গরুর হাটের কথকতা…

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 10 Sept 2016, 06:29 AM
Updated : 10 Sept 2016, 06:29 AM

বিদ্যালয়ের বর্ষিয়ান পন্ডিত মশাই আর্ট ক্লাসে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের গরু আঁকতে দিলে সবাই এঁকে খাতা জমা দিল। কিন্তু পল্টু জমা দিল একটা খালি কাগজ।
পন্ডিত মশাই ফাঁকা কাগজ দেখে চটে গিয়ে বললেন:
-এটা কী এঁকেছিস?
-স্যার ঘাস এঁকেছিলাম, পল্টু জবাব দিল।
এবার পন্ডিতের পাল্টা প্রশ্ন:
-ঘাস কই?
-স্যার, গরুতে খেয়ে ফেলেছে।
-তাহলে গরু কই?
-স্যার, গরু তো ঘাস খেয়ে চলে গেছে!

তবে পল্টুর গরু ঘাস খেয়ে চলে গেলেও কোরবানীর হাটের গরুদের উপযুক্ত ক্রেতা ব্যতীত কোথাও চলে যাওয়ার জায়গা নেই। কোরবানীর ঈদের আগে বাড়ির আনাচে-কানাচে, সড়কের উপরে, ফুটপাথে, চিপা গলিতে, ফসলের জমিতে পশুর হাট বসে যায়। এসব হাটের প্রধানতম চরিত্র বিচিত্র বর্ণের গরু। লাল, সাদা, কালো, চক্রাচক্রি, শিয়াল রঙা, তামাটে বর্ণ বা ম্যাটম্যাটা জাতীয় রংবেরঙের এসব গরুদের পদচারণায় মুখর থাকে প্রতিটি গরুর হাট। বিরাট গরুর হাটে বিরাট বিরাট গরু পাওয়া যাক বা না যাক, গরুর মালিক, ব্যাপারী, ক্রেতা, ইজারাদার, ডাক্তার, পুলিশসহ নানা ঢঙ্গের মানুষের মিলনমেলা এই গরুর হাটগুলো।

গরুর হাটে গ্রামীণ মালিক ময়লা ছেড়া জামা পরিহিত থাকলেও গরুকে সাজানোয় কোনো কমতি রাখেন না। স্বচ্ছ জলে স্নান সমাপনান্তে গরুর শিঙে তেল চকচকে রঙ মেখে গলায় মালা ঝুলিয়ে তবেই হাটে এনে উপস্থিত করা হয় গরু ভাই কে। গরুর মালিক তার পালিত জন্তুকে পুত্রবৎ আদর স্নেহ করেন বলেই সকল গরুই আমাদের ভ্রাতা। হাটে এসে গরম লাগলে এই ভ্রাতাদেরকে রীতিমতো পাখা দিয়ে বাতাস করা হয়। জ্বর আসলে কলাপাতায় মুড়িয়ে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট পর্যন্ত খাওয়ানো হয়। এসব গরু ভাইয়ের বাবারা নিজেদের দিকে তাকানোর সুযোগ খুব কম পেলেও নিজের কোরবানীর পুত্রকে দেখভালে কোনো খামতি রাখেন না। একেকটি গরুর পেছনে দু'চারজন মনুষ্যপ্রাণি পাহারায় থাকে। হাটে আসতে না চাইলে নাক ছিদ্র করে নাকা লাগিয়ে রীতিমতো টেনে হিঁচড়ে গরুকে পসরা সাজিয়ে খদ্দেরের সামনে উপস্থাপন করা হয়। গরু ভাই এদিক সেদিক করেছে তো নাকা ধরে দেয়া হয় টান। গরু চুপচাপ। নাক তার বড়ই স্পর্শকাতর অঙ্গ। ত্যাড়ামো করলে ব্যথা বাড়ে আর সুবোধ বালকের মতো থাকলে খানিকটা আদর আপ্যায়ন জুটে বটে। বিক্রির পর অবশ্য অন্য কথা। নির্বোধ বেচা গরুর কোনো দাম নাই তার পালক বাপের কাছে। আর বুদ্ধিমান মনুষ্য ক্রেতারও ওকে দিয়ে কাজ নেই রসনাতৃপ্ত করা ছাড়া। গরুর গায়ে যে শক্তি, যদি বুদ্ধি করে মানুষের নাকে নাকা পরানোটা শিখে যেত, তবে ওর জায়গায় মনুষ্যরাই থাকত।


