ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র – ৪র্থ পর্ব

গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফজলুল হক
Published : 24 July 2011, 01:12 PM
Updated : 24 July 2011, 01:12 PM

রাষ্ট্র সোসিও-ইকোনমিক স্ট্রাকচারের (উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা, শ্রম বিন্যাস, উতপাদন ও বিনিময় সম্পর্ক, ফিন্যান্স ও ফিসক্যাল নীতি) উপর গড়ে উঠা সোসিও-পলিটিক্যাল প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র কোন ঐশী বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়। রাষ্ট্র জনগণের সৃষ্ট, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত এবং জনগণের চাহিদা পূরণ মূলক সেবাদানকারী সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সুতরাং রাষ্ট্র জনগণের প্রণীত আইন মোতাবেক পরিচালিত প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব জনগণের।

রাষ্ট্র যাতে ব্যক্তি,পরিবার,শ্রেণী বা কিছু লোকের স্বার্থ উদ্ধারকারী, একনায়কতান্ত্রিক গণবিরোধী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে না পারে; তার জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতার বিন্যাস অতীব গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র ক্ষমতা যাতে এক পদে বা এক ব্যক্তির কাছে কেন্দ্রীভূত হতে না পারে সে উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের তিনটা বিভাগে ক্ষমতার বিভাজন করা হয়। তিনটা বিভাগ হলো– (ক) আইন প্রণয়ন (সংসদ), (খ) আইন প্রয়োগ(নির্বাহী) এবং (গ) আইন ভঙ্গের প্রতিকার (বিচার)। তিনটা বিভাগ পরস্পর স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহারকারী হওয়া উচিত। তা না হলে ক্ষমতা বিভাজনের উদ্দেশ্য নস্যাত হয়ে যায়। সংসদ, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা যাতে এক পদে বা এক বিভাগের কাছে কেন্দ্রীভূত হতে না পারে সেটাই ক্ষমতা বিভাজনের মৌলিক লক্ষ্য। তবে রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রের উক্ত বিভাগগুলো যেহেতু জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহারকারী; সেহেতু ক্ষমতা ব্যবহারের বেলায় যে শর্ত পূরণের প্রয়োজন হয় তা হলো–(ক) জনগণের প্রণীত আইন অনুসারে ক্ষমতার প্রয়োগ এবং (খ) জনগণের কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকা।

রাষ্ট্র সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রয়োজন হয় ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমুহের। কিন্তু জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা যেহেতু রাষ্ট্রীয় বিভাগ সমুহের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়; সেহেতু ক্ষমতা প্রয়োগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রন জনগণ ও জনগণের প্রণীত আইনের দ্বারা হওয়া একান্ত আবশ্যক। তা না হলে ক্ষমতার প্রয়োগ একনায়কতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী হয় এবং জনগণ অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হয়। সমাজে এই ধরণের অবস্থা চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। প্রভুতন্ত্র, রাজতন্ত্র, কলোনীতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি বিপদগ্রস্ত সমাজের উদাহরণ।

চরম দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটা বিভাগ থাকলেও ক্ষমতার বিভাজন নেই ও জনগণের কাছে জবাবদিহি করার সুনির্দিষ্ট কোন ব্যবস্থা নেই( সংবিধানের ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ট, ৭ম, ৮ম, ৯ম, ১০ম ভাগের অনুচ্ছেদসমুহ দ্রষ্টব্য)। রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা (সংসদ, নির্বাহী, বিচার) মূলতঃ প্রধান মন্ত্রীর কাছে কুক্ষিগত থাকে। প্রধান মন্ত্রী তার সরকার, দল(এমপি সহ) ও আমলাদের নিয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেন। বাস্তবতা হলো রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। একমাত্র নির্বাচন ব্যতীত জনগণের কাছে জবাবদিহির পদ্ধতি না থাকায় রাষ্ট্র দুর্নীতিমুক্ত হতে পারে না।দুর্নীতি দমন কমিশন বা বিচার ব্যবস্থা দুর্নীতি বন্ধে কার্যকরী হয় না। কারণ এবসলুট পাওয়ার করাপ্টস এবসলুটলি।

রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী তথা সরকার, আমলা, দল ইত্যাদির কাছে কুক্ষিগত হওয়ায় জনগণ (সাইলেন্ট মেজরিটি) সমাজে ক্ষমতাহীন হয়ে যায়। ফলে দেশে ফতোয়াবাজী, নারী নির্যাতন, পিটিয়ে হত্যা, কাস্টডিতে নির্যাতন ও হত্যা, বিচার বহির্ভূত হত্যা, সন্ত্রাস, ঘুষ, দুর্নীতি প্রভৃতি লাগামহীনভাবে হতে পারে। জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেয় এবং হরতাল মিছিল ইত্যাদি করে। কারণ প্রতিবাদ করা ও প্রতিকার পাওয়ার কোন বিধিগত(সংসদীয়) পদ্ধতি নেই। একমাত্র আইন আদালত তাও সাধারণ জনগণের নাগালের বাইরে, ব্যয় বহুল, নাজেহালকারী হওয়ায় মানুষ এড়িয়ে চলে। স্থানীয় পর্যায় হতে সংসদীয় ব্যবস্থার( ইউনিয়ন সংসদ, উপজেলা সংসদ, জেলা সংসদ) মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহনের পদ্ধতির প্রচলন করলে সমাজ থেকে উপরোক্ত অপরাধসমুহ দূর করা সম্ভব হবে।