অর্থনৈতিক মুক্তি-৩য় পর্ব

গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফজলুল হক
Published : 15 June 2011, 03:40 AM
Updated : 15 June 2011, 03:40 AM

জীবনধারণের প্রাকৃতিক, মৌলিক এবং সামাজিক চাহিদা পূরণের সক্ষমতা অর্জনকে অর্থনৈতিক মুক্তি বলে। চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজন হয় পণ্য ও সেবা। পণ্য ও সেবা উৎপাদন করতে দরকার হয় শ্রম, সম্পদ, মূলধন (অর্থ, ফার্ম, কারখানা, অবকাঠামো, প্রযুক্তি, এনার্জি ইত্যাদি) এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংগঠন।

১। প্রাকৃতিক চাহিদা:– পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশে অন্যান্য জীবনের সাথে মানব জীবনের অস্তিত্ব ও রক্ষিত হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষিত না হলে জীবনের ধ্বংস অনিবার্য।প্রাকৃতিক পরিবেশ( হ্যাবিটাট) থেকে যে সকল বস্তু গ্রহন করে জীবনধারণ করা হয় সেগুলোকে প্রাকৃতিক চাহিদা বলা যায়। বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন; নদী,খাল, জলাশয়ের পানি; ভূমি,বন প্রভৃতি প্রাকৃতিক চাহিদার উপকরণ যা ধ্বংস হলে জীবন ধারণ সম্ভব হয় না।

২। মৌলিক চাহিদা: জীবনধারণের যে চাহিদাগুলো ব্যক্তিগত ভোগের দ্বারা পূরণ হয় সেগুলোকে মৌলিক চাহিদা বলা হয়।মৌলিক চাহিদা দু'ধরণের (ক) দৈহিক যথা— খাদ্য,পরিধেয়, গৃহ, স্বাস্থ্য, যৌন, জ্বালানি ইত্যাদি; (খ) মানসিক যথা— শিক্ষা, বিনোদন, জ্ঞান ও প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। মৌলিক চাহিদা ব্যক্তি সামর্থ পূরণ করতে পারার উপযুক্ত সমাজ ব্যবস্থা শোষণ মুক্ত হয়।

৩। সামাজিক চাহিদা: সমাজবদ্ধভাবে জীবনযাপনের প্রয়োজনে এই চাহিদার সৃষ্টি এবং এই চাহিদা সমূহ ব্যক্তিগত শ্রমে বা প্রচেষ্টায় পূরণ করা সম্ভব নয়।চাহিদাগুলো হলো প্রতিরক্ষা, আইন ও বিচার, সম্পদ উন্নয়ন ও শ্রম বিন্যাস, পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা, যোগাযোগ ও পরিবহন, সংবাদ ও তথ্য, বৈদেশিক ইত্যাদি।

উক্ত চাহিদা সমূহ পূরণের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সমাজতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত অর্থব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। অনু–১০।(সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি) মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।

অনু–১৩ ( মালিকানার নীতি)। উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বন্টন প্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ এবং এই উদ্দেশ্যে মালিকানা নিম্নরূপ হইবেঃ-
(ক) রাষ্ট্রীয় মালিকানা অর্থাৎ অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্র লইয়া সুষ্ঠু ও গতিশীল রাষ্ট্রায়ত্ব সরকারী খাত সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা;
(খ) সমবায়ী মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে সমবায় সমূহের সদস্যদের পক্ষে সমবায় সমূহের মালিকানা; এবং
(গ) ব্যক্তিগত মালিকানা অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তির মালিকানা।

অনু–১৪ (কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি)। রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে– কৃষক ও শ্রমিককে– এবং জনগণের অনগ্রসর অংশ সমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তিদান করা।

অনু ১৫ (মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা)। রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয় সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়ঃ

(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;
(খ) কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তি সংগত মজুরির বিনিময়ে কর্ম সংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার;
(গ) যুক্তি সংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং
(ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব,ব্যাধি বা পঙ্গুত্ব জনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতা হীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়াত্তাধীন কারণে অভাবগ্রস্থতার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার।

অনু–১৬( গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব)। নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণের ব্যবস্থা, কুটীর শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করিবে।

অনু–৪০( পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা)। আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ সাপেক্ষে কোন পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের কিংবা ব্যবসা পরিচালনার জন্য—- যোগ্যতা সম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের—– অধিকার থাকিবে।

অনু ৪২( সম্পত্তির অধিকার)। (১)– আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলিব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কতৃত্ব ব্যতীত কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহন, রাষ্ট্রায়ত্ব বা দখল কর যাইবে না।

কিন্তু সংবিধানে লিখলে অথবা সরকারী হুকুমের দ্বারা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা যায় না। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হয় আর্থিক উন্নয়নের মাধ্যমে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো মানুষের জীবনযাপন প্রণালী ও জীবনযাত্রার মানের ক্রমোন্নয়ন যার সাথে জড়িত শিল্পায়ন, মূলধন গঠন, উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন, বেকারত্ব দূর ইত্যাদি। অর্থনৈতিক চক্রের( সঞ্চয়– বিনিয়োগ– উৎপাদন– বন্টন– বিনিময়— ভোগ) প্রতিটি পর্যায়ে

মানুষের বঞ্চনাহীন অংশীদারিত্বের সক্ষমতা অর্জিত হলে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা সম্ভব হয়। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি আর্থ-সামাজিক কল্যাণের মূল কথা।কারণ সমাজে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে পণ্য ও সেবার প্রাপ্যতা প্রচুর বা যথেষ্ট যেটাই হোক না কেন মানুষের আর্থিক সামর্থ না থাকলে তা ভোগ করা সম্ভব হয় না।