বহুরিয়াচালার ফজল মিয়া নিজের এই গরুটির দাম হেঁকেছেন সাড়ে তিন লাখ টাকা।

গরুর হাটের ক্রেতার হাবভাবও দেখবার মতো। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া এলাকার মাতবর, মেম্বার বা চেয়ারম্যান সাহেবরা লুঙ্গির গিঁঠে টাকা ভরে চ্যালাচামুন্ডাদের সাথে নিয়ে গরু ভাইদের কিনতে আসে। সবচেয়ে দামী, সবচে নাদুস-নুদুস এবং শাহরুখ খানের মতো দেখতে সুদর্শনটাই তাদের পছন্দ। এলাকায় একটা মান-সম্মান আছে না। সবার চেয়ে দামি গরু না হলে মানুষের কাছে মুখ দেখানো যাবে? অহংকার ফলানো যাবে? আর সেই যে কাঁচা টাকাওয়ালা ঘুষখোর চাকুরে, পাবলিক ঠকিয়ে সরকারী টাকা মেরে দেয়া ঠিকাদার কিংবা উঠতি কারবারী -ওঁরা অবশ্য গরু কিনতে হাটে যাওয়ার খুব একটা সময় বের করতে পারেন না। ওঁরা খুব ব্যস্ত থাকেন কিনা! ওঁদের হয়ে নিজেদের ভাবশিষ্যরাই ও কাজটি সেরে রাখে।

গরুর হাটের আরেক বিচিত্র চরিত্র ইজারাদার। ক্ষমতাসীন দল করলেই কেবল এই কোটি টাকার বাণিজ্যের মওকা মেলে। গরু বেচে লাভ হোক কিংবা লোকসান। নির্ধারিত হাশিল শোধ করতে আপনাকে বাধ্য করা হবে। এক টাকাও মাফ-মুক্তি নাই। অন্যের বেচা গরুর মূল্য থেকে পাওয়া দালালি দিয়েই তো ওঁদের বিরাট কোরবানির বন্দোবস্ত হবে। সেখানে গরুর ব্যাপারি যদি গরুরও আগে একটু কোরবানি হয়েই যান -এটা আপনাদের মানতে হবে বৈকি!

আর যে এককোণায় বসা ডাক্তার সাব গরু ভালো না মন্দ, দেশি না বিদেশি, মোটা তাজাকরণ ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়েছে নাকি হয়নি বা ইনজেকশন দেয়া নাকি না দেয়া -তা পরীক্ষা করবার কথা। তিনি পরীক্ষা করেই যাচ্ছেন তো যাচ্ছেন। তাঁর পরীক্ষার নাম নির্বিকার নিরীক্ষণ। হাটের গরুতে কোনো সমস্যা নাই। সব সার্টিফাইড এ প্লাস।

তবে যাই বলি গরুর হাটের যে সৌন্দর্য -তা পৃথিবীর আর কোথায় মিলবে? দাম যাই হোক। পছন্দসই গরু মিললে দাদা আর নাতি মিলে তা বাড়িতে নিয়ে এসে এক দু'দিন যে যত্নআত্তি করে -তা কোনো মানুষকেও করা হয় না। মনে রাখতে হবে এসব গরুর চেয়ে বাসার কাজের মেয়ে, গরীব প্রতিবেশি, বাড়ির ফুটফরমাশ খাটা আব্দুল, এলাকার অসহায় মানুষের দাম কিন্তু অনেক কম। কারণ গরীব মানুষকে তো আর ঈদ উপলক্ষে নতুন কেনা ডিপ ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে বছরব্যাপী রসনার সেবায় ব্যবহার করা যাবে না। দুইদিনের আদরে থাকা গরু ভাইটি যদি এই বিষয়টা বুঝত, তবে হাসত না কাঁদত এটা জানি না -মানুষ হয়ে জন্ম না নিয়ে জীবন সার্থক হয়েছে এটা ভেবে নিশ্চিত গর্ব বোধ করত কোরবানীর গরু ভাইয়েরা।
হাটের ক্যারিক্যাচার শেষে তারপর যুগ যুগ ধরে চলে আসা সেই কমন জোকসটা আমাদের সবার জীবনে সত্যি হয়ে যায়।
-কিরে তুই গরু না ছাগল?
-ছাগল, তুই?
-আমি গরু।
এভাবে একজন অন্যকে গরু-ছাগল বানিয়ে বেশ আনন্দ পেলেও সেই গরুকে হাটে উঠানো হয় একটাই উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের দেখানো পথে একে ত্যাগ করতে হবে তাই। হাটের গরু দেখতে যতোই সুশোভন হোকনা কেন, ত্যাগের মাঠে দেখতে বড়ই পীড়াদায়ক। রশি ও বাঁশ দিয়ে বেঁধে জোর করে শুইয়ে মৌলভী সাহেব ছওয়াবের আশায় হাসতে হাসতে এমনকি শিশুদের সামনেও একের পর এক গরু ভ্রাতাদের গলায় যখন বড় ছুড়ি চালান, গরুর গলার ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে কিংবা চিৎকার করে -তা দেখে সহ্য করতে হৃদয়ের পাটা বেশ শক্ত হওয়া দরকার। আমরা সর্বপ্রাণবাদী মানুষ হিসেবে একটা ছোট্ট পিপীলিকার মরণও সহ্য করতে পারি না। সেখানে পরম আদরের গরু ভ্রাতা? আসলে ঈশ্বর হয়ত এটাই চান যে, প্রিয়জনের জন্য আমাদের বেশ কষ্ট লাগুক। কষ্টের মধ্য দিয়ে যেন বিমোক্ষণ লাভ করি।

সে যতই বলা হোক না কেন যে বেশি বেশি প্রাণি হত্যার মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ উস্কে দেয়ায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এইজন্য সবার নিরামিষভোজী হয়ে উঠতে হবে। কিন্তু প্রিয়জনের মাংসের যে সুস্বাদ তার তুলনা কি বিস্বাদ সবজিতে মিটবে? তাছাড়া গরু খামারির অর্থনীতিটাও আমাদের দেখতে হবে বৈকি। বুঝতে হবে গরু থেকে যদি চামড়া না পাওয়া যায়, তবে জুতো-ব্যাগ কেমনে হতো? কিংবা জীবন বাঁচানো ক্যাপশুলের কভারটা কেমনে হবে যদি গরুর হাড় না মিলে?

প্রতিটি কোরবানির ঈদ আসার আগেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সাহেবরা টিপস দেন, গরুর মাংসের উপকারিতা, গরু খেলে কী হয়? গরুর মাংসের ক্ষতি কতোটা, গরুর মাংস বেশি খাওয়া ভালো নয়, কতটুকু পরিমাণ মাংস খেতে পারবেন, বয়স হলে লাল মাংস বর্জনই বুদ্ধিমানের কাজ, ইত্যাদি। নেটের যুগে পাঠক এসব পড়তে গিয়ে হতভম্ব বা হতবুদ্ধি হয়ে যান, আসলে গরু খাবেন, নাকি খাবেন না। কেউ প্রথমে লিখেন গরুতে প্রোটিন, জিংক, ফসফরাস ও আইরনে ভর্তি। শরীরের জন্য যা অতীব জরুরী। আবার কেউ লিখেন গরু ভরা খালি কোলস্টেরল, সোডিয়াম ও ফ্যাট। বেশি খেয়েছেন তো আজরাইল সাহেব দোরগোড়ায় হাজির হতে বেশি সময় নিবেন না। তাই সিদ্ধান্তটা নিতে হবে ভেবে চিনতে, খাবেন, তবে পরিমিত। পরিমিতিটা একধরণের আর্ট। এই আর্ট রপ্ত করা প্রতিটি মানুষের অবশ্য কর্তব্য। গরুরা হাটে যেমন সুন্দর সুদর্শন। তেমনি আপনার জীবনেও গরুর ভূমিকাটাকে সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ করতে দিন। সিদ্ধান্তটা একান্তই আপনার।
………………
ছবিগুলো গাজীপুরের ভাওয়াল মির্জাপুর হাট থেকে সম্প্রতি তোলা।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous
twitter.com/fardeenferdous