দুর্গাপূজা: সার্বজনীন মাঙ্গলিক শারদোৎসব

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 6 Oct 2016, 07:14 PM
Updated : 6 Oct 2016, 07:14 PM


রূপসী বাংলার রূপ বদলের চক্রে আকাশ নীলে যখন সাদা মেঘেদের বিচিত্র কারুকাজ, ভূমিতে কাশফুলের শ্বেত শুভ্রতা আর জলাধারে সমাপনী বর্ষার পুতঃপবিত্রতা -আশ্বিনের ঠিক এমন সময়টাতে শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত সর্বমঙ্গলা, জগদ্বাত্রী ও মাতৃরূপা দেবী দুর্গা তাঁর সন্তান ও সতীর্থদের নিয়ে ধরিত্রীতে পা রাখেন। বিশ্বাসী পূজারি আর মৃৎশিল্পীর অনৈর্বচনিক নিষ্ঠা ও ধ্যানে করুণাসিন্ধু দেবী তাঁর অধিষ্ঠান নেন মানবীয় মন্ডপে। সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রতিটি বাঙালির হৃদিমন্দিরে বাজে সুমঙ্গল শঙ্খ। শত মঙ্গলশিখায় আলোকিত হয় চারিধার। উঠে নির্মল ফুলগন্ধ। সবশেষে বিসর্জনে দেবী বিদায়ে ভক্তের হৃদয়ে উঠে তোলপাড় বিয়োগব্যথার সকরুণ নিনাদ। সেই অশেষ কারুণ্যের রেশ ধরেই তো ফি বাৎসরিক বিমোক্ষণে পূজারির অস্থির ও চঞ্চল মন হয় সুস্থির আর আগামীর পথচলা হয় সুশান্তির।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটা লেখেন-
'আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি
পুজোর সময় এল কাছে'।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস এরূপ যে, মাতৃরূপে ঈশ্বরের আরাধনা করা চাই। ঈশ্বর সব জীবের মা হয়ে বিরাজ করেন। আর সকল দুঃখের ভরসাস্থল ও মমতার আঁধার সেই মায়ের আরাধনায় সন্তানের নির্বাণ লাভের মোক্ষম সুযোগ কে হারাতে চায়? চিত্তের একাগ্রতায় মাতৃরূপা দেবী দুর্গা তাই ভক্তের সবচেয়ে প্রিয়জন। তাঁর আগমনীতে বর্ণিল উৎসব তাই জনমানুষ ও জনপদে।

একালের পন্ডিতরা পুরাণকথার দেবী ও অসুরদের মহারণের সমস্তটাকেই রূপক কল্পনা বলে মানলেও ভক্তের বিশ্বাসে আছে, মহাজগতের অন্তরালে আছেন এক মহাশক্তি। যিনি মহামায়া। সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশ বা সকল অশুচিতা দূরীভূত করতে দেবীশক্তি মহামায়ার পূজা-অর্চণা অনিবার্য।
সেই অনিবার্যতার ধারাপাতে ঘরে ঘরে শ্রীশ্রীচন্ডী কিংবা কৃত্তিবাসী রামায়ণ পাঠের সুরসৌরভে পৌরাণিক দেবী হয়ে উঠেন চিরজাগরুক আপনার জন। ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের আকাক্সক্ষাটা দেবী বন্দনার পরম আধ্যাত্মিকতার মধ্য দিয়ে প্রকৃত প্রাণ পায়। ধর্মীয় এই বিশেষ আনুষ্ঠানিকতাটি রূপ লাভ করে সার্বজনীন সামাজিক উৎসবে।

শ্রীশ্রীচন্ডী গ্রন্থে বর্ণিত দেবী দুর্গাকেন্দ্রিক সর্বাধিক জনপ্রিয় কাহিনিটা এমন : পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে একশতবর্ষব্যাপী এক যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিলে, বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাঁকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের সমীপে উপস্থিত হন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনি শ্রবণ করে তাঁরা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হন। সেই ক্রোধে বিষ্ণু, শিব ও ব্রহ্মার মুখমন্ডল হতে এক মহাতেজ নির্গত হয়। সেই সঙ্গে ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হয়। সু-উচ্চ হিমালয়ে স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজ:পুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভূত হওয়ায় এই দেবী কাত্যায়নী নামে অভিহিতা হলেন। সেই দেবীই ঘটনাচক্রে মহিষাসুর বধ করেন। দেবগণ ফিরে পান স্বর্গের অধিকার।

