মির্জাগঞ্জ উপজেলা সদরে মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনা: প্রতিকারে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা

আশফাক আবীর হাসিব
Published : 25 March 2016, 02:39 PM
Updated : 25 March 2016, 02:39 PM

গত ২৪ মার্চ, বৃহস্পতিবারর, সকাল ৯.৩০ ঘটিকায় পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার সুবিদখালীতে একটি মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা-বরগুনা মহাসড়কে ইসলাম পরিবহনের একটি বাসের সাথে মোটর সাইকেলের সংঘর্ষে মোটরসাইকেলের চালকসহ এক কলেজ ছাত্রী আহত হয়। সুবিদখালী মহিলা ডিগ্রী কলেজের ছাত্রী আহত রুমাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। মোটরসাইকেল চালক মির্জাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছে। ঘাতক বাসটিকে আটক করে মির্জাগঞ্জ থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে। বাস মালিক বা চালকের শাস্তি হলেও অকালে ঝরে যেতে পারতো একটি তাজা প্রাণ। আল্লাহ্‌ তায়ালা যেন রুমাকে হেফাযত করেন, যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়।

দূর্ঘটনার উপরে অনেক সময় আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। চালকদের অসাবধানতা বা পথচারীর অসাবধানতায় দূর্ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু আমরাই একটি ব্যস্ত, জনবহুল এলাকাকে দূর্ঘটনা প্রবণ অঞ্চলে পরিণত করি, যা দূর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ। সুবিদখালীতে সড়ক দূর্ঘটনার অন্যতম কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ন।

ঢাকা-বরগুনা মহাসড়ক মির্জাগঞ্জ উপজেলা সদরের সুবিদখালী বন্দরের বুকের উপর দিয়ে বরগুনা শহরে মিশেছে। এই মহাসড়ক তৈরির কারণে ঢাকার সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। ধীরে ধীরে এই সড়কে বিভিন্ন দূরপাল্লার যানবাহনের চলাচল বৃদ্ধি পেতে থাকে। দিন যত যাবে যানবাহন চলাচলের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকবে। সড়ক চালুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এই একই স্থানে বেশ কয়েকটি দূর্ঘটনা ঘটেছে। প্রায় সবগুলো ঘটনাই দূরপাল্লার ঢাকা গামী বাসের মাধ্যমে ঘটেছে। মহাসড়ক স্থাপনের পূর্বেও এখানে রাস্তা ছিল। মফস্বলের সেই রাস্তাকে সংস্কার করে মহাসড়কের সাথে সংযোগ দেয়া হয়েছিল। এটা উন্নয়ন, কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, সুবিদখালী বন্দরের প্রায় সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জনবহুল আবাসিক এলাকা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারী বেসরকারী অফিস-আদালত এই সড়কের পাশে অবস্থিত। বিস্তারিত ভাবে বললে বিষয়টি আমাদের বুঝতে সুবিধা হবে। ঢাকা থেকে আসার পথে যথাক্রমে সুবিদখালী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, দারুসসুন্নাত সিনিয়র মাদ্রাসা, সুবিদখালী বাজার, বাজারের ব্রিজ পার হলেই সুবিদখালী র'ই পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং সরকারী মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, উপজেলা পরিষদ ডাকবাংলা ও সুবিদখালী নদী বন্দরের রাস্তা, উপজেলা পরিষদ কার্যালয়, কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ভবন এবং সুবিদখালী আর,কে বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান এই সড়কের দুই পাশে অবস্থিত। উপজেলার সকল সরকারী-বেসরকারী শিক্ষা ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানের প্রধান রাস্তাই এটি। প্রায় প্রতি কর্মদিবসে হাজারের উপরে ছাত্র-ছাত্রী দূর্ঘটনার আশঙ্কা মাথায় নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করে। এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় চলাচল করতে হয়। সপ্তাহে দুই দিন এখানে হাটের দিন। দূর-দূরন্ত থেকে ব্যবসা এবং কেনা-বেচার লক্ষে এখানে অগনিত লোকের সমাগম ঘটে। অফিস-আদালত সপ্তাহের সকল সময়ই লোকারণ্য থাকে। প্রায় সকলেই দূর্ঘটনার ঝুকির মধ্যে থাকে।

এই রাস্তাকে মহাসড়ক বানানোর পর থেকেই নিয়মিত বিরতিতে সড়ক দূর্ঘটনা ঘটছে। যা অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মানের অন্যতম একটি কুফল। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন অবশ্যই দরকার ছিল এবং এখনও আছে। কিন্তু সেই উন্নয়ন পরিকল্পিত না হলে গলার কাটা হয়ে দাড়ায়। যার ফলশ্রুতিতে দূর্ঘটনা ঘটছে এবং বাড়ছে। শহরের বুক চিরে মহাসড়ক স্থাপনের বিষয়কে কোনভাবেই পরিকল্পিত বলা যায় না। কোন নগর পরিকল্পনাবিদ একে পরিকল্পিত বলবেন না। এখনকার এই মফস্বল শহর একদিন আর মফস্বল থাকবে না, তখন এই সমস্যাগুলো আরও গুরুতরভাবে আমাদের ভোগাবে। কেননা মির্জাগঞ্জের জনসংখ্যা বাড়বে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বে যানবাহনের সংখ্যা। কিন্তু প্রধান সড়ক এই একটাই থেকে যাবে, যদি বিকল্প কোন রাস্তা নির্মান করা না হয়। আর তখন এই সড়কটি অবশ্যই সেই চাপ সামাল দিতে পারবে না। দূর্ঘটনার সংখ্যা বাড়বে, জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে বা বলতে গেলে এখনই দুর্বিষহ।

রাস্তাটি নির্মানের সময় তড়িঘড়ি করে উন্নয়নের বিপ্লব দেখানোর একটা চেষ্টা ছিল বৈকি। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিকল্পনা বিহীন বিপ্লব সফল হয় না। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে স্রীমন্ত নদের উপরে সুবিদখালী-মির্জাগঞ্জ ব্রীজের নিচের আন্ডারপাসে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নাই। যেকারণে বর্ষার মৌসুম সহ বছরের দীর্ঘ সময় জলাবদ্ধ থাকে। সুবিদখালী বাজারেও কোন ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষার মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই প্লাবিত হয়। বাজারের মধ্যের যে বেইলি ব্রীজ দিয়ে বাস চলাচল করে সেটি ভারী যানবাহনের জন্য উপযুক্ত নয়। একটি বাস উঠলে অন্য কোন যানবাহন ক্রসিং করার জায়গা থাকেনা। নির্মানের সময় রাস্তার পিচ ঢালাই এতই দূর্বল ছিল যে, বাসের চাকায় মাটির রাস্তার মত ডেবে যেত। পরিকল্পনা থাকলে উল্লেখ্য গুরুত্বপূর্ন স্থানগুলো এভাবে অনিরাপদ হয়ে উঠত না। তৎকালীন সময়ে আমরা বিকল্প একটি সড়কের কথা শুনেছিলাম, যা কিনা শহরের বাইরে দিয়ে যাবে। সেটা বাস্তবায়ন হলে সুবিদখালীর প্রশাসনিক, বানিজ্যিক, আবাসিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এলাকা সমূহ একটি নিরাপদ বলয়ের মধ্যে থাকত। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাবে অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড মুখ থুবড়ে পরে।

গোছানো নগরের জন্য অবশ্যই সুপরিকল্পনা দরকার। যেটা সড়ক নির্মানের সময় ভাবা হয়নি। অনেকে বলতে পারেন রাস্তাই ছিলনা, আবার পরিকল্পনা। আবার বাতুলতাও বলতে পারেন। দোষারোপের বা সমালোচনার জন্য এই আলোচনা নয়। বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ন বিধায় আলোচনার দাবী রাখে। সমাধানের জন্যই আলোচনা দরকার। অস্বীকার করার কোন উপায় নাই যে, শহরের অভ্যন্তরে মহাসড়কের এই অংশ অদূর ভবিষ্যতে সমস্যাকে প্রকট করবে। সমাধান জরুরী। কিন্তু তাই বলে এই মুহুর্তে সব ওলট-পালট করা সম্ভব নয় বা রাতারাতি বিকল্প কোন সড়ক নির্মান করাও সম্ভব নয়, যাতে সমস্যার সমাধান হবে। তথাপিও নিরাপত্তার খাতিরে কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা জরুরী।

প্রথমত স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ উপজেলা প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ সমস্যাটির গুরুত্ব অনুধাবন করুন এবং সে অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করুন। এই মহাসড়কের পরিধি বৃদ্ধি ও সংস্কারের জন্য উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মন্ত্রনালয় থেকে বাজেট পাশ হয়েছে। যদি সম্ভব হয় সেই বাজেটের মাধ্যমে নতুন সড়কের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। অথবা নতুন সড়কের বাজেটের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে যাতে করে বন্দরের বাইরে থেকে মহাসড়ক নির্মাণ করা যায়। এতে শহরের নিরাপত্তা রক্ষা পাবে, সড়ক দূর্ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব। অবশ্যই এই সড়ক বাদ দিয়ে বিকল্প সড়কের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে, নাহলে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। আঙুলে পচন ধরলে সময় থাকতে কেটে ফেলা ভালো, নচেৎ গোটা শরীরে সেই পচন ছড়িয়ে পরবে এবং প্রতিকারের বাইরে চলে যাবে। নতুন সড়কের জন্য পর্যাপ্ত চেষ্টা থাকলে তা সম্ভব, যেভাবে একনেকে রাস্তার বর্ধন ও সংস্কারের বাজেট পাশ হয়েছে। নতুন সড়ক নির্মান ছাড়াও এই সড়কের নিরাপদ রাখার জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহন করা আবশ্যক।

সড়ক নিরাপদ রাখতে অবশ্যই উপজেলা প্রশাসনের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। যেহেতু এখানে কোন পৌরসভা বা নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নাই সেহেতু উপজেলা প্রশাসনের উপরেই দায়িত্ব বর্তায়। প্রশাসন চাইলেই পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তার নির্বাহী ক্ষমতাবলে অনেক বিধি-নিষেধ জারি করতে পারেন। প্রতিষ্ঠান সমূহ প্রধানতম এই সড়কের পাশে বিধায় পর্যাপ্ত স্পীডব্রেকার বা গতিরোধক নির্মান করা উচিত। নির্দিষ্ট দূরত্বের এসব গতিরোধক কিছুটা হলেও নিরাপত্তা রক্ষা করতে পারে। প্রয়োজনে শহরের মধ্যে দুরপাল্লার যানবাহনের জন্য সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারন করে দেয়া উচিত। যাতে দ্রুতগামী এসব যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রনে থাকে। গতি নিয়ন্ত্রনে থাকলে দূর্ঘটনা অনেকাংশে কমবে বলে আশা করা যায়। শুধু গতিসীমা নির্ধারন বা গতিরোধন নির্মান করলেই হবে না, যানবাহন সমূহকে বিধি-নিষেধ মানতে বাধ্য করতে হবে। এছাড়াও হয়ত আরও বিকল্প বিভিন্ন উপায়ে দূর্ঘটনা নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। সেসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে সাথে নিয়ে পরিকল্পনা প্রনয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়কের সুব্যবস্থাপনা ছাড়াও অন্যান্য সমস্যা নিয়েও আলোচনার সময় এসেছে।

সুবিদখালী, মির্জাগঞ্জ একটি উদীয়মান ও দ্রুত সম্প্রসারণশীল নগর। এই নগরকে একটি সুন্দর, নিরাপদ ও গোছানো নগর হিসেবে গড়ে তুলতে পরিকলপনা থাকা দরকার। এর পূর্বে যিনি বা যারা উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, হোক পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সময় থাকতে কাজ শুরু করা দরকার। পরিকল্পিত শহরায়ন বা নগরায়ন শুধু আজকের দিনের জন্য নয়। বড় বড় শহরগুলোতে অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে দিন দিন সমস্যা প্রকট হচ্ছে। যা দেখে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। যাতে করে ভবিষ্যতে সুবিদখালী নামক নগরে সেই সমস্যাগুলো দেখা না যায়। তাই উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয় এবং সকল দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টির সুবিবেচনার জন্য অনুরোধ জানাই। এই নগর, এই উপজেলার দায়িত্ব আপনাদের কাছে। কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রী, সাধারন মানুষের জীবন ঝুকির মধ্যে রেখে উপজেলার সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। অবশ্যই আপনাদের সক্ষমতার উপরে উপজেলার সুন্দর, নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে মির্জাগঞ্জকে একটি নিরাপদ ও পরিকল্পিত উপজেলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আপনাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাই।