জীবনমুখী গানের কবি বব ডিলানের নোবেল জয়

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 14 Oct 2016, 05:51 PM
Updated : 14 Oct 2016, 05:51 PM

মানুষের কথা আর জীবনের জয়গানে যার গীতসুধা কাব্যিক রূপ পেয়ে এসেছে; সেই বব ডিলানের নোবেল জয়ে সাহিত্যের চেনাগলিতে বিচরণ করা প্রতিথযশারা বিচলিত হয়ে সমালোচনায় মুখর হবেন -এটা জানা কথা। কিন্তু মানবতা ও শান্তির গান গেয়ে হানাহানি, হিংসা আর যুদ্ধ ভুলিয়ে দেয়া একজন শিল্পী মানুষের নোবেল জয়ে ধরিত্রীর আপামর নিষ্পেষিত প্রান্তিকজনের অবাক হওয়া চলে না। তার ওপর বব ডিলান আমাদের স্বাধীনতার অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশের জন্মসখা। এমন মানুষের বিশ্ব সেরা স্বীকৃতিতে আমাদের হৃদয় নিংড়ানো অভিবাদন থাকল।

১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর শতবর্ষ পরে সাহিত্যে ১১৩ তম নোবেল প্রাইজ পেলেন মার্কিন গায়ক ও গীতিকার রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান তথা বব ডিলান। রবিঠাকুরের গান লিখে নোবেল জয় আর ডিলানের একইধারার কৃতিত্বে নোবেল জয়টা সংখ্যাতাত্ত্বিক ১৩ দিয়েই যেন একইসূত্রে গাঁথা হয়ে গেল।

সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারটা এতোদিন গল্পকার, ঔপন্যাসিক বা কবিদের জন্যই তোলা থাকার রেওয়াজ চালু হয়ে গিয়েছিল। আমাদের কবিগুরু গীতিকাব্যের জন্য নোবেল পেলেও সাহিত্যের সামগ্রিক শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। তাই তাঁর নোবেল নিয়ে বিতর্ক কম। কিন্তু বিতর্ক উঠছে বব ডিলানের বেলায়। যেসব লেখকরা সাহিত্যের সমগ্রতায় বিশ্বাস না করে খন্ডিত চিন্তাধারায় বিশ্বাসী তারা ডিলানের নোবেল প্রাইজকে হেলাফেলায় উড়িয়ে দিচ্ছেন। আবার উষর সাহিত্যভূমির বিশালতায় নাটক, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, বা গান চর্চা করে যারা একই আঙ্গিকের উদারশিল্প চাষ করেন তারা এই পুরষ্কারকে সাধুবাদই জানাচ্ছেন। আমরা শিল্পের সমগ্রতায় বিশ্বাসীরা শেষের দলেই থাকব।

এই মহান শিল্পীকে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করতে গিয়ে সুইডিশ অ্যাকাডেমি বলছে, 'আমেরিকার সংগীত ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক মূর্চ্ছনা সৃষ্টির' জন্য ৭৫ বছর বয়সী এই রক, ফোক, ফোক-রক, আরবান ফোকের এই কিংবদন্তিকে নোবেল পুরস্কারের জন্য বেছে নিয়েছে তারা। ডিলানকে উল্লেখ করা হচ্ছে, ইংরেজি বাচন রীতির 'এক মহান কবি' হিসেবে, নোবেল পুরস্কার যার 'প্রাপ্য'।

ডিলানের 'দ্য টাইমস দে আর আ-চেইঞ্জিং' গানটিকে তুলনা করা হচ্ছে গ্রিক কবি হোমার আর শ্যাফোর সঙ্গে। বলা হচ্ছে, যদি ৫০০০ বছর পিছনে ফিরে যাওয়া যায়, তবে যেন হোমার আর শ্যাফোকে পাওয়া যাবে। তাদের গীতিকবিতা লেখাই হত গেয়ে শোনানোর জন্য। বব ডিলান একই কাজ করেছেন। সুতরাং একজন গায়ক বা গীতিকারের উর্ধ্বে ওঠে বব ডিলান সন্দেহাতীতভাবে একজন সুসাহিত্যিক -একথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়।

বব ডিলান বাংলাদেশের স্বাধীনতার বন্ধু; আমাদের প্রিয় সখা। একাত্তরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের কালে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও তাদের এদেশের দোসররা যখন নির্বিচার গণহত্যা ও নারীর সম্ভ্রমহানিতে মেতে উঠে; ঠিক সেসময় এই খবর জেনে বিটলস খ্যাত মার্কিন শিল্পী জর্জ হ্যারিসন ও পন্ডিত রবিশঙ্কর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজন করেছিলেন 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'। সেই অনুষ্ঠানে 'বাংলাদেশ' গানটি সবার মনে দাগ কেটেছিল। ঐ কনসার্টে ৪০ হাজার দর্শকের সামনে আরেকজন শিল্পী তাঁর কাব্যিক সঙ্গীতসুধা দিয়ে শ্রোতা দর্শকের মন জয় করেছিলেন; তিনি আর কেউ নন এবারের সাহিত্যে নোবেল জয়ী বব ডিলান। ০১ আগস্টের সেই অনুষ্ঠানে তিনি পরিবেশন করেছিলেন, তাঁর বিখ্যাত 'ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড' এবং 'আ হার্ড রেইনস আ-গনা ফল' শিরোনামের গান। শুধু তাই নয়, কবি অ্যালেন গিনসবার্গের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বন করে লেখা বিখ্যাত কবিতা 'যশোর রোড'কেও গানে রূপান্তরের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছিলেন বব ডিলান। এভাবেই এক সাগর রক্ত আর লাখো সম্ভ্রমে পাওয়া বাংলাদেশ নামের ভূখন্ড ও এখানকার দেশপ্রেমী মানুষের সাথে বব ডিলানের নামটিও চিরস্মরণীয় হয়ে গেল।

১৯৪১ সালের ২৪ মে মিনেসোটার ডুলুথে এক ইহুদি পরিবারে বব ডিলান জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১১ বছর বয়স থেকে সঙ্গীতের অমৃতমন্থন শুরু করেন। সেই তিনি আজও ৭৫ বছর বয়সেও সুরেরধারায় বসবাস করছেন। এই শিল্পী ও গীতিকার খ্যাতির তুঙ্গে পৌঁছান গত শতকের ষাটের দশকে। হাতে গিটার আর গলায় ঝোলানো হারমোনিকা হয়ে ওঠে তার ট্রেডমার্ক। সে সময় তার 'ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড' আর 'দ্য টাইমস দে আর আ-চেইঞ্জিং' এর মত গানগুলো পরিণত হয়েছিল যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের গণসঙ্গীতে।

নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেলের উইলে বলা আছে, সাহিত্যে নোবেল পাবেন সেই লোক, যিনি 'সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ অভিমুখে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন'। ডিলানের গানের লিরিকস বই আকারে বের হয়েছে এবং সেগুলো পাঠকমহলে তুমুল জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। এছাড়া বব ডিলান 'টারানটুলা' নামে একটি গদ্যকবিতার বইসহ নানা রকম নিরীক্ষাধর্মী সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন। 'ক্রনিকলস' নামে আত্মজীবনীও রচনা করেছেন তিনি। এর বাইরে ডিলান একজন সক্রিয় পেইন্টার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতাও। এমন একজন ব্যক্তিত্বকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া শুধু যৌক্তিকই নয়। ঔচিত্যের মধ্যেই পড়ে।

ষাটের দশকে আমেরিকায় যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়েছিল বব ডিলানের যে গানটি সেই 'ব্লোয়িন ইন দ্য উইন্ড' অবলম্বনে বাংলা গানের কিংবদন্তি কবির সুমন লিখেছেন-
কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়?
কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার ডানায়?
কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়?
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা।

কত বছর পাহাড় বাঁচে ভেঙে যাবার আগে?
কত বছর মানুষ বাঁচে পায়ে শেকল পরে?
কবার তুমি অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে?
বলবে তুমি দেখছিলে না তেমন ভালো করে।

কত হাজারবারের পর আকাশ দেখা যাবে?
কতটা কান পাতলে তবে কান্না শোনা যাবে?
কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে?
বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে।

ববের এই আকুতিরা এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। প্রশ্ন চলছেই, কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে?

এর আগে 'গ্রামি অ্যাওয়ার্ডস', গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড', 'একাডেমি অ্যাওয়ার্ড' ও পুলিৎজার প্রাইজ জুরির বিশেষ খেতাবে ভূষিত বব ডিলান ২০১২ সালে মার্কিন সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব 'প্রেসিডেনশিয়াল মেডাল অব ফ্রিডমে' ভূষিত হন। ববকে কবি হয়ে উঠতে অনেক সাধনার দুস্তর পারাবার পাড়ি দিতে হয়েছে। জীবনের প্রথম দিকে কবির পরিচয়ে তিনি সহজাত স্বাচ্ছন্দ্যময় ছিলেন না। তবে যেদিন লিরিকস লিখতে গিয়ে পুরোদস্তুর কবিত্ববোধের প্রকাশ ঘটাতে পেরেছিলেন সেদিন বব নিজেই স্বীকার করেছিলেন- 'I consider myself a poet first and a musician second. I live like a poet and I'll die like a poet'.

প্রতিবাদ ও নিপীড়ন বিরোধী গান রচনায় সিদ্ধহস্ত মানবতাবাদী কবি বব ডিলান বিংশ শতাব্দীর আধুনিক সংগীতের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিল্পী এবং বিশ্ব সংগীতেরই এক অবিসংবাদিত নাম।

গিয়েছি খুঁজতে তারে যেখানে শকুন খানা খায়
যেতাম গভীরে আরো, প্রয়োজন পড়েনি সেটায়
সেখানে শুনেছি বাণী দেবদূতদের, সেখানে শুনেছি কথা জনমানবের
তফাৎ কী বুঝিনি তো হায়!
মর্যাদা থাকেন কোথায়।

কবিতায় বব ডিলান এভাবেই প্রশ্ন রেখেছেন 'মর্যাদা থাকেন কোথায়?' আমরা বলব, মানবতা যেখানে সাম্রাজ্যবাদীদের লুন্ঠনের বিভীষিকা সেইখানে প্রবলভাবে সরব সুর যার; হাজার জন্মে জমিয়ে রাখা আর্ত-পীড়িতের প্রাণ উজার করা মর্যাদার অশ্রু-অঞ্জলি অনন্তকাল ধরে বর্ষিত হোক সেই কবি বব ডিলানের শ্রীচরণে। বাংলাবন্ধু বব ডিলান জেগে থাকুন; মানুষকে জাগিয়ে রাখুন।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
১৩ অক্টোবর ২০১৬।
facebook.com/fardeen.ferdous
twitter.com/fardeenferdous