অন্যদিকে কৃত্তিবাসি রামায়ণ অনুসারে, রাবণ ছিলেন শিবভক্ত। শিব তাঁকে রক্ষা করতেন। তাই ব্রহ্মা রামকে পরামর্শ দেন, শিবের স্ত্রী দুর্গার পূজা করে তাঁকে তুষ্ট করতে। তাতে রাবণ বধ রামের পক্ষে সহজসাধ্য হবে। ব্রহ্মার পরামর্শে রাম শরৎকালে দুর্গার বোধন, চন্ডীপাঠ ও মহাপূজার আয়োজন করেন। আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন রাম কল্পারম্ভ করেন। তারপর সন্ধ্যায় বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস করেন। মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও সন্ধিপূজার পরেও দুর্গার আবির্ভাব না ঘটায়, রাম ১০৮টি নীল পদ্ম দিয়ে মহানবমী পূজার পরিকল্পনা করেন। হনুমান তাঁকে ১০৮টি পদ্ম জোগাড় করে দেন। দুর্গা রামকে পরীক্ষা করার জন্য একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখেন। একটি পদ্ম না পেয়ে রাম পদ্মের বদলে নিজের একটি চোখ উপড়ে দুর্গাকে নিবেদন করতে গেলে, দুর্গা আবির্ভূত হয়ে রামকে কাঙ্ক্ষিত বর দেন।

সনাতন ধর্মীয় ভাবধারায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, দেবীভাগবত পুরাণ, দেবী মাহাত্ম্য, কৃত্তিবাসী রামায়ণ কিংবা শ্রীশ্রীচন্ডীসহ যত পুরাণের কথাই বলা হোক না কেন দেবী দুর্গাকে প্রণামের মন্ত্র কিন্তু একটাই:
সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে
শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়নী নমস্তুতে..

অর্থাত: হে দেবী সর্বমঙ্গলা, শিবা, সকল কার্য সাধিকা, শরণযোগ্য, গৌরি ত্রিনয়নী, নারায়নী তোমাকে নমস্কার। কৃপাময়ী দেবীর চরণে সর্বার্থে নিজেকে সমর্পিত করে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের মধ্য দিয়ে জাগতিক হিতবাদিতাই দুর্গাপূজার আদি ও আসল মাহাত্ম্য।


বর্তমান সময়ে সনাতন মানুষের পৌরাণিক দেবী পূজার আনুষ্ঠিকতাটি বাঙালি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক আচারনিষ্ঠায় পরিণত হয়েছে। সর্বমানুষের সম্মিলিত সৌহার্দ্যরে এক অনাবিল সাংস্কৃতিক রূপ পেয়েছে বাৎসরিক এই দুর্গোৎসব। পূজা উপলক্ষে বিশেষ আহারপর্ব, সাজসজ্জা, পরিভ্রমণ, ছুটি, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম কিংবা একে অপরের সাথে ভাববিনিময়ের সৌজন্যতা পুরো বাঙালি মানসকেই স্পর্শ করে চলেছে। বাঙলি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিংবা আদিবাসী কারো ধর্মীয় উপাচারের উৎসবই এখন আর তার নিজের একার নয়। দেশ ও মানুষের মঙ্গল ভাবনায় সব উৎসবই সবার; হোক না ধর্ম যার যার। দিন দিন ঔদার্য্য ও অহিংসা চর্চার পাদপীঠ হয়ে উঠছে ধর্মীয় উপাচারগুলো। মাঙ্গলিক উৎসবের আলোয় সকল সংকীর্নতা দূরীভূত করে মানবীয় মহানুভবতার স্রোতে যদি মানুষ ভাসে -তবে সেই সুশোভন সুন্দর ভাসানের জয়বন্দনাই করা চাই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুরটাও তেমনই, 'প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী। কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সমস্ত মনুষত্বের শক্তি অনুভব করিয়া বৃহৎ'।
'সত্য যেখানে সুন্দর প্রকাশ পায় সেইখানেই উৎসব। যে আনন্দ জলে স্থলে আকাশে সর্বত্র বিরাজমান সেই আনন্দকে আজ আমার আনন্দনিকেতনের মধ্যে দেখব। যে উৎসব নিখিলের উৎসব সেই উৎসবকে আজ আমার উৎসব করে তুলব'। উৎসব বন্দনায় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তবে রবি ঠাকুরের এই অমোঘ বাণী সত্য হয়ে থাকুক।

