ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র- ৬ষ্ট পর্ব

গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফজলুল হক
Published : 29 July 2011, 02:07 PM
Updated : 29 July 2011, 02:07 PM

রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সার্বিক জনগণের মতামত দেয়ার নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি না থাকায় এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এক ব্যক্তি, কতিপয় ব্যক্তি ও দল নির্ভর হওয়ায় বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যার ৩টা উদাহরণ দিয়ে আমার এই সিরিজের লেখা শেষ করবো।

১। সংবিধানের ১৫শ সংশোধনী এই সংশোধনী দ্বারা সবাইকে খুশী করার একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। গণতন্ত্রের অর্থ সবাইকে খুশী করা বা সবার ইচ্ছানুসারে কাজ করা নয়; বরং সবার ঐক্যমত বা তা না হলে অধিকাংশের ইচ্ছা বা মতানুসারে কাজ করাকে গণতান্ত্রিক বলা যায়। "আমরা সবাই রাজা" ব্যাপারটা শুনতে সাম্যবাদ বা গণতান্ত্রিক শোনালেও বাস্তবে তা অরাজকতা সৃষ্টি করে। প্রাচীন বাংলায় রাজা শশাঙ্কের পর মাতসন্যায় যুগ তার উদাহরণ। শেষ পর্যন্ত সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজারা একমতে গোপালকে রাজা নির্বাচন করে অরাজকতার অবসান ঘটায়।

সংশোধনীতে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম রেখে বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি সহ ধর্মীয় দলগুলোকে খুশী করার চেষ্টা সফল হয় নাই; উপরন্তু বামপন্থী দল, মুক্তিযোদ্ধা, প্রগতিশীল জনগোষ্ঠীকে নারাজ করেছে।

ধর্ম নিরপেক্ষতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষকে খুশী করতে পারলেও ধর্ম ব্যবহারকারীদের অখুশী করেছে। বাঙ্গালী জাতীয়তা নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নারাজ করেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত করলেও বিকল্প পথে ক্ষমতা দখলকারীদের রুষ্ট করেছে।
সামরিক শাসন বা অনির্বাচিত ব্যক্তিদের ক্ষমতা দখল বন্ধ করতে যে ধারাগুলো দেয়া হয়েছে তা গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ঝুকিপূর্ণ করেছে।

অতএব ১৫শ সংশোধনীকে ভাল ও মন্দের পাল্লায় মাপলে মন্দের রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির দিকে ঝুঁকে যাবে।সবার ইচ্ছা বা মত প্রকাশের পর( সবাই একমত হতে না পারলে) অধিকাংশের মত গ্রহণই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি।আর তা নির্ধারণ করতে গণভোট একমাত্র উপায়। সবার মত গ্রহন বা সবার ইচ্ছাকে পূরণ করার চেষ্টা গণতন্ত্রের বদলে এনার্কি সৃষ্টি করে।বাংলাদেশের রাজনৈতিক
পরিবেশ এখন সেটাই প্রমাণ করছে।

২।জেলা প্রশাসকদের(ডিসি) কনফারেন্স সম্প্রতি জেলা প্রশাসকদের বলা হলো– তারা জনগণের সেবক; সেবাই তাদের কর্তব্য। শাসক ও সেবক বিপরীত ধর্মী। শাসক কোনদিন সেবক হতে পারে না।রাষ্ট্রের সেবাদানের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সেবা গ্রহণকারীদের কাছে জবাবদিহি করার ব্যবস্থা না থাকলে তারা সেবকের পরিবর্তে শাসকে পরিণত হয়। রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহারকারীরা যদি জনগণের নির্বাচিত সংসদের কাছে দায়বদ্ধ না হয়; তা হলে নির্বাহী ব্যবস্থা আমলাতান্ত্রিক শাসনে পর্যবসিত হয়।

জেলাস্তরে জেলা সংসদ না থাকায় জেলা প্রশাসকসহ জেলার সকল কর্মকর্তা জনগণের কাছে জবাবদিহি বিহীন ক্ষমতাধারীতে পরিণত হয়।তারা শুধু প্রধান মন্ত্রীকে চেনে; জনগণকে চেনে না বা চেনার দরকার হয় না। এই অবস্থা গণতন্ত্রের বদলে আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।ফলাফল দুর্নীতিপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রাপ্তি। ৭২-৭৪ সময়ে একব্যক্তি নির্ভর ব্যবস্থা চরমে পৌঁছেছিল। তখন থানার দারোগা থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত নির্দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর দিকে চেয়ে থাকতো। রাষ্ট্র পরিচালনায় এক ব্যক্তির(তিনি যত মহান ও বিরাট হোন না কেন) পক্ষে সব দেখা সম্ভব নয় এবং এধরণের ব্যবস্থার সুযোগে আমলাতন্ত্র ও দুর্নীতি জেকে বসে। রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতার গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রায়ন(স্থানীয় সংসদ ব্যবস্থা) অত্যাবশ্যক।

৩।গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারণায় আমরা বিকেন্দ্রায়নের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ,জেলা পরিষদ গঠনের চিন্তা করি। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতা বিভাজনের নীতি ( সংসদ, নির্বাহী, বিচার)অনুসৃত না হলে যে নির্বাহী ক্ষমতার একচ্ছত্র দৌরাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত হয় সে কথা ভাবি না।

ইউনিয়ন পরিষদের সাথে ইউনিয়ন সংসদ এবং ইউনিয়ন বিচার ব্যবস্থা না থাকায় সকল ক্ষমতা চেয়ারম্যানের কাছে কুক্ষিগত হয়; যার ফলে নানা দুর্নীতি ও উৎপীড়নের সৃষ্টি হয়।উপজেলা পরিষদ( যদিও এখন চালু হয় নাই) ব্যবস্থা উপজেলা সংসদ ও উপজেলা বিচার ব্যবস্থা ব্যতীত এবং জেলা পরিষদ ব্যবস্থা জেলা সংসদ ব্যতীত চালু করা হলে নির্বাহী ক্ষমতার দুর্নীতি ও দৌরাত্মের আরও প্রসার ঘটবে; শুধু বিচার ও আইন আদালত দিয়ে যা নিয়ন্ত্রন করা যাবে না। রাষ্ট্র ক্ষমতার ৩টা বিভাগের বিকেন্দ্রায়ন একসাথে করাই সমাধান।