে নিলেন মূল্যবান ০২ উইকেট। এবং সর্বোপরি দলের জয়।

এমন মুস্তাফিজের সম্মানে বাংলা ভাষাটা এখন বিশ্ব লিজেন্ডদের শিখতেই হচ্ছে। কারণ মুস্তাফিজের মতো বিরল প্রতিভার ভাষা বোঝার আশা জলাঞ্জলি দেয়ার কথা কেউ মাথাতেই আনতে পারছেন না। অতএব মুস্তাফিজের কল্যানে বাংলা এখন সর্বত্র আলোচিত। খেলা শেষে উপস্থাপকরাও সুন্দর করে বাংলায় কিছু বলবার অনুরোধ করছেন। আর আমাদের মুস্তাফিজও নিজের মাতৃভাষা বাংলাতেই জানিয়ে দিচ্ছেন, 'সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। গেমটা অনেক ভালো হয়েছে। সবাই অনেক উপভোগ করেছেন'।

এমনকি মুস্তাফিজের জন্য তাঁর দল দোভাষী রেখে দিলেও সে ধার কেউ ধারছেন না। বরং মুস্তাফিজের সম্মানে ভাঙা ভাঙা বাংলাতেই মধুর প্রশংসায় টুইট করছেন, মুডি, ওয়ার্নার ও লক্ষ্মণরা। কোচ ও অধিনায়কের পথ ধরে মুস্তাফিজের জন্য এখন বাংলা শেখার ধুম পড়েছে। এমনকি ভারতীয় মিডিয়া মুস্তাফিজকে বুঝতে নিজেদের হাউজে বাংলাভাষীদের পর্যন্ত নিয়োগ দিচ্ছে! হায়দরাবাদের অনেক অবাঙালি সমর্থকও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলায় এক-দুটি শব্দ পোস্ট করছেন।

হায়দরাবাদ দলের মেন্টর ভি ভি এস লক্ষ্মণ যখন অর্ধেক ইংরেজি ও অর্ধেক বাংলায় টুইট করেন, 'হি ইজ উজ্জ্বল ও আমুদে' অথবা মুস্তাফিজের মুখে কেক মাখিয়ে দেওয়ার ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে ক্যাপশন লিখেন, 'ফিজের জন্য কেক উদ্যাপন! ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়ার জন্য মুস্তাফিজ তোমাকে অভিনন্দন। কী অসাধারণ পারফরম্যান্স!'- আমরা তখন গর্বিত হই বটে। শহীদ রফিক সালাম বরকত জব্বারের বাংলা ভাষাটাকে ভিনদেশিদের কাছে কীভাবে পৌঁছে দিয়েছেন আমাদের মাথার মুকুট বিস্ময় বালক মুস্তাফিজ!

আমাদের নারী ক্রিকেটার সালমারা পাকিস্তানে খেলতে যেয়ে উর্দু বলে সমালোচিত হন। কিংবা আমাদের ট্যালেন্টেড ক্রিকেটার তামিম ইকবালের ইংরেজি ভাষা নিয়ে রমিজ রাজারা টিপ্পনি কাটেন। সবকিছু ছুড়ে ফেলে আমাদের মুস্তাফিজ নিজের গুণে বাংলাভাষাকেই বরং ওপরে তুলে ধরে যেন বলেন, বাংলা আমার অহংকার। বাংলা আমার মায়ের ভাষা। তোমরা বরং ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি বাদ দিয়ে আমার বাংলার রসাস্বাদন করো। সেইক্ষণে আমি খেলায় মনোযোগ দেই। ভাষা নয়, কথা নয়, বলের বৈচিত্রে প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করে ধরাশায়ী করাই আমার আসল কাজ।

আমাদের এই বাংলা ব্র্যান্ড মুস্তাফিজুর রহমানের অনারে আমরা বরং কবি আব্দুল হাকিমের 'বঙ্গবাণী' স্মরণ করতে পারি। যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ/ সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন। অবশেষে বিশ্বপ্রভু মুখ তুলে চেয়েছেন। বাংলা ভাষাটা সবাই বুঝে চলেছেন। এভাবে জিনিয়াস মুস্তাফিজদের হাত ধরে আমার প্রাণের বাংলার জয় হবেই।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
২৬ এপ্রিল ২০১৬
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous.bd