আওয়ামী লীগের সম্মেলন: কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র কতদূর!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 20 Oct 2016, 05:35 PM
Updated : 20 Oct 2016, 05:35 PM


১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ৬৭ বছর বয়সী বর্ষিয়ান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২২-২৩ অক্টোবর। সম্মেলনে সারাদেশের প্রায় ৭ হাজার ডেলিগেট ও কাউন্সিলর ছাড়াও উদ্বোধনী অধিবেশনে জামায়াত ছাড়া দেশের সব রাজনৈতিক দল ও ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। নেতাদের কথায়, প্রচারণায় ও রমরমা প্রস্তুতির সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে, যেন নয়া যমানার দাওয়াত এসেছে তাই চারপাশে বাজছে দামামা।

ইতোমধ্যে দলের বর্তমান মহাসচিব সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলে দিয়েছেন, 'আওয়ামী লীগের সম্মেলন সব সময় বিশাল হয়। এটা সারা জাতিকে নাড়া দেয়। এবার আমরা আরও উৎসবমুখর পরিবেশে এই সম্মেলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।' তিনি আরও বলেছেন, 'সম্মেলনে শক্তিশালী ও দক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে'। সৈয়দ আশরাফের সাথে আমরা একমত যে, আওয়ামী লীগের সম্মেলন সত্যি আমাদের নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আমরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠছি। কিন্তু দলের কাজ যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করা এবং নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। তা কি হচ্ছে? সারাদেশের কোথাও প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করা হয়ছে -এমন খবর গণমাধ্যমে আসেনি। বরং পকেট কমিটিগুলো সম্মেলনের আগেভাগে বেঁদের ঝাপি থেকে সাপ বের করার মতো হুটহাট বের করা হচ্ছে। আর নতুন নেতারা কর্মীদের সাজানো পুষ্পমাল্য গলায় পরিধান করে নেত্রীর নামে হিশহিশ শব্দ করে যাচ্ছেন। তাহলে যে বলা হলো, শক্তিশালী ও দক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে, সেই কথার গুড় থেকে বালি সরাবে কে? যেখানে গণতান্ত্রিক উপায়ে ডেলিগেট বা কাউন্সিলর নির্বাচন করা হচ্ছে না, তারা কীভাবে দক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন করবে? তার ওপর তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত রয়েছে ত্যাগী ও উড়ে এসে জুড়ে বসা নেতাদের প্রকট দ্বন্দ্ব।

কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছিল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয় ছাড়া আর কারো নামে শ্লোগান দেয়া যাবে না, ব্যানার ফেস্টুন তৈরি করা যাবে না। কিন্তু সারাদেশের অলিগলিতে চোখ রাখলেই দেখা যাবে সেই নির্দেশনায় পাত্তা দেয়ার কথা কারোরই মনে নেই। এই ব্যাপারটি দলের চেইন অব কমান্ডের শক্তিমত্তা কতোটা তাই যেন জানান দেয়।
অধিকতর যোগ্যতম নেতা না থাকায় ৩৫ বছর ধরে দলটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্মেলনের আগে বিভিন্ন আলোচনায় তিনি বলেছেন, আর কত? এবার তাঁকে বাদ দিয়ে নেতা নির্বাচন করলেই তিনি খুশি হবেন। কিন্তু বাস্তবতা যে সেরকম নয় তা তিনি নিজেও জানেন। গত ৩৫ বছরে শেখ হাসিনা বাদে দলটিতে এমন নেতার দেখা পাওয়া যায়নি যাকে কেন্দ্র করে একছাতার নীচে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। যদি আমরা ধরে নেই যে হাসিনা পরবর্তী সময়ে দলটির হাল থাকবে সজিব ওয়াজেদ জয়ের কাছে, কিন্তু তাঁকে কি সেভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে? দেশের তথ্য-প্রযুক্তি উন্নয়নে জয়ের সক্রিয় ভূমিকা থাকলেও সরাসরি দলীয় কর্মকান্ডে তাঁকে তেমনভাবে দেখা যায় না। এবারের সম্মেলনে কি তবে সজীব ওয়াজেদ জয়কে নীতি নির্ধারণী কোনো পদে নির্বাচিত হতে দেখা যাবে?

সম্মেলনের পূর্ববর্তী সময়ে আরেকটি বিষয় গণমাধ্যমে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের সুযোগ্য পুত্র এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসিত তানজিম আহমদ সোহেল তাজ বাংলাদেশের জনগণের জন্য কাজ করতে চান এবং এ ব্যাপারে অনুসারীদের পরামর্শ চেয়ে নিজের ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাসে দিয়েছেন। সেই স্ট্যাটাসে তাঁর ভক্ত অনুরাগীরা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই অবস্থায় ক্লিন ইমেজের অধিকারী একজন সজ্জন সোহেল তাজ কি আওয়ামী লীগের এই সম্মেলনের মাধ্যমে জনগণের কাঙ্ক্ষিত কোনো পদে নির্বাচিত হবেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার করে নতুন নেতৃত্বের কথা বলেছেন। সেই নতুন নেতৃত্বকে প্রস্তুত করতে হলে আপাতত: আমাদের দৃষ্টিতে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সোহেল তাজের দিকে নীতি নির্ধারক, ডেলিগেট বা কাউন্সিলরদের নজর দেয়া জরুরি বলেই সমীচীন বোধ করি।

দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা ও সামনের ভোটের বৈতরণী পার হওয়ার ক্ষেত্রে নি:সন্দেহে আওয়ামী লীগের পক্ষে এই মুহুর্তে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। কিন্তু শেখ হাসিনার অবর্তমানে নৌকার হাল কে ধরবেন, তা নির্ধারণ করার উপযুক্ত সময় এটাই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী এবং নব্বই-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন করেছিলেন, তার মূল কথা ছিল 'ভাত ও ভোটের অধিকার। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সম্মেলনকে সামনে রেখে বলেছেন, '২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের খুব বেশি সময় নেই। সংবিধান অনুযায়ী এ নির্বাচন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই হবে। সেই নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য দলকে আরও সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে এবারের সম্মেলন অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে আমাদের আগামী নির্বাচনের বিজয়ের পথ সুগম হবে।' তার মানে ধরেই নেওয়া যায়, সামনের ভোটের মাঠ গোছাতে এই সম্মেলনটাকে একটা বড় টনিক ধরা হচ্ছে। এই গোছানোটা নাহয় পার্টির ক্ষেত্রে ফলদায়ী হলো। কিন্তু নির্বাচন কাঠামো সংস্কার না করে কেবল ঘর গোছালেই কি মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা যাবে? এক কথায় উত্তর হবে না। সকল মত ও পথের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও আস্থা ছাড়া নির্বাচনের চিরাচরিত পদ্ধতিটা হতে পারে নির্বাসনেরই নামান্তর। বহুদলের অনুপস্থিতি বা বর্জনে আবারও ভোটাধিকারের জন্য উঠতে পারে হাহাকার। হতে পারে জীবনক্ষয়ী আন্দোলন।


আওয়ামী লীগ সম্মেলন উপলক্ষে তাদের নবায়িত ঘোষণাপত্রে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মূলনীতির জানান দিতে গিয়ে বলেছে, 'বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত এবং জ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখা এবং ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের সমপর্যায়ে পৌঁছানোই হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একমাত্র লক্ষ্য।' 'সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করা যাবে না এবং কোনো উপাসনালয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও আলোচনা করা যাবে না। কোনো ধর্ম, সম্প্রদায়, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অবস্থান নেওয়া যাবে না। ধর্মেও রাজনৈতিক অপব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হবে।' 'সব ধরনের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রবাহের অবাধ চলাচল সুনিশ্চিত ও সংরক্ষণ করা হবে। সব সাংবাদিক হত্যার দ্রুত বিচার করে প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা, সাংবাদিক নির্যাতন, তাঁদের প্রতি ভয়ভীতি, হুমকি প্রদর্শন এবং সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বিতরণে বৈষম্যমূলক নীতির দলীয়করণ বন্ধ এবং সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে তার বিকাশে সহায়তা প্রদান করা হবে।'

কিন্তু চিহ্নিত দলীয় অপরাধীদের বাড়বাড়ন্তকে সামাল না দিয়ে, অব্যাহত চাঁদাবাজি, লুটপাট, খুন, ধর্ষণ বন্ধের উপায় অনুসন্ধান ও সেই অনুপাতে কার্যকরণ নির্ধারণ না করে সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্রের পৌছার কল্পনা কেবল অলীক স্বপ্নেই পর্যবশিত হতে পারে। বলা হচ্ছে ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে। সংবিধানে একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখে, ওলামা লীগ নামের একটি উগ্রবাদী সংগঠনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে তা কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব। একই সাথে গাছেরটাও খাবেন তলারটাও কুড়াবেন তা হতে পারে না।

সাংবাদিক হত্যার বিচারটাকে কতোটা হাস্যকর করে তোলা হয়েছে সাগর-রুনি তার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তাই এই কথাা নাহয় বাদ দেই। কিন্তু 'গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রবাহের অবাধ চলাচল' -কথাগুলো শুনতে বেশ লাগে। কিন্তু দুর্নীতি বা অপকর্মের যেকোনো অনুসন্ধান সরকারের বিরুদ্ধে গেলেই এই কথা নীতিনির্ধারকরা বেমালুম ভুলে বসেন। সেই ভুল আর কোনোদিন ভাঙ্গে না। চাপে পড়ে নাস্তানাবুদ হয় গণমাধ্যম। নতুন সম্মেলনের মাধ্যমে এমন কেউ কি নির্বাচিত হয়ে আসবেন, যিনি সুন্দর সুন্দর কথা দেবেন আবার তা অক্ষরে অক্ষরে নাহোক কিছুটা রাখবেনও বটে!

আওয়ামীলীগের সম্মেলনকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আশা প্রকাশ করেছেন, দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে এই সম্মেলন। এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে সকল দলের সমান সুযোগের ভিত্তিতে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি হবে এমনটাও প্রত্যাশা করেন তিনি।

আমরাও চাই ২০তম সম্মেলনের মাধ্যমে যে নতুন নেতৃত্বের হাতে পড়বে ঐতিহ্যবাহী এই দলটি, সেই নেতারা বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বহুমত ও পথকে একই সারণীতে উপস্থাপিত করবেন। যাতে করে আমরা সবাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানুষের বহুত্ববাদের চর্চায় অসাম্প্রদায়িক, কল্যাণমুখী, মানবতাবাদী, উদারনৈতিক ও পরমতসহিষ্ণু এক জাতিসত্ত্বায় রূপান্তরিত হয়ে সমস্বরে বাংলামায়ের জয়গান গাইতে পারি।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
২১ অক্টোবর ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous
twitter.com/fardeenferdous