অমর কবিতার জন্মক্ষণ

বিনয় দত্ত
Published : 9 March 2018, 04:52 AM
Updated : 9 March 2018, 04:52 AM

অমর কবিতার জন্মক্ষণটি সবাই