সিরিয় শিশুর আত্মসমর্পণের ছবি: আমাদের সন্তানেরা নিরাপদ কী?

গৌতম হালদার
Published : 1 April 2015, 06:48 AM
Updated : 1 April 2015, 06:48 AM

বেশ কিছুদিন ধরে টুইটার ফেসবুক সহ অধিকাংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কল্যানে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে টার্কি ফটো সাংবাদিক ওসমান সাগিরালি'র যুগান্তকারী এক ছবি, যাতে ফুটে উঠেছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ায় ভীতসন্ত্রস্ত চার বছর বয়সী এক শিশুর ক্যামেরার লেন্সকে বন্দুকের নল ভেবে দু-হাত মাথার উপরে তুলে ঠোঁট কামড়ে আত্মসর্পনের দৃশ্য। টুইটারে অসংখ্যবার টুইট হওয়া ছাড়াও ফেসবুকসহ অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার হওয়া ছবিটা কতটা হৃদয়বিদারক, তা বুঝতে না পারার কোনো কারণ নেই। যে কোনো বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই ছবিটার দিকে তাকালে সহসাই অনুভব করবেন কী নিদারুন জিবনশংকা থেকে এই চার বছর বয়সী আতংকগ্রস্থ শিশুটি দাঁতে ঠোঁট কামড়ে হাত দুটো উপরে তুলে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছে!

স্বাভাবিকভাবে চার বছর বয়সী কোনো শিশুই জীবন কী? মৃত্যু কী? বন্দুক কী? কিংবা হত্যা কী? এসব কিছুই বুঝে না, বুঝতে পারে না, যদিনা এই প্রত্যেকটি ঘটনা তার জীবনে না ঘটে। ভেবে বাকরুদ্ধ হতে হয় কি করে এইটুকু শিশুটি প্রাণভিক্ষার এই সর্বশেষ অবলম্বনটি জানলো! কী কঠিন আর পৈশাচিক বর্বরতার স্বাক্ষী তাকে হতে হয়েছে, যে সে বুঝে গেছে নিশ্চিত মৃত্যু যখন মুখোমুখি, তখন জীবন বাঁচানোর সর্বশেষ উপায় হলো হাত তুলে সারেন্ডার বা আত্মসমর্পণ, এই ছোট বয়সেই! আমি ভাবতে পারিনা মাত্র চার বছর বয়সের এই শিশুটিকে এই ছোট্ট জীবনে কতটা বর্বরতা, পৈশাচিকতা, নির্মমতা আর বিভৎসতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কতটা দমন-পীড়ন, নির্যাতন আর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সহ্য করতে হয়েছে, শিশুটিকে! আমরা হয়ত কল্পনার জগত থেকে উপলব্ধি করতে পারব কতবড় মানবিক আর মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় পার করতে হচ্ছে সিরীয় শিশুদের, যা শুধুই উপলব্ধি, প্রকৃত অবস্থা যা থেকে যোজন যোজন দূরত্বে। কারণ উপলব্ধি আর বাস্তবতা কখনো এক হতে পারেনা।

আমি ভাবতে পারছিনা, গা শিউরে উঠছে, চোখ জল এসে যাচ্ছে। আমি এই মনস্তাত্ত্বিক পীড়ন, যা সিরীয় এই প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছে, তাকে নিন্দা জানানোর ভাষার খুঁজে পাইনা। ধিক্কার দেই নিজেকে মানুষ ভেবে। কারণ এই নির্মমতা হার মানায় পশুদের মমত্ববোধকেও।

আমি খুঁজতে চেষ্টা করছি আমার দেশের শিশুরা, আমার সন্তানেরা, আমার বর্তমান প্রজন্মের সন্তানেরা, আগামী দিনের অবলম্বন, আমার নিধিরা এই সিরীয় শিশুটির থেকে কতটা নিরাপদ আছে? আমরা তাদেরকে কতটুকু ভীতিমুক্ত জীবন যাপনের নিশ্চয়তা দিতে পেরেছি। কারণ আমার দেশে তো যুদ্ধ নেই! যুদ্ধ থাকার কথাও নয়, আমার দেশ যুদ্ধ থেকে মুক্তি পেয়েছে আজ প্রায় পয়তাল্লিশ বছর। আর আমরা শান্তিপ্রিয় স্বাধীন দেশের সভ্য নাগরিক বলে সবসময়ে দাবি করে আসছি দীর্ঘদিন ধরে! আমার শিশুর মধ্যে জীবন সংশয় থাকতে পারে না, থাকার কথা নয়।

যদি বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে একবার উপলব্ধিতে চেষ্টা করি, আমি খুঁজে পাইনা, আমার দেশের পরবর্তী প্রজন্ম, আমার সন্তানেরা কোনভাবেই সিরীয় সন্তানদের থেকে কোনো অংশে নির্বিঘ্ন জীবন যাপনের নিশ্চয়তা আমরা দিতে পেরেছি। কারণ আমার সন্তানেরা পেট্রল বোমার বিভৎসতায় সমান আতঙ্কগ্রস্থ।


আমরা সব নির্মমতার অবসান চাই, আমাদের চাওয়া সুন্দর ভাবিষ্যত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, আমার সন্তানদের আগামী দিনের সুন্দর নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। তাই যদি হয় তবে কেন আজ ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের বলী এই কচি ছোট্ট শিশুটির মত আরো শত শত শিশু? কি দোষ এদের, যা তাদেরকে এই বর্বরতার সম্মুখীন হতে বাধ্য করলো?

একজন পিতার স্থান থেকে বিবেচনার করতে গেলে নিজেকে মানুষ নয় শুধু, একজন ব্যর্থ মানুষ হিসেবে ভাবতেও ঘেন্না হয়। মনে মনে শুধু বলতে হয়, ক্ষমা করে দিও সোনা তোমরা আমাকে। আমি পারলাম না, আমি তোমার ব্যর্থ পিতা, আমি পারলামনা তোমাকে তোমার সুন্দর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে, এ আমার চরম অযোগ্যতা, আমার চূড়ান্ত ব্যর্থতা। আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমার অনুকম্পায়, কারণ  পিতা হিসেবে ক্ষমা চাইবার নুন্যতম যোগ্যতাটুকুও যে আমার নেই।

জানি, জাতি হিসেবে আমাদেরকে এর জন্য দাড়াতেই হবে আগামীর কাঠগড়ায়।

প্রশ্ন জাগে সিরিয় শিশুর মধ্যে ঘটে চলা মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় থেকে আমার দেশের রাজনৈতিক বর্বরতায় আতঙ্কিত এই প্রজন্মের শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় কোনো অংশে কম কী?