ইফতার ও সাহরি পার্টিঃ আমাদের বোধের অপচয়!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 16 June 2017, 07:02 PM
Updated : 16 June 2017, 07:02 PM

ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী এ পি জে আব্দুল কালাম রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় পূর্বের ঐতিহ্য ভেঙ্গে দিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে একদিনও ইফতার পার্টির আয়োজন করেননি। রাষ্ট্রপতি একজন ধার্মিক মানুষ হয়েও কেন এমনটা করেছেন সেসব বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা আছে সত্যম রায় চৌধুরী রচিত 'এ পি জে আব্দুল কালাম' বইয়ে।

এছাড়া সম্প্রতি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালামকে নিয়ে তাঁর সাবেক সচিব অবসরপ্রাপ্ত আইএস কর্মকর্তা পি এম নায়ারের একটি সাক্ষাৎকার দূরদর্শনে প্রচারিত হয়েছে, সেখানেও তিনি এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।

২০০২ সালে ড. আব্দুল কালাম যখন রাষ্ট্রপতির পদ নিয়েছিলেন, তখন রমজান এসেছিল জুলাই-আগস্টে। ভারতীয় রাষ্ট্রপতির জন্য এটা একটা নিয়মিত রেওয়াজ যে তিনি একটি ইফতার পার্টির আয়োজন করবেন। একদিন ড. কালাম তাঁর সচিব মি. নায়ারকে বললেন, কেন তিনি একটি পার্টির আয়োজন করবেন? কারণ, এমন পার্টির অতিথিরা সর্বদা ভালো খাবার খেয়ে অভ্যস্ত। তিনি মি. নায়ারের কাছে জানতে চাইলেন, একটি ইফতার পার্টির আয়োজনে কত খরচ পড়ে? মি. নায়ার তাঁকে জানালেন, প্রায় ২২ লাখ রুপি। ড. কালাম তাঁকে নির্দেশ দিলেন, কতিপয় নির্দিষ্ট এতিমখানায় এই অর্থ, খাদ্য, পোশাক ও কম্বল কিনে দান করতে হবে। রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম এতিমখানা বাছাইয়ের দায়িত্ব পেয়েছিল। ড. কালাম এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালন করেননি। এতিমখানা বাছাইয়ের পরে ড. কালাম মি. নায়ারকে তাঁর কক্ষে ডাকলেন এবং এক লাখ রুপির একটি চেক দিলেন। তিনি বললেন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে কিছু অর্থ দান করছেন। কিন্তু এ তথ্য কারও কাছে প্রকাশ করা যাবে না। মি. নায়ার এতটাই আঘাত পান যে তিনি বললেন, 'স্যার, আমি এখনই বাইরে যাব এবং সবাইকে বলব। কারণ, মানুষের জানা উচিত, এখানে এমন একজন মানুষ রয়েছেন, যে অর্থ তাঁর খরচ করা উচিত, শুধু সেটাই তিনি দান করেননি, তিনি সেই সঙ্গে নিজের অর্থও বিলিয়েছেন।' ড. কালাম যদিও একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন; কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকার বছরগুলোতে কোনো ইফতার পার্টি দেননি।

মি. নায়ারের কথাগুলো পড়ে অলখেই চোখে জল চলে এল। রাষ্ট্রপতির অসীম ক্ষমতা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি লোকজন দাওয়াত দিয়ে খাইয়ে বাহবা না কুড়িয়ে গোপনে সমাজে বঞ্চিতজনের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। পরহেজগারদের এমন রাষ্ট্রপতিরই পা ছুঁয়ে সালাম করা উচিৎ।

অন্যদিকে আমরা কী করি? দেশে দিন দিন ইফতার পার্টি রমজানের এক অনিবার্য অনুষঙ্গে পরিণত হচ্ছে। তার ওপর আবার ইদানিং শুরু হয়েছে সাহরি পার্টি। ঘটা করে রাতবিরাতে দাওয়াত খেতে যাচ্ছে মানুষ। প্রতিযোগিতা চলছে, কার পার্টিতে কী খাবারের মেন্যু এবং সমাজের কতবেশি হোমরা-চুমরাদের উপস্থিত করা যায়! দাওয়াত কার্ডে মেন্যু হিসেবে লিখে দেয়া হচ্ছে, কাঁচা খেঁজুর,পাকা খেঁজুর, বড় বাপের পোলায় খায়, কোয়েল পাখির ভুনা, আস্ত খাসি ভুনা, তেহারী, খাসির পায়া, জিরা পানি, লাবাং চা/কফি, পান ইত্যাদি। সাথে সবরকমের মৌসুমী ফল এবং ছোলা, বেগুনি, জিলাপী ও মুড়ি! গভীর প্রশ্ন, একজন সত্যিকারের সংযমী রোজাদার মানুষ সারাদিন অভুক্ত থাকার পর ইফতারিতে গিয়ে এত খাবার গোগ্রাসে আদৌ গিলতে পারে?
অন্যদিকে ঢাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে সাহরি পার্টিতেও মেন্যু হিসেবে থাকছে মোরগ পোলাও, নান রুটি, সাদা ভাত, তেহারি, ভুনা খিচুড়ি, বিরিয়ানি, মাটন লেগ রোস্ট, মাটন গ্লাসি, মুরগির ফুল রোস্ট, মুরগির চাটনি, মুরগির মোসল্লাম, রুপচাঁদা মাছ, চিংড়ি মাছ এবং রুই মাছসহ নানা পদ। গরীব মানুষ সেসব পার্টির দিকে তাকাবে এমনটা ভাবনায়ও আনা যায় না। একবার খাবারের জন্য ৫০০-১০০০ টাকা খরচের সাধ্য আছে ক'জনার?

রাজনীতিবিদদের ইফতার পার্টি সবচে' বেশি জমজমাট। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীনেত্রী, শিল্পপতি, ডিসি, এসপি'র পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী, বেসরকারি সংগঠন, চিত্রনায়করাও পার্টি থেকে পিছিয়ে নেই। লাখ টাকা তো মামুলি ব্যাপার এসব পার্টিতে কোটি টাকার ওপরে খরচ করাটাই এখন ফ্যাশন।

আগে জানতাম, বিশ্বের ধনী দেশগুলোতে মানুষ বাজার থেকে যে খাবার কিনে তার অর্ধেকই অপচয় হয়। আমরাও কি তাহলে ধনী হয়ে গেছি? যারা রোজ ইফতার পার্টিতে যান তারা বিবেচনা করলেই দেখবেন, এখানে আসলে অর্ধেক না তারও বেশি খাবার অপচয় হয়। মানুষের পেটে এতো জায়গা নেই যে ২৫/৩০টা খাবারের আইটেম একসাথে উদরে প্রবেশ করানো যায়!
রোজার উদ্দেশ্য হলো আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি। এইভাবে লোকদেখানো ইফতার এবং সাহরি পার্টিতে খাবারের বিপুল অপচয় করে সংযম সাধনা হবে তো? মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন যে সুরা বাণী ইসরাইলে বলেছেন, নিশ্চয় অপচয়কারী শয়তানের ভাই, আর শয়তান হচ্ছে তার প্রভুর প্রতি বড় অকৃতজ্ঞ। আর নবী কারীম (সা.) বলেছিলেন, কোনো ব্যক্তির জন্য দ্বীনের সৌন্দর্য হলো অহেতুক বা অপ্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকা।

এখন প্রভুর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে ধর্মের নামে অহেতুক অপ্রয়োজনীয় কাজ-কারবার করে লেবাসধারী ধার্মিক হতে পারেন প্রকৃত পরহেজগার হওয়া আর হবে না। ভাবুন তো, দেশে কত লোক ফুটপাতে ঘুমায়, একবেলা আধপেটা খেয়ে কোনোরকমে জীবনধারণ করে। শুধুমাত্র শুকনো মুড়ি আর জল খেয়ে রোজা রাখা মানুষেরও তো অভাব নেই। হাজার হাজার মাদ্রাসা চলে লিল্লাহবোর্ডিং এর মাধ্যমে। সেখানকার কোমলমতি শিশুরা কী খেয়ে ইফতার বা সাহরি করে খোঁজ নিয়ে দেখেছেন? এতিমখানায় পিতৃমাতৃহীন শিশুদের কী অবস্থা? কখনো জানতে ইচ্ছে করে না, দালালেরা কোনপ্রেক্ষিতে অসহায় নারীদের যৌনকর্মী বানিয়ে হোটেলে এনে ওঠাচ্ছে? দেশে ভালোমানের দাতব্য হাসপাতাল নেই। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এমন অবস্থায় আপনি ইফতার আর সাহরি'র নামে টাকা উড়ান। বিদেশে ঈদ বাজার করে নিজেদের ভাবচক্কর দেখান। তা কি শোভন দেখায়? দায়িত্বজ্ঞানের মধ্যে পড়ে? মানবতাটা জাগান!

একবার বিবেকটা জাগ্রত করে ধ্যানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের চিন্তা-চেতনাটা নিজের মনের আয়নায় প্রতিবিম্বিত করে দেখুন তো রোজা পালনের নামে আপনারা যা কিছু করেন, তা কি ধর্মাচার বা শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে?
সাম্যবাদ ও মানুষের অধিকার রক্ষার আইকন হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, কোন রোজাদার ব্যক্তি যদি অন্য রোজাদার ব্যক্তিকে ইফতার করায় হোক সে একটি খুরমা দ্বারা কিংবা এক গ্লাস পানি দ্বারা তবে সে ব্যক্তি ঐ রোজাদার ব্যক্তির সমপরিমান সওয়াবের অধিকারী হবে। তবে যে ব্যাক্তিকে ইফতার করানো হবে তার সওয়াব থেকে সওয়াব কমানো হবে না। নবীজি কোথাও বলেননি ৫০টি আইটেম দিয়ে সৌদি রাজা-বাদশাহদের মতো খাবারের উৎসব করতে! তিনি বরং নিরন্নের মুখে দু'মুঠো ভাত তোলে দিতেই নির্দেশনা দিয়েছেন। বস্ত্রহীনকে দিতে বলেছিলেন পোশাক, আশ্রয়হীনে ঘর। একবার ভাবুন তো, টাকার অভাবে কতজনের ঘরে ঈদ হবে না, নতুন জামা কেনা হবে না। মুখে উঠবে না মিষ্টান্ন। সমাজে কতজন পড়াশোনা করার টাকা জোটাতে পারে না। বিনা চিকিৎসায় মারা যায় কত অসহায় মানুষ। আপনারা রোজার অনুষঙ্গ হিসেবে খরুচে ইফতার ও সাহরি পার্টি করেন। সমাজের মানবেতর জীবনযাপন যারা করেন, তাদের জন্য কি মনটা একটুও কাঁদে না?

দেশে চলছে খাদ্যের নীরব আকাল। বাঁধের টাকা লোপাট করে দিয়ে হাওরে কৃত্রিম বন্যা সৃষ্টি করে কৃষককে অন্নহীন করে দিয়েছি আমরা। এতদিন শুনতাম খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। অথচ ভিয়েতনাম থেকে ৯০৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে আড়াই লাখ মেট্রিকটন চাল আমদানির প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। বোঝাই যায় দেশে অনাহারীর সংখ্যা আগের চেয়ে বাড়বে। পাহাড়ের ট্রাজেডিতে বুক ভাঙ্গছে সবার। এমন একটা পরিস্থিতিতে টাকা দিয়ে খাদ্য কিনে পার্টি করার নামে অর্ধেকটা জলে ফেলে দেয়ার কোনো মানে হয়? সত্যিই রোজা হয় আপনাদের?

বিশ্বে প্রতিদিন ১০০ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়। আর আমরা বাহারি ৫০ আইটেম দিয়ে ইফতার ও সাহরি করি। মহান রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম আমাদের দেখে নিশ্চয় বলতেন, তোমাদের ভোগটাই পৃথিবীর জন্য বিরাট দুর্ভোগ, ত্যাগ ও সংযমের সাধনা না করে লোকদেখানো ধর্মীয় উপাচার পালনটা আসলে বোধের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।

ফারদিন ফেরদৌস
সুখেরছায়া
১৬ জুন ২০১৭