ছেলেবেলার শবে বরাত ও তাওয়া!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 11 May 2017, 06:20 PM
Updated : 11 May 2017, 06:20 PM


ছেলেবেলার শবে বরাত সবার জন্যে সত্যি সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসত। কী আনন্দময়ই না ছিল সেই শৈশব! শবে বরাতের আগের দিনই আমার প্রয়াত নানী কমলা বেগম ও তাঁর কন্যারা ঢেঁকিতে চাল গুঁড়ো করে রাখতেন। শবে বরাতের সন্ধ্যায় বাড়ির গাভির দুগ্ধ, আখের গুড় ও কুড়ানো নারকেল দিয়ে সুস্বাদু হালুয়া বানাতেন। সাথে ওই চালের গুঁড়োর গরম গরম রুটি। আহা! প্রতিবেশিদের হালুয়া রুটি দেয়া হতো আবার সেদিক থেকেও সমানে আসতে থাকত। আমরা স্নান সেরে পুত:পবিত্র হয়ে ওই রুটি হালুয়ার আস্বাদ গ্রহণ করে সৌভাগ্যের প্রার্থনা করতে মসজিদে চলে যেতাম।

গ্রামীণ ধর্মীয় বা যে কোনো রিচুয়ালের একেকটা নিজস্ব নাম আছে। আমাদের মুরুব্বীরা শবে বরাতের একটা নিজস্ব নাম দিয়েছিলেন- 'তাওয়া'! যে পাত্রে রুটি সেঁকা হয় আমাদের অঞ্চলে সেটার নাম তাওয়া। রুটি শবে বরাতের অন্যতম অনুষঙ্গ বলেই হয়ত এমন নাম। আমরা তাওয়া বলতেই বুঝতাম ভাগ্যরজনী সমাসন্ন! এতো সৃষ্টিকর্তার কাছে আকাঙ্ক্ষা জানানোর সময়।

মামা বাড়ির তিন চার বাড়ি পরে ছিল জুম্মাবাড়ি। বিদ্যুৎ ছিল না মসজিদে তাই মাইকও ছিল না। পানার বাপ রোজ পাঁচবার আজান দিতেন। বাড়ি থেকেই সে আজান শুনতাম আমরা। আর এখন জুম্মাবাড়ি অন্যত্র সরে গিয়ে সড়কের পাশে পাকা দালানে রূপ নিয়েছে। চার দিকে চারটি মাইকের বড় হর্ণ লাগানো আছে। আফগানিস্তানে ট্রেনিং নেয়া এখনকার মৌলভী রোজ ফজরের পরে এক ঘন্টা আর মাগরিবের আগে লাউডস্পিকারে পরকালের বয়ান করেন। এ কালের অন্যায়, অনাচার, ঘুষ, দুর্নীতি, ব্যভিচার নিয়ে তিনি কথা বলেন না। বললে মসজিদ কমিটিরই কারও বিরুদ্ধে যেতে পারে হয়ত! মসজিদের আশপাশের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার বিঘ্ন বা বয়োবৃদ্ধের অসুস্থতার দুর্ভোগ আধুনিক মাওলানারা মাথায় রাখেন না। গগনবিদারী চিৎকারই তার একমাত্র ধর্মকর্ম!

পানার বাপের খালি গলায় এশার আজান শুনেই শিশুরা জোট হয়ে মসজিদে পা বাড়াতাম। সামনে থাকতেন বড়রা। মসজিদের ঈমাম ছিলেন ল্যাংড়া মুন্সী (নাহ, এটা কোনো রেসিস্ট শব্দ না! ওই মৌলভীর একটা পা খাটো ছিল বলে খুঁড়িয়ে হাটতেন। তাই এলাকায় ওই নামেই তিনি খ্যাত ছিলেন। আজ আর তাঁর সত্যিকারের নাম মনে করতে পারি না। ওই মৌলভী পরম যত্নে হাত ধরে সেই শিশুকালেই আমাকে পবিত্র কুরআন শরীফ পাঠ শিখিয়েছেন। ওস্তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা) শবে বরাতের তাৎপর্য তোলে ধরে বয়ান করতেন। সেসবে আমাদের মন ছিল না। অপেক্ষা করতাম কখন নামাজের পর মোনাজাত হবে, মহান আল্লাহর কাছে কী চাইব?

মুন্সী মহোদয়ের মিলাদ পাঠ বড় উপভোগ করতাম। 'ইয়া নবী সালাম আলাইকা' বলে মুসুল্লীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন। কয়েক পয়ার দাঁড়িয়ে পাঠ করতেন। বাচ্চারা কোলাহল করলে ইম্প্রোভাইজ করে তাৎক্ষণিক মিলাদের পয়ারেই বলে দিতেন, পোলাপান গোলমাল করিস না/কুরক্যার গোশ আলুর তরকারি! আমাদের অঞ্চলে মুরগীকে কুরক্যা বলে! সেসময়ের ধর্মাচারে কী সারল্য ছিল। কেউ বলত না, আপনি মিলাদের মাঝখানে মুরগীর নাম নিছেন, আপনি মুরতাদ হয়ে গেছেন। আপনার ঈমামতির চাকরি নট! সেসময় জঙ্গি ছিল না, তাই কেউ কারও কল্লাও চাইত না। একালের ধর্মে বহু বিভাজন। মানুষের চিন্তার বিভক্তি তারও বেশি। আগের সেই মহানুভবতা আর ঔদার্যের পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে কবেই!

আমাদের শৈশবের সৌভাগ্য প্রার্থনারাও ছিল নিতান্ত সাদাসিধে! ঈশ্বরের কাছে চাইতাম, বার্ষিক পরীক্ষায় আমার প্রতিদ্বন্দ্বী বন্ধুর চেয়ে ৫০ নাম্বার বেশি পেয়ে যেন পরের ক্লাসে রোল নাম্বার ১ হয়। প্রায়শ: স্রষ্টা কথা শুনতেন। ফল পেয়ে প্রভুকে ধন্যবাদ দিতাম আর তাওয়ার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ থাকতাম।

আর এখনকার ছেলেরা কি মসজিদে গিয়ে স্রষ্টার কাছে কিছু চায়? তাদের চাওয়ার সময় কোথায়? না চাইতেই তারা পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায়। আর ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউবের ভাবনার ভিতর সৌভাগ্যের রজনীর স্থানই বা কোথায়?

একালে আর শবে বরাতে বেশি কিছু চাওয়া হয়ে ওঠে না, সুন্দর স্বচ্ছ জীবনযাপন এবং দেশ ও বিশ্বমানুষের সামগ্রিক মঙ্গলকামনা ছাড়া। যে বেশি চায় তার না পাওয়ার বেদনা বেশি। যে কিছুই চায় না তার আবার কীসের হাহাকার?

আজ সৌভাগ্যের রজনীতে একটাই চাইবার আছে, দেশটারে শান্তি দিও প্রভু। আর আমাদের সকল শিশুকে সেই আগের আনন্দময় শৈশব ফিরায়ে দাও হে সর্বশক্তিমান।

ফারদিন ফেরদৌস
সুখেরছায়া
১১ মে ২০১৭
facebook.com/fardeen.ferdous
twitter.com/fardeenferdous