'ছেলে ভোলানো ছড়া' প্রবন্ধে কবিগুরু বলেছেন, আমাদের বাংলাদেশের এক কঠিন অন্তর্বেদনা আছে–মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো। অপ্রাপ্তবয়স্ক অনভিজ্ঞ মূঢ় কন্যাকে পরের ঘরে যাইতে হয়, সেইজন্য বাঙালি কন্যার মুখে সমস্ত বঙ্গদেশের একটি ব্যাকুল করুণ দৃষ্টি নিপতিত রহিয়াছে। সেই সকরুণ কাতর স্নেহ বাংলার শারদোৎসবে স্বর্গীয়তা লাভ করিয়াছে। আমাদের এই ঘরের স্নেহ, ঘরের দুঃখ, বাঙালির গৃহের এই চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া লইয়া বাঙালির হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা বাঙালির অম্বিকাপূজা এবং বাঙালির কন্যাপূজাও বটে। আগমনী এবং বিজয়া বাংলার মাতৃহৃদয়ের গান। অতএব সহজেই ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে যে, আমাদের ছড়ার মধ্যেও বঙ্গজননীর এই মর্মব্যথা নানা আকারে প্রকাশ পাইয়াছে।
আজ দুর্গার অধিবাস, কাল দুর্গার বিয়ে।
দুর্গা যাবেন শ্বশুরবাড়ি সংসার কাঁদায়ে॥
মা কাঁদেন, মা কাঁদেন ধুলায় লুটায়ে।
সেই-যে মা পলাকাটি দিয়েছেন গলা সাজায়ে॥
বাপ কাঁদেন, বাপ কাঁদেন দরবারে বসিয়ে।
সেই-যে বাপ টাকা দিয়েছেন সিন্ধুক সাজায়ে॥

অন্যদিকে বাঙালির সামগ্রিক অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য লালনকারী মানবতাবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর রচিত 'আনন্দময়ীর আগমনে' ও 'পূজা অভিনয়' কবিতায় দেবী দুর্গাকে শুধু ঐশী শক্তির অধিকারী হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন সামাজিক অনাচার, কূপমন্ডুকতা, ভন্ডামি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধ প্রতীক রূপেও। দেবী দুর্গা শক্তির প্রতীক। তাই দুর্গাপূজার মানে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে অপশক্তিকে নির্মূল করা। ত্রেতাযুগে রাবন অত্যাচারীর ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। নজরুলের দৃষ্টিতে কলিযুগের রাবন হচ্ছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ। কবি নজরুল ইসলাম লেখেন-
দশমুখো ঐ ধনিক রাবণ, দশদিকে আছে মেলিয়া মুখ;
বিশ হাতে করে লুন্ঠন, তবু ভরে না ক ওর ক্ষুধিত বুক।

তাই তো অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মন্ত্রণা পেতে বিদ্রোহী কবি নজরুল আবার লেখেন-
জাগো যোগমায়া জাগো মৃণ্ময়ী
চিন্ময়ী রূপে জাগো
তব কনিষ্ঠা কন্যা ধরনী কাঁদে
আর ডাকে মাগো!

দ্রোহ আর প্রেমের কবি নজরুলের দুর্গা আবাহনের এই সুললিত সুরটি হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেই কেবল শারদীয়া দুর্গোৎসবটি আর স্রেফ লোক দেখানো আড়ম্বরপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে না। পূন্য, প্রত্যাশা, আর আনন্দে অভেদ মানবীয় মেলবন্ধনে উৎসব হয়ে উঠতে পারে সত্যিকারের সর্বজনীন উৎকর্ষিক তাৎপর্যময়।
জাগরিক চৈতন্য আর উন্মীলিত বোধের দ্বৈরথে মানুষ ও এই বঙ্গভূমি ফিরতে পারে কাঙ্ক্ষিত স্বর্গের সত্য ও সুন্দর পথে। অসুন্দর অপসৃত হোক আর সবার জন্যই শুভবার্তা বয়ে আনুক মহামায়া শারদীয়া দুর্গা।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০৬ অক্টোবর ২০১৬
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous