বয়লার বিস্ফোরণ ও শ্রমিকের মৃত্যুভাগ্য!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 6 July 2017, 04:12 AM
Updated : 6 July 2017, 04:12 AM

গাজীপুরের নয়াপাড়ায় একটি বৃহৎ তৈরি পোশাক কারখানা মাল্টিফ্যাবস লিমিটেডে ৫ টনি বয়লার বিস্ফোরণে প্রাণ গেল ১৩ পোশাককর্মীর। আহত হয়ে হাসপাতালে জীবনযুদ্ধে লড়ছেন আরও ৫০ জন শ্রমিক।
ঈদের ছুটিতে স্বল্প পরিসরে কাজ চলছিল কারখানাটিতে। কারখানাটির ৫/৬ হাজার শ্রমিক কাজে যোগ দেয়ার পর যদি বয়লার বিস্ফোরণ ঘটত এবং পুরো কারখানায় আগুন ধরে যেত তবে সন্দেহাতীতভাবেই আরেকটি রানাপ্লাজা ট্রাজেডির মতো মানবিক বিপর্যয় ঘটত।

এবারের বয়লার বিস্ফোরণের পুরো দায়ভার কারখানা কর্তৃপক্ষের। গেল ২৪ জুন ২০১৭ তারিখে ১৫ বছর বয়সী বয়লারের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও সেটি দিয়েই ডায়িং সেকশনে কাজ চলছিল।

০৩ জুলাই সন্ধ্যায় বিস্ফোরণের আগে অন্তত দুইবার শব্দ করে বয়লারটি সতর্কবার্তা দিয়েছে বলে জানিয়েছে আহত কর্মীরা। তা সত্ত্বেও বয়লারটি 'শাট ডাউন' না করায় ঝরে গেল ১৩ জন মানুষের প্রাণ। ধ্বংস হলো চারতলা ভবন। ক্ষতিগ্রস্ত হলো আশেপাশের মানুষের জীবন ও বিল্ডিং প্রোপার্টি।

বয়লারে একটি সেফটি ভাল্ব থাকে, যা একটি নির্দিষ্ট চাপে বা প্রেসারে সেট করা থাকে। বয়লারের অবস্থা অনুযায়ী ওই চাপ নির্ধারণ করা হয়। প্রেসার এর চেয়ে বেশি হলে সেফটি ভাল্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হওয়ার কথা। প্রেসার বেশি হওয়ার পরেও সেফটি ভাল্ব ওপেন না হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

ময়লা জমে ভাল্বটি বন্ধ হয়ে গেলেও বয়লার বিস্ফোরিত হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, বয়লারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছু কিছু জিনিস চালু হওয়ার কথা সেগুলোও ঠিকমতো চালু না হলেও বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

বয়লার হচ্ছে একটি বদ্ধ পাত্র, যার ভেতরে চাপের মাধ্যমে পানিকে বাষ্পে পরিণত করা হয়। সাধারণত গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, রঙ করার কারখানা, হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্রে এই বয়লার ব্যবহার করা হয়।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশে একটি বয়লার পরিদর্শন অধিদপ্তর রয়েছে। সারাদেশের কারখানাগুলোর বয়লার সেটাপ, মেইনটেন্যান্স ও নবায়নযোগ্যতা তাদেরই দেখভাল করবার কথা। কিন্তু সরকারি অফিসের কাজ হয়ত সরকারি গতিতেই চলে। মাঝখান থেকে অকালে ঝড়ে যায় নিরীহ প্রাণ। নামকাওয়াস্তে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি আর মৃতদের দেয়া হয় লামছাম অনুদান।

কিন্তু এসব ভয়াবহ বিপর্যয় রোধ করবার কথা যাদের তারা থাকে গভীর ঘুমে নির্বিকার। তারা হয়ত ভাবেন, শ্রমিক আবার মানুষ নাকি! তাদের জন্য আগপাছ ভেবে কী লাভ?

মালিক গড়ছে লাভের পাহাড়। তার কি অত মানবিক হলে চলে?

মাল্টিফ্যাবস কারখানার বয়লার বিস্ফোরণের বিপর্যয় বুঝাতে উদ্ধারকারী পুলিশ কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির মেম্বার ও গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিস্টার সাখাওয়াত হোসেনের বক্তব্যটাই যথেষ্ট। তিনি তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন:

'ভয়াবহতা বুঝাতে শুধু একটি দৃশ্যের কথা বললেই আপনারা বুঝে যাবেন। ৫ টনের বয়লারে প্রচণ্ড উত্তাপে পানি বাষ্পীভূত হচ্ছে কিন্তু কোন কারণে বের হতে পারছে না। চাপ বাড়ছে ত বাড়ছেই। এক সময় সেটি বিষ্ফোরিত হলো। ভূমিকম্পের মত কম্পনে বোমা বিষ্ফোরনের মত শব্দে আশেপাশের এলাকার সকল বিল্ডিং কেঁপে উঠলো। ভেংগে পড়লো সব কাঁচের দরজা জানাল। বয়লার যে ভবনে ছিলো সেটি পুরোটা আক্ষরিক অর্থে উড়ে গেলো বিম কলামসহ যেদিক খুশি! আশেপাশে যারা কাজ করছিলো দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। একজনের মাথা দেহ থেকে বিছিন্ন হয়ে পাশের বিল্ডিং এর ছাদে গিয়ে পড়লো!!

১৩ জন নিহত, ৫০জন আহত!

আল্লাহতায়ালা আমাদের স্বাভাবিক মৃত্যু দান করুন। আমিন।'

অথচ এমন মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনাগুলো ঘটে মানুষেরই ভুলে। কিন্তু যাদের লোভের ভুলে এমন ট্রাজেডি ঘটে তারা বরাবর থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমরাতো বিচার দেখিনি রানাপ্লাজা, তাজরীন বা টাম্পাকো ফয়েলস দুর্ঘটনায় দায়িদের। জানি, মাল্টিফ্যাবসের গতিও ওইদিকেই।

তবু শ্রমিকের ঝুঁকিহীন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতের দাবি জানাই। শ্রম আইন ২০০৬টা দায়িত্বশীল সকলকে বিশ্বাস ও আস্থায় নিয়ে আত্মস্থ করবার দাবি করি। বিস্ফোরণ, ধ্বস বা অগ্নিকান্ডের মতো বেদনাদায়ক ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে আর যেন খালি না হয় কোনো মায়ের বুক। সন্তান না হোক পিতৃমাতৃহীন। রাষ্ট্রের নজর ফিরুক সাদাসিধে প্রান্তিকজনে। বাঁচুক মানুষ, বাঁচুক দেশ।

ফারদিন ফেরদৌস
সুখেরছায়া
০৪ জুলাই ২০১৭