রোহিঙ্গা জীবন: বাংলাদেশ মানবিকতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 12 Sept 2017, 04:40 AM
Updated : 12 Sept 2017, 04:40 AM

১.
এই সময় মিয়ানমারের বর্বর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর জাতিগত নির্মূলের মুখে পালিয়ে আসা তিন লক্ষাধিক এবং আগের পাঁচ লাখসহ অন্তত আট লাখ নিপীড়িত রোহিঙ্গা মানুষের দায়িত্ব নিয়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন মানবিকতার বড় উদাহরণ। একসময় উন্নত বিশ্বের দান দক্ষিণায় চলা বাংলাদেশ এখন মিলিয়ন শরণার্থীর ভরসাস্থল। বৃহৎ ভারত পর্যন্ত মাত্র ৪৬ হাজার রোহিঙ্গার ভার বইতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে; সু চি'র রোহিঙ্গানিধনযজ্ঞে মৌন সম্মতিও দিচ্ছে! আর আমাদের প্রতিবেশি মিয়ানমার যাদের সেনাবাহিনী ধর্ষণ আর গণহত্যায় পৃথিবীশ্রেষ্ঠ পিশাচদের অন্যতম বলে স্বীকৃত হচ্ছে। তাদের বর্তমান নেত্রী তথাকথিত শান্তি নোবেলজয়ী অং সান সু চি হলেন হাল আমলের রক্তপিপাসু ফ্যাসিস্টদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অন্যদিকে পাকিস্তান ও তাদের ভাবগুরু চীনেরও রয়েছে রোহিঙ্গা নিধনে গোপন ইন্ধন। এমন এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে আমাদের বিবিধ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সভ্যতা ও মানবিকতায় ওদের চেয়ে আমরাই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।

সেনাবাহিনীর ক্রীড়নক কিন্তু গণতন্ত্রের লেবাসধারী সু চি কিছুতেই তার অবস্থান বদলাবেন না। রোহিঙ্গাদের তার দেশের নাগরিকই মনে করেন না তিনি। তাই রোহিঙ্গাদের শেষ ব্যক্তিকেও ভিটেছাড়া অথবা পৃথিবীছাড়া করবেন তিনি। তিনি এবং তার সৈন্যবাহিনীর মগজে এখন খুনের নেশা। তার সাথে আমাদের পার্থক্য এটাই অন্যায়ভাবে নিজের দেশের মানুষকে তিনি তাড়িয়ে দিচ্ছেন আর আমরা মানুষের ভালোবাসায় রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় দিচ্ছি।


রোহিঙ্গা সমস্যা জাতিসংঘে তুলব: শেখ হাসিনা
২.
নতুন আসা তিন লাখ বিপন্ন রোহিঙ্গা মানুষকে তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে আদৌ কি বাঁচিয়ে রাখতে পারব আমরা? বনভূমির দুই-আড়াই হাজার একর ভূমি বন্দোবস্ত করাই কি শেষ কথা? কী উপায় হবে সেখানকার নারী ও শিশুদের? চিকিৎসা ও খাদ্য-পুষ্টি নিশ্চিত করতে আমাদের সক্ষমতায় কতটা কুলাতে পারব আমরা? সবার ওপরে রয়েছে, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন হতে না দিয়ে পরিপূর্ণ নিবন্ধনের মধ্যে রাখা। কারণ তারা প্রকৃতার্থে মিয়ানমারের নাগরিক, সু চি স্বীকার করুন আর না করুন। আবার অতীত ইতিহাস থেকে এটাও প্রমাণিত সত্য যে, খুব সহসা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরৎ পাঠানোও সহজ হবে না কোনো শক্তিধর রাষ্ট্রের শক্তিপ্রয়োগ ছাড়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো সৌদিআরবের মতো মুসলমানদের আঁতুড়ঘর রাষ্ট্র পর্যন্তও মিয়ানমার সরকারেরই পক্ষে!

২০১৫ সালের মার্চে আরব নিউজ 'Four million Burmese entitled to get iqama'-শীর্ষক একটি খবর পরিবেশন করে! ওই খবর অনুযায়ী সেসময় সৌদিআরব ৪০ লাখ বার্মিজকে তাদের দেশে ওয়ার্ক পারমিট দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। যদিও সেখানে তারা রোহিঙ্গাদের কথা আলাদা করে কিছু বলেনি। বরং সৌদিআরবের অবস্থাদৃষ্টে এবং তাদের দেশের এইসময় প্রকাশিত খবরে প্রমাণিত হয় সু চি'র জাতিগত নিধনে তাদের সমর্থন আছে!

তারপরও সৌদিআরবকে বুঝিয়ে ৪০ লাখ বার্মিজকে নেয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের যদি সেখানে ওয়ার্ক পারমিটের ব্যবস্থা করা যায় তবে তা হতে পারে মানবিকতা প্রদর্শনের সাথে বাংলাদেশের দায়িত্ববোধেরও অনন্য উদাহরণ। যদিও এতে বাংলাদেশি কর্মীদের সুবিধা বা কোটাবঞ্চিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স!

৩.
রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের কথা না ভাবলে, তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার কথা না ভাবলে ওদের শিশুদের মানুষ হিসেবে আইডেনটিটি নিশ্চিত করা যাবে না। কাজেই রোহিঙ্গাদেরকে আরাকানে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি, রোহিঙ্গাদের খুব সহসাই আপনভূমিতে ফেরানো সম্ভব হবে না এমনটা ধরে নিয়েই বিকল্প চিন্তা শুরু করতে হবে। মানবেতর জীবন থেকে বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গাদের মুক্তি দিতে পারে তবে সভ্যতার ইতিহাসে আমার বাংলাদেশের নামটিও স্বর্ণাক্ষরে লেখা হতে পারে! এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশি, ওআইসি, জাতিসংঘ, উন্নয়ন সহযোগী এবং জার্মানির মতো মিয়ানমারের গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচক অপরাপর রাষ্ট্রের সাথে এখুনি কথা বলতে পারে।

নিজের দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা ও নাগরিকদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করার সাথে সাথে ভয়াল বিপাকে পড়া রোহিঙ্গা মানুষের সুস্থির মানবজীবন ফিরিয়ে দিতে বাংলাদেশের সুকৌশল দূতিয়ালির এটাই সময়।
মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানবিকতা প্রদর্শন ও দায়িত্ববোধের নজির সৃষ্টির মাধ্যমে আমার বাংলাদেশের মানমর্যাদা বিশ্বসভায় উঁচু থাকুক। ঔদার্যে বাঙালি হোক বিশ্বমানুষ।

ফারদিন ফেরদৌস
সুখেরছায়া
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