মেহিকোর সাহিত্যিক এলেনা পনিয়াতৌস্কার নবতিতম জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

আলম খোরশেদআলম খোরশেদ
Published : 11 Sept 2011, 04:57 PM
Updated : 19 May 2022, 07:05 AM

তাঁর পুরো নাম এল্যান এলিজাবেথ লুইজ আমেলি পাওলা দোলোরেস পনিয়াতৌস্কা আমর । তবে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জগতে তিনি সংক্ষেপে এলেনা পনিয়াতৌস্কা নামেই সমধিক পরিচিত। ফ্রান্সে জন্ম-নেয়া, ফরাসি বংশোদ্ভূত পনিয়াতৌস্কা দশ বছর বয়স থেকেই অবশ্য মেহিকোর বাসিন্দা এবং এই মুহূর্তে মেহিকোর জীবিত লেখকদের মধ্যে প্রবীণতম ও শ্রদ্ধেয়তমও বটে, যিনি লেখালেখি করেন মূলত তাঁর পালক-দেশের ভাষা স্প্যানিশেই, যদিও ফরাসি ও ইংরেজিতেও তিনি সমান স্বচ্ছন্দ। ১৯৩২ সালের মে মাসের ১৯ তারিখে জন্মগ্রহণকারী এলেনা পনিয়াতৌস্কা নব্বই বছর পূর্ণ করলেন আজ।

মেহিকানো সাহিত্যের Grande Dame তথা প্রধানা প্রমীলা হিসাবে পরিচিত পনিয়াতৌস্কা একাধারে একজন ডাকসাইটে সাংবাদিক ও কুশলী সৃজনসাহিত্যিক; ছোটগল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, সাংবাদিক গদ্য, প্রবন্ধ, জীবনী ইত্যাদি মিলিয়ে যাঁর গ্রন্থসংখ্যা পঞ্চাশটির মতো। পনিয়াতৌস্কার সাংবাদিকতা, সাহিত্যকর্ম ও সামাজিক-সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের প্রধান লক্ষ্য ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু মেহিকানো সমাজের নিচুতলার মানুষেরা; তাদের ওপর সংঘটিত শোষণ-নির্যাতন, এর বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, তাদের সংগ্রামমুখর জীবন, আশাআকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-ভালবাসা, সর্বোপরি বন্ধনমুক্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের বিষয়টি। তাঁর সব লেখা ও কাজে ঘুরে ফিরে এই বিষয়গুলোরই সম্যক প্রতিফলন ও প্রতিধ্বনি লক্ষ করা যায়; সেইসঙ্গে অবশ্যই নারীর সার্বিক স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নও তাঁর চিন্তা ও কর্মবিশ্বের অপর প্রধান উপজীব্য। তাই তিনি মেহিকোর সাহিত্যসমাজে একদিকে একজন আপসহীন নারীবাদী ও অন্যদিকে The Red Princess তথা 'রাঙা রাজকন্যা' নামেও সমান খ্যাতিমান।

পনিয়াতৌস্কা মাত্র একুশ বছর বয়সে এক্সেলসিয়র(Execior) এবং নবেদাদেস দে মেহিকো(Novedades de Mexico) নামে দুটো কাগজের জন্য লিখতে শুরু করেন এবং অদ্যাবধি তা অব্যাহত রেখেছেন। ১৯৫৪ সালে Lilus Kikus নামে একটি ছোটগল্প গ্রন্থের মাধ্যমে সাহিত্যজগতে তাঁর আত্মপ্রকাশ হলেও, মূলত ১৯৬৮ সালের মেহিকোর বিখ্যাত ছাত্র-আন্দোলন নিয়ে লেখা অসাধারণ সাহিত্যিক প্রতিবেদন The Night of Tlatelolco প্রকাশের মাধ্যমেই তিনি সবার মনোযোগ ও শ্রদ্ধার আসনটুকু জয় করতে সমর্থ হন। এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি পৃথিবীর বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে রীতিমতো একটি আন্তর্জাতিক ক্লাসিকের মর্যাদা অর্জন করেছে। এরপর নিয়মিত বিরতিতে তাঁর আরও বহু, বিচিত্রমুখী বই প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: The Last Turkey (১৯৮২), Nothing, Nobody: The Voices of the Earthquake (১৯৮৮), Frida Kahlo: The Camera Seduced (১৯৯২), The Soldier Women (১৯৯৯), The Heart of the Artichoke (২০০৩), Nursery Rhymes of the Naughty Girl (২০০৮) ইত্যাদি। বর্তমানে মেহিকো শহরে বসবাসরত পনিয়াতৌস্কা সাহিত্য ও সমাজকর্মে এখনও সমান সরব ও সক্রিয়। তাঁর বহুবিধ সামাজিক, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে: La Jornada নামে একটি সংবাদপত্র, Fem নামে একটি নারীবাদী ম্যাগাজিন, Siglo XXI নামক একটি প্রকাশনী সংস্থা এবং মেহিকোর জাতীয় চলচ্চিত্র ইন্সটিটিউট Cineteca Nacional ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা।

