প্রজন্ম আর প্রযুক্তি: কার হাতে কে বন্দী?

ফারজানা তন্বী
Published : 5 July 2017, 03:22 AM
Updated : 5 July 2017, 03:22 AM

তিন বছরের ছোট্ট মেয়ে আলিয়া (ছদ্মনাম)। ইন্টারনেট ব্যবহার করে আরও এক বছর ধরে। ইউটিউব ,মা-বাবার ফেসবুক একাউন্ড তার নখদর্পনে। ইউটিউবের এক ভিডিও থেকে অন্য ভিডিওতে যাচ্ছে, সেভ করছে। খেতে গেলে তার মোবাইলের নেট লাগে, সারাদিনই একই অবস্থা। প্রথমে তার হাতে মোবাইল বর্ণমালা, ছড়াগান শেখার জন্য দেয়া হলেও পরে দেখা গেল শিক্ষার চেয়ে কুশিক্ষাই বেশি হচ্ছে। যে বাবা-মা তাদের সন্তানের ইন্টারনেট ব্যবহারের দক্ষতায় একসময় খুশি ছিল তারা এখন পড়েছে মহা বিড়ম্বনায়। কিছুতেই কন্যার ইন্টারনেট আসক্তি দূর করতে পারছে না তারা। তাকে আর পড়ার বইমুখী করা যাচ্ছে না কিছুতেই।
এবার আসা যাক আলিয়ার বাবার কথায়। ঘুম থেকে উঠেই সে তার ফেসবুক চেক করে। মোবাইলে চোখ রাখতে রাখতেই খাওয়া আর অফিসের প্রস্তুতি চলে। আলিয়া ঘুম থেকে উঠে জ্বালাতন করলে তার হাতে নিজের ফোনটা গুঁজে দেয় সে।

আলিয়ার মা সারাদিন ব্যস্ত থাকেন ঘরের কাজে। সময় পেলে তিনি ফেসবুক আর টিভি সিরিয়াল দেখেন। আলিয়া ঝামেলা করলে তাকে চুপ করাতে সিরিয়ালের গল্পের আকর্ষণীয় অংশ বর্ণনা করেন। তাকে খাওয়ানোর কাজ তার হাতে মোবাইল দিয়ে সারলে ঝামেলা কম হয়।

আলিয়া বড় হচ্ছে, তার মোবাইল সাথে সাথে ইন্টারনেট আসক্তি দিনদিন বাড়ছে। আজকাল তাকে এগুলো থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করলে সে খারাপ ব্যবহার করে, কান্নাকাটি করে হাত-পা ছুঁড়ে।
আলিয়ার বাবা-মা নিজেরদের মধ্যে কথা-বার্তা বলার সময়ই পায় না। অফিস থেকে আলিয়ার বাবা আসার পর ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, ফ্রেন্ডদের সাথে চ্যাট করে। আলিয়ার মা তার সাথে কথা বলার ব্যর্থ চেষ্টা করে নিজেও সিরিয়াল আর ফেসবুকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় তাদের সম্পর্কটা কি কেবলই আলিয়ার জন্য।
এমন ঘটনা আমাদের আসেপাশে এখন নিত্তনৈমন্তিক ব্যপার। মোবাইল হাতে ছাড়া বাচ্চা আজকাল দেখা যাচ্ছেই না। প্রযুক্তির পাকে পড়ে ভাঙ্গছে অনেক সম্পর্ক। বহু ছেলেমেয়ে ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে, প্রতারনার শিকার হচ্ছে। দূর্বল হচ্ছে পারিবারিক সম্পর্কগুলো। ফলে অনেকের আচরণগত অস্বাভাবিক পরিবর্তন পরিবারের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, ফলাফল ভুগছে সমাজ। কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী। ইন্টারনেট? আজকালকের বাচ্চারা? নাকি তার বাবা-মায়েরা? নাকি অপব্যবহার, অসচেতনতা আর অহেতুক আসক্তি? আমদেরকে সচেতন হতে হবে,পরিবর্তন হতে হবে নিজেদের আগে এবং সেটা এখনই। কারণ আমাদের এই অপব্যবহার, অসচেতনতা আর অহেতুক আসক্তি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর বিষ ঢালতে শুরু করেছে। প্রযুক্তি ছাড়া এখন আমরা স্বাভাবিক সামাজিক জীবন কল্পনাই করতে পারি না, পারা সম্ভবও নয়। ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবনে এর প্রয়োজন অসামান্য। তাই আমাদেরকে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে হবে, সাথে সাথে ভবিষ্যৎ ব্যবহারকারীদেরকেও সঠিক পথ দেখাতে হবে। ইন্টারনেট বা ডিস কানেকশন থাকবে, থাকবে মোবাইল আর কম্পিউটার, বরং আসবে আরও অনেক রকম প্রযুক্তির উপাচার। এদের অপব্যবহারের সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে যদি আমরা সচেতন হই তাহলে বাবা-মা আর কাছের মানুষদের একটু সচেতনতা আর চেষ্টাই যথেষ্ট আমাদের এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ আর স্বাভাবিক জীবনের পথে এগিয়ে নিতে।