দেখে এলাম বোরোবুদুর মন্দির

v_sunandapriyo
Published : 1 April 2015, 05:25 PM
Updated : 1 April 2015, 05:25 PM


মানুষের স্বপ্ন নাকি একদিনে পূর্ণ হয় না। ইচ্ছে থাকলে আস্তে আস্তে পূর্ণ হয়। ইন্দোনেশিয়ার সে বিখ্যাত বোরোবুদুর মন্দির দেখার স্বপ্ন-স্বাদ অবশেষে পূর্ণ হল। যেদিন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাভাযাত্রীর ডায়েরি ও বোরোবুদুর কবিতাটি পড়ি, তখন থেকে আমার কল্পনার জগতে বোরোবুদুর মন্দিরের ছবি ভেসে ওঠে। বোরোবুদুর নিয়ে তেমন লেখা আর চোখে পড়েনি, সে কবে কবিগুরু জাভাযাত্রী হয়ে বোরোবুদুর গিয়ে বুদ্ধের শরণ নিয়েছিলেন।

এ সময়ে এসে শিহরিত হই, অবাক বিস্ময় জাগে মনে। কবিগুরু নাকি দুবার বুদ্ধ প্রণাম করেছিলেন, একবার বোরোবুদুর মন্দিরে, অন্যটা বুদ্ধগয়া মহাবোধি মন্দিরে।

ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণটা হঠাৎ করেই হল। গত ৩ ও ৪ মার্চ ২০১৫ ইন্দোনেশিয়ার যুকজাকার্তা ও বোরোবুদুর মন্দিরে দুদিনব্যাপী হয়ে গেল উচ্চপর্যায়ের বৌদ্ধ ও মুসলিম নেতাদের সম্মেলন। সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বৌদ্ধ ও মুসলিম নেতারা অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় তথ্যমন্ত্রী জনাব হাসানুল হক ইনু, পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পদক ও সৌগত সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় আমি নিজে। সন্মেলনে যোগদানের কারণেই বোরোবুদুর ভ্রমণ। বোরোবুদুর সর্ম্পকে তেমন জানা না থাকলেও প্রকৌ. জ্যোতি বিকাশ বড়ুয়ার লেখা ছোট ভ্রমণ বই 'পাষাণের মৌনতটে' ছিল অভিজ্ঞতার সম্বল।

আমাদের টিকেট ছিল ঢাকা থেকে কুয়ালামপুর, কুয়ালামপুর থেকে জার্কাতা মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স। জার্কাতা থেকে যুকজাকার্তা, গারুদা ইন্দোনেশিয়া। গারুদা বিমানের অর্থ আবিষ্কার করলাম সে প্রকৌ. জ্যোতি বিকাশ বড়ুয়ার লেখা 'পাষাণের মৌনতটে' ছোট ভ্রমণ বই থেকে। ইন্দোনেশিয়ায় বোরোবুদুর মন্দিরের পর চাঁদি শিবা, চাঁদি ব্রহ্মা, চাঁদি বিষ্ণু নামে পাশাপাশি মন্দির রয়েছে। এগুলোও ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করে। চাঁদি মানে মন্দির; বার্মায় যেমন জাদি বলে। আর ওই তিন মন্দিরের বাহন হল শিবা ষাঁড়, ব্রহ্মার হংস আর বিষ্ণুর গরুড়, যাকে ইন্দোনেশিয়ানরা গারুদা বলে। মুসলিম প্রধান দেশ হলেও, মনে হল তাদের অতীত ঐতিহ্যকে রক্ষা ও লালন করতে সচেষ্ট। যদিও এ তিন মন্দির ভাগ্যে ছিল দূর থেকে দেখার।


২ মার্চ যুকজাকার্তা পৌঁছেই হোটেল শেরাটনে থাকার ব্যবস্থা হল। রুমে ব্যাগ রেখেই আমাদের সন্মেলনে আগত সবাইকে রাতের যুকজার্কাতা ভ্রমণের সুযোগ করে দিলেন সন্মেলন কর্তৃপক্ষ।
গুরুদেবকে রুমে রেখে আমিও ঘুরতে বের হলাম। গাইড যিনি ছিলেন, মাইক্রফোনে বুঝিয়ে দিচ্ছেন একটার পর একটা। শহরটি মূলত শিক্ষা কেন্দ্র। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। রাস্তার ফুটপাটে ছাত্রদের খাওয়ার হোটেল দেখে কলকাতার কথাই মনে হল। রাতে খাওয়ার ব্যবস্থা হল শেরাটনের বাইরে আরেকটি হোটেলে। খাবারগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। আমাদের কক্সবাজারের খাবারের সঙ্গে অনেকখানি মিল। অক্টোপাসও দিল খাবারের সঙ্গে। যার যেটা রুচিমতো খাচ্ছে। আমি আমের ও পেপের জুস খেলাম। তারা জানে, থেরবাদী ভিক্ষুরা রাত্রে আহার গ্রহণ করে না। সে কারণে চার-পাঁচরকম জুসের ব্যবস্থা ছিল।

আমার মনোযোগ অনেকখানি সন্মেলন ও বোরোবুদুর মন্দির। পরের দিন সন্মেলন শুরু হল শেরাটনের বল রুমে। সন্মেলন সর্ম্পকে আলোচনাটা এখানেই থাক।
পরের দিন সকাল ৮.৩০ মিনিটে হোটেল থেকে বোরোবুদুর মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হলাম। যতই যাচ্ছি আমি, শিহরিত ও আপ্লুত হচ্ছি। রাস্তার পার্শ্বে বুদ্ধমূর্তি, গণেশ ইত্যাদির দোকান। আর থাইল্যান্ডের মতো রাম্বুটান ফলের গাছ। থোকা থোকা রাম্বুটান ফল ধরেছে। আবহাওয়াও ছিল চমৎকার। আগের দিন থেকে বৃষ্টি। কিন্তু বোরোবুদুর মন্দির পৌঁছে বৃষ্টির বালাই নেই। তারাও বলল, এটা আমাদের সৌভাগ্য।
বোরোবুদুর মন্দিরে পৌঁছে রেস্টহাউজে বসা হল। সেখানে বৌদ্ধ ও মুসলিম নেতাদের যৌথ বিবৃতি ঘোষণা হল, যেটা আগের দিন সন্মেলনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যৌথ বিবৃতির পর গ্রুপ ছবি তোলা হল বোরোবুদুর মন্দিরকে পেছনে রেখে। তার পরেই কাঙ্ক্ষিত বোরোবুদুর দেখার পর্ব। গুরুদেব সত্যপ্রিয় মহাথেরকে রেস্টহাউজে বসিয়ে দিয়ে আমিও গ্রুপের সঙ্গে রওনা দিলাম। কারণ, বয়সের কারণে মন্দির চূড়ায় ওঠা তাঁর জন্য অসম্ভব। মাননীয় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু যাবেন কি না দ্বিধা করতে লাগলেন। কারণ মন্ত্রীকে প্রোটোকল দিতে আসা আমাদের ইন্দোনেশীয় রাষ্ট্রদূত মো. নাজমুলও মন্ত্রীকে নিরুৎসাহী করলেন।


বোরোবুদুর মন্দিরের ইতিহাস-ঐতিহ্য যৎসামান্য এবং কবিগুরুর 'বোরোবুদুর' কবিতা থেকে পঙক্তি বললাম, সঙ্গে কবিগুরু যে বোরোবুদুর মন্দির ভ্রমণ করে গেলেন, সে সময়ের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করলাম, আরও বললাম মাননীয় মন্ত্রী আর কী আসার সুযোগ হবে? তাতে মন্ত্রী উৎসাহিত হলেন। সবাই গ্রুপ বেঁধে উঠতে লাগলাম। ওঠার আগে কাপড়ের উপর পরনের জন্য গামছাসদৃশ কাপড় ছিল। সবাই পরল, আমারটা কাঁধে নিলাম। এটি মন্দিরে ওঠার সংস্কৃতি বলেই মনে হল।
মন্দিরের একটা সিঁড়ি উঠছি– আর মন্দিরের ধাপগুলোতে কামলোক বা কামধাতু অংকিত চিত্র, রূপলোক বা রূপধাতু সর্বোচ্চ ধাপ অরূপলোক বা অরূপধাতু মন্দির প্রতিষ্ঠার দর্শন মন্ত্রী মহোদয়কে বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম, আমি যেন তাঁর গাইড হয়ে গেলাম।

মন্দিরের প্রতিটা স্তূপের সঙ্গে একটা করে বুদ্ধমূর্তি। মিথ আছে যে, হাতে যদি বুদ্ধমূর্তি স্পর্শ করা যায়, তাতে নাকি সৌভাগ্য হয়। মন্ত্রী মহোদয়কে বলার পর তিনি চেষ্টা করে বুদ্ধমূর্তি র্স্পশ করলেন, আমিও র্স্পশ করলাম । কিন্তু একজন র্স্পশ করতে পারলেন না। প্রথম থেকে যে উনার অশ্রদ্ধা ভাব দেখতে পেলাম। মন্ত্রী মহোদয় বোরোবুদুর দেখে বিস্মিত হলেন। পযর্টক আকর্ষণের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে বোরোবুদুরকে। বোরোবুদুর যেতে রাস্তার দুপাশে ধানক্ষেত, যেন মেঠোপথ ধরে যাচ্ছি। একসময় প্রাণ চাঞ্চল্য ছিল, এখন নির্জন নিরবতা। পাহাড়ের কোল ঘেষে অপরূপ রূপময়তায় বোরোবুদুর নিশ্চিন্তে ধ্যানময় বুদ্ধের রূপ ধরে বসে আছে।


কবিগুরু লিখেছিলেন, 'একদিন অনেক মানুষ মিলে এই মন্দির, এই মূর্তি তৈরি করে তুলছিল। সে কত কোলাহল, কত আয়োজন, তার সঙ্গে ছিল মানুষের প্রাণ। এই প্রকাণ্ড প্রতিমা যেদিন পাহাড়ের উপর তোলা হচ্ছিল, সেদিন এই গাছপালার মধ্যে এই সূর্যালোকে উজ্জ্বল আকাশের নিচে মানুষের বিপুল একটা প্রয়াস সজীবভাবে এখানে তরঙ্গিত।'

বোরোবুদুর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা শৈলেন্দ্র রাজবংশ। রাজা শৈলেন্দ্রের পুত্র রাজা ইন্দ্র। ইন্দ্রের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তার জ্যেষ্ঠপুত্র সমরাতুংগ। তিনি যেমন ধর্মপরায়ণ ছিলেন, তেমনি শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ।

৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। বছরের পর বছর এর নির্মাণ কাজ চলতে থাকলে রাজা সমরাতুংগও মারা যান। রাজা সমরাতুংগের মৃত্যুর পর তার মেয়ে প্রমোদাবর্ধনী সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। অসমাপ্ত কাজ তিনিই সমাপ্ত করেন। এ মন্দির নির্মাণ করতে তিরিশ বছর লেগে যায়। বোরোবুদুরকে মন্দির না বলে স্তূপ বলাই বাহুল্য। কারণ পিরামিড আকৃতির মন্দির অনেকগুলো স্তূপের সমাহার চারদিকে। উপর থেকে দেখলে মনে হবে এক ফুটন্ত পদ্ম। মন্দিরের মূল উচ্চতা ছিল ৪২ মিটার, বজ্রপাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ৩৫.২৯ মিটার। বোরোবুদুর মন্দিরে ওঠার সময় চারদিকের চারটা তোরণসহ প্রবেশদ্বারের সিঁড়ি রয়েছে।


যে বৌদ্ধ দর্শন বোরোবুদুর মন্দিরে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তা হল– প্রথম কামলোক, তার স্তরে অংকিত চিত্র, দ্বিতীয় ধাপে রূপলোক এবং অরূপলোকসহ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কল্পনায় গঠিত স্থাপত্যশৈলী। প্রথম স্তরে মানুষ কামনা-বাসনায় লিপ্ত থাকে, দ্বিতীয় স্তরে ধীরে ধীরে মানুষ কামনা-বাসনাকে বিদূরিত করে আলোর দিকে উপনীত হয়, আর তৃতীয়তে তৃষ্ণা ক্ষয় করে নির্বাণে উপনীত হন।

প্রায় দেড়শত বৎসর বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের সমাগমে উজ্জ্বল ছিল বোরোবুদুর মন্দির। রাজা শৈলেন্দ্র রাজবংশের পতনের পর বোরোবুদুর তাঁর ঐতিহ্য হারিয়ে অবহেলিত হয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তথা ভূমিকম্প ইত্যাদির কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ব্রিটিশ সময়ে পরিত্যক্ত, জংঙ্গলাকীর্ণ বোরোবুদুর আবার প্রাণ ফিরে পায়।


অল্পসময়ে বোরোবুদুর দেখে আমার তৃপ্তি মিটল না। হয়ত আবার যেতে হবে এ বোরোবুদুর মন্দির দেখবার জন্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মন্দির দেখে লিখেছেন :
'কত যাত্রী কত কাল ধরে
নম্রশিরে দাঁড়ায়েছে হেথা করজোড়ে।
পূজার গম্ভীর ভাষা খুঁজিতে এসেছে কতদিন
তাদের আপন কণ্ঠ ক্ষীণ।
ইস্পিতপুঞ্জিত তুঙ্গ পাষাণের সংগীতের তানে
আকাশের পানে
উঠেছে তাদের নাম,
জেগেছে অনন্ত ধ্বনি 'বুদ্ধের শরণ লইলাম'।
………
'পাষাণের মৌনতটে যে বাণী রয়েছে চিরস্থির
কোলাহল ভেদ করি শত শতাব্দীর
আকাশে উঠিছে অবিরাম
অমেয় প্রেমের মন্ত্র 'বুদ্ধের শরণ লইলাম'।