ঈদযাত্রায় মহাসড়কে যানজটের ভোগান্তি

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 22 June 2016, 05:32 PM
Updated : 22 June 2016, 05:32 PM

প্রতি ঈদেই রাজধানীর চতুর্পাশে মহাসড়কগুলোর প্রবেশমুখে অসহনীয় যানজটে নাকাল হন ঘরমুখো বা রাজধানীতে ফেরা সড়ক ব্যবহারকারীরা। বিশেষ করে গাজীপুরের ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যাত্রী ভোগান্তি চরমে ওঠে। অসহনীয় যানজটের বিড়ম্বনায় পড়ে শেষ সময়ে গন্তব্যে যাত্রাকারীদের অনেককেই ঈদ উদযাপন করতে হয় রাস্তাতেই। এবার পহেলা রমজান থেকেই এই দুটি মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে মারাত্মক যানজটে নাকাল হচ্ছেন সড়ক ব্যবহারকারীরা। মহাসড়কের অবস্থা বেহাল না হলেও এবার ঈদের আগেই যানজটের মূল কারণ রাস্তা সংলগ্ন ফুটপাথ দখল ও সিটি করপোরেশন কর্তৃক বর্জ্যের ভাগাড় হিসেবে মহাসড়কের অবৈধ ব্যবহার। এমন পরিস্থিতিতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মহাসড়ককে অবৈধ দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর সিদ্ধান্তের কথা জানালেও বাস্তবতা পুরোটাই ভিন্ন।

মহাসড়কে ধারাবাহিক যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ ব্যাটারি ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা এবং অবৈধ লেগুনা। তার ওপর সড়কের দু'পাশে দখল ও আবর্জনার স্তুপ সড়ককে সংকুচিত করে ফেলায় এ যানজট দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সিটি করপোরেশন ও সড়ক বিভাগের আশ্বাস থাকলেও তা কাজে আসছে সামান্যই। উপায়ন্তর না পেয়ে যানজটের ভোগান্তি লাঘবে জনসচেতনতার দিকেই জোর দিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

দেশের উত্তরাঞ্চলের একুশ জেলার সাথে রাজধানীর যোগাযোগের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করছে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর অংশ। প্রতি ঈদেই রাজধানী থেকে উত্তরবঙ্গগামী ঘরেফেরা লাখো মানুষের চরম ভোগান্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে চন্দ্রা, সফিপুর, কোনাবাড়ি, ভোগড়া বাইপাস, চান্দনা চৌরাস্তা ও টঙ্গি স্টেশন রোডসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্ট। এবার পহেলা রমজান থেকেই এই মহাসড়কের চন্দ্রা, কোনাবাড়ি ও ভোগড়া এলাকায় প্রতিদিনই মারাত্মক যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে কোনাবাড়ির এক কিলোমিটার এলাকা পার হতে ক্ষেত্রবিশেষে দুই ঘন্টারও বেশি সময় লাগছে। সড়কের অবস্থা বেহাল না হলেও এই যানজটের মূল কারণ ফুটপাথ পুরো দখল হয়ে যাওয়া এবং কড্ডা এলাকায় মহাসড়ককে দেশের সবচে' বড় গাজীপুর মহানগরের বজ্যের্র ভাগাড় বানিয়ে ফেলা। সেখানকার ময়লা আবর্জনা রাস্তায় সয়লাব হয়ে গিয়ে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাশাপাশি এলাকায় ঘটিয়ে চলেছে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ। ওই সড়কের আশপাশের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বর্জ্যের দুর্গন্ধে তাদের এলাকায় টেকা দায় হয়ে পড়েছে। পরিবেশ দূষণের ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা এখানকার মানুষদের প্রশ্ন, পৃথিবীর আর কোন এমন দেশ আছে যেখানে মহাসড়কের ঠিক ওপরে শহরের নোংরা বর্জ্য এনে ফেলা হয়?


এছাড়া গাজীপুরের বিভিন্ন পয়েন্টে সড়কের পার্শ্ববর্তী ফুটপাথ দখল করে বাসানো হয়েছে মওসুমী ফলের বাজার। বাজারের বর্জ্যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা আটকে গিয়ে অল্প বৃষ্টিতেই সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। আর এসবের যোগফল মহাসড়কে দীর্ঘস্থায়ী যানজট। এই পরিস্থিতির উত্তরণ না ঘটলে ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি কী পর্যায়ে পৌছবে তা অকল্পনীয়।

মহাসড়কে ক্রমবর্ধমান যানজট ভোগান্তির এমন বাস্তবতায় রমজান শুরুর আগে গেল ৮ জুন চন্দ্রায় মহাসড়ক পরিদর্শনে এসে সড়ক পরিবহন ও সেতুবিভাগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, যেকোনো মূল্যে সড়ককে অবৈধ দখলদারমুক্ত করতে হবে-এটাই সরকারের কঠোর সিদ্ধান্ত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মন্ত্রীর কথা স্রেফ কথার কথা হয়েই থেকেছে। তার ওপর ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়কে চারলেনে উন্নীতকরণ কাজ চলমান থাকায় এবারের যানজট পরিস্থিতি বিপর্যয়পূর্ণ হতে পারে বলে আশঙ্কা সবার। অবশ্য সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নতুন সড়কের জন্মযন্ত্রণা যাত্রীসাধারণকে মেনে নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন।


৩২৯ দশমিক ৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠন করা হয় ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি। গেল তিন বছর ধরেই মহানগরের ২৫ লাখ মানুষের প্রাত্যহিক বর্জ্যে ব্যস্ত মহাসড়ক সয়লাব করা হলেও নগর কর্তৃপক্ষ বলছে ভিন্নকথা। এবার রমজানের আগে মন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে সড়কে আবর্জনা ফেলা বন্ধ করা হয়েছে এবং অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে প্রতিদিনই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা কে এম রাহাতুল ইসলাম। অন্যদিকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ফুটপাথ থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের মাধ্যমে যানজট নিরসনে প্রশাসনের সকল বিভাগের সাথে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ।

কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, মহাসড়কের আবর্জনা আগের মতোই আছে এবং ফুটপাথের দোকানদারদেরও কেউ সরাতে পারেনি।
প্রতি ঈদের আগেই মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে সড়ক ও জনপথের তরফে লোকদেখানো কিছু সংস্কার কাজ করা হয়। এবারও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের সবচে' যানজটপ্রবণ এলাকা চন্দ্রায় সড়ক সংস্কারের কাজ করতে দেখা গেছে। কিন্তু এই সংস্কার কাজ কেন আগেভাগে শুরু করা যায় না- এমন প্রশ্ন সড়ক ব্যবকারীদের।

মহাসড়কের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ছত্রছায়ায় বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ তিনচাকার যানবাহনের স্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। এই অবস্থায় ট্রাফিকিং ব্যবস্থা সচল রেখে ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সড়কের দু'পাশে অবৈধ দখলমুক্ত, আবর্জনা অপসারণ করার পাশাপাশি তিনচাকার যানবাহন মুক্ত করার দাবি ট্রাফিক পুলিশ ও পেশাদার চালকদের।


যানজট পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ঢাকার চতুর্পার্শ্বে ঈদের আগে ১৬টি বহির্গমনে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি ১ হাজার স্বেচ্ছাসেবক থাকার কথা জানিয়েছে সড়ক বিভাগ। তবে অতীতে অভিজ্ঞতার আলোকে সড়ক বিভাগ ও সিটি করপোরেশনের এসব আশ্বাসেও ঈদে যানজট বিড়ম্বনা থেকে সংশয়মুক্ত হতে পারছেন না সাধারণ মানুষ।
তবে গাজীপুরের মহাসড়কে অব্যাহত যানজটের বিষয় স্বীকার করে প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনা বাড়ানোর দিকে জোর দিয়েছেন গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে পাড়ায় পাড়ায় সচেতনাতামূলক কর্মসূচি শুরু করার পাশাপাশি নিজের দলের কেউ এসব অপকর্মে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও আইনের কঠোর প্রয়োগ করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন এই জনপ্রতিনিধি।

সড়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক সড়ক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএ কর্তৃক মোটর ভেহিকল অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ এর যথাযথ প্রয়োগ, ফিটনেসবিহীন যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ, ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক চালকদের গাড়ি চালানো থেকে নিবৃত করা, ফুটপাথ অবৈধ দখলদারমুক্ত করা, যথার্থ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, চালকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, সুশৃঙ্খল পার্কিং, নিয়মতান্ত্রিকভাবে ট্রাফিকিং ব্যবস্থা প্রয়োগ করা এবং সর্বোপরি সড়ক ব্যবহার বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো গেলে মহাসড়কে যানজট পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে থাকতে পারে এবং সড়ক দুর্ঘটনাও অনেকাংশে রোধ করা যেতে পারে। তা না হলে এসব কিছু সামাল দিয়ে এবার ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নির্বিঘ্ন হবে এমন ভাবনা দূরাশাতেই পর্যবশিত হতে পারে।

প্রতি ঈদে কম করে হলেও অন্তত ৫০ লাখ মানুষ রাজধানী ঢাকা ছেড়ে যান। এসময় মহাসড়কে বাড়তি মানুষের চাপ ও উদ্ভূত নানামুখী অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সামলাতে প্রশাসনিক নজরদারি ও নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবি সড়ক ব্যবহারকারীদের। সবার সমন্বিত উদ্যোগে সাধারণের জন্য মহাসড়ক না হয়ে উঠুক যন্ত্রণা ও ভোগান্তির অপর নাম। ঘরে ফেরা মানুষের ঈদযাত্রা না হোক নিরানন্দে ভরা। কিন্তু গতানুগতিক প্রথায় বিশ্বাসী অনাধুনিক, পশ্চাৎপদ ও হামবড়া প্রশাসন কি সাধারণের কথা মাথায় রাখবেন?

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
২২ জুন ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous.bd
twitter.com/fardeenferdous