তাঁর নব্বুইতম জন্মবার্ষিকীর এমন মাহেন্দ্রক্ষণে এই মহীয়সী সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সমাজসেবীকে জানাই আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও সংগ্রামী অভিবাদন। সেই সঙ্গে তাঁর একটি অনু-সাক্ষাৎকারের অনুবাদও পেশ করছি বিডিনিউজের পাঠকসমীপে। অনূদিত সাক্ষাৎকারটি যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত Modern Poetry in Translation পত্রিকার বর্ষ ২০২১: সংখ্যা ২ থেকে উৎকলিত হয়েছে। এটি ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছেন Amanda Hopkinson ও Nick Caistor । –অনুবাদক

আমান্দা হপকিন্সন: Rondas de la Niña Mala বা নার্সারি রাইমস অভ আ নটি গার্ল, এটিই আপনার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ; এর কারণ কী? এটি কি খুব তাড়াহুড়োয় লেখা, না কি অনেক সময় নিয়ে লিখেছেন আপনি?


এলেনা পনিয়াতৌস্কা: আমার বয়স যখন কম ছিল, তখন প্রেমে পড়ামাত্রই আমি কবিতা লিখতাম। আমি সেগুলো আমার প্রেমিকদের দেখাইনি কখনও, কেননা আমার মনে হত সেসব তেমন ভালো কিছু হয়নি। ওক্তাবিয়ো পাস সেগুলোকে ছাপার পরামর্শ দেন এবং তিনি এমনকি সেসবের সম্পাদনার কাজেও সাহায্য করেন আমাকে।

আমান্দা হপকিন্সন: এর পরে তাহলে আর কোনো কবিতাই লেখেননি আপনি, না কি লিখেছেন কিন্তু প্রকাশের কথা ভাবেননি?

এলেনা পনিয়াতৌস্কা: আমার মনে হয় না এর বাইরে আর কোনো কবিতা আছে আমার, যদিও আমার বইগুলোর ভেতরে এখানে সেখানে হয়ত দুয়েকটি কবিতার দেখা আপনি পেলেও পেতে পারেন। আমি সাংবাদিকতা বিষয়েই পুরোপুরি দায়বদ্ধ ছিলাম, কেননা সেটা আমার জীবিকাও ছিল। অমি অন্যান্য বিষয়ে বইপত্র লিখে গেছি ক্রমাগত, ফলত কবিতার স্থান ছিল দুই নম্বরে, যদিও আমার প্রচণ্ড পছন্দ ও মুগ্ধতা ছিল রোসারিও কাস্তেয়ানোস, ওক্তাবিয়ো পাস, গাব্রিয়েল সাইদ এবং রামোন লোপেস বেলার্দের মতো ঐতিহ্যবাহী কবিদের প্রতি।

আমান্দা হপকিন্সন: এই সংকলনের বিষয়টি আপনি কীভাবে ঠিক করলেন, না কি সেটা নিজ থেকেই ধরা দিয়েছে আপনার কাছে?

এলেনা পনিয়াতৌস্কা: সবগুলো কবিতা একত্রে জড়ো করার পর আমি সেগুলোর নাম দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম, নার্সারি রাইমস অভ আ নটি গার্ল, যাতে করে কেউ সেগুলো থেকে কোনো গুরুগম্ভীর ও উচ্চমার্গীয় কবিতার প্রত্যাশা না করেন। এই নামটা নেয়া হয়েছে শৈশবের খেলাগুলো থেকে, যা আমরা খেলতাম গোল হয়ে একটা বৃত্তের ভেতরে, অনেকটা কুতকুত খেলার ধরনে, মেহিকোতে যেটাকে বলা হতো আয়েরোপ্লেন, বা অন্য আরও কিছু খেলা যেগুলো আমরা খেলতাম,এখন যা আমাদের নাতিনাতনিরাও খেলছে।


আমান্দা হপকিন্সন: বাড়িতে আপনি কি ঘুমপাড়ানি গান শুনে বড় হয়েছিলেন?

এলেনা পনিয়াতৌস্কা: জীবনের প্রথম দশ বছর আমি কেবল ফরাসি, অর্থাৎ আমার মাতৃভাষাতেই কথা বলতাম। তখন ছোটদের সাহিত্যের একজন লেখক ছিলেন, ফরাসি, নাম কঁতেস দ্য সেগ্যুর, আমি নিশ্চিত আমার বয়সী বাচ্চারা সবাই তাঁর বই পড়ত, আর তাছাড়া বইগুলো দেখতেও খুব আকর্ষণীয় ছিল।

আমান্দা হপকিন্সন
: আপনার একটি বহুবিখ্যাত কবিতা গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল বিষয়ে বিশেষ কিছু বলার আছে আপনার?

এলেনা পনিয়াতৌস্কা: আমি এই কবিতাটি আমার নিজের কাছেই রেখেছিলাম; একদিন ওক্তাবিয়ো পাস আমার বাবার বাড়িতে খেতে আসেন। তিনি আমার লেখাপত্র দেখতে চান এবং বলেন, 'তোমার কাছে নিশ্চয়ই কিছু কবিতাও রয়েছে'। আমি তখন তাঁকে সেগুলো দেখাই এবং তিনি সেসব খুব পছন্দ করেন। এরপর এরা, মানে যে প্রতিষ্ঠানটি আমার প্রথম দুটো বই আস্তা নো বের্তে হেসুস মিও এবং লা নোচে দে ত্লাতেলোল্কো প্রকাশ করেছিল, তারাই সেটি ছাপার সিদ্ধান্ত নেয়।


পুনশ্চ
পাঠকদের জন্য এখানে উপরোল্লিখিত গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল কবিতাটির একটি তড়িঘড়ি তরজমাও উপস্থাপিত হলো।

অভিভাবক দেবদূত

মা আমাকে জানালাটা
হাট করে খুলে রাখতে বলেন
যেন তিনি ভেতরে আসতে পারেন,
অভিভাবক দেবদূত।

আমার বিছানার শিয়রে
দেবদূত তাঁর
পাখাদের সাহায্যে
শ্বাস নেন।

ফ্রান্সে,
শাদা পোরসিলেনের
দেবদূত
চেরি-লাল ঠোঁটে
হেসে উঠতেন।

টিস্যু পেপার,
স্ট্র আর পেস্ট
কিঞ্চিৎ বেগুনি রঙের,
প্রত্যেকেই
মেহিকোর দেবদূতের স্মারক।
বিদ্রোহের দামামা-বাজানো
প্রতিশোধকামী দেবদূত।
এক পাখসাটে
তাঁর চুল খাড়া হয়ে যায়,
সংবাদপত্র দিয়ে বানানো
জাহাজের মুকুট তাঁর মাথায়।
চতুর্মুখী বাতাসের কাছে তিনি
রক্তলাল কাগজের কাটিং বিতরণ করেন।
খবরের-কাগজ বিক্রেতা দেবদূত
পথচারীরা
তীক্ষ্ণ সূঁচের আঘাতে
তাঁকে পাখার নিচে বিদ্ধ করে।
'তুমি তোমার পাখাদের ভুলে গেছো',
ফিরতিপথে ঈশ্বর বলেন।
'আমি কী করে তাদের ভুলে যেতে পারি
তারা যখন আমাকে এভাবে আঘাত করে?'

ঈশ্বর তাকে ভর্ৎসনা করেন।
রাত্রিবেলায়
তিনি নক্ষত্রখচিত শিরোনাম ছড়িয়ে দেন,
শয়নকক্ষে বয়ে আনেন
বিখ্যাত ভল্লুক।

সকালে,
দেবদূত,
গোলাপি ফ্লেমিঙ্গো,
কেমন ফ্যাকাসে।

তিনি জানালা দিয়ে
পালিয়ে যান
স্বর্গদের
নক্ষত্রবঞ্চিত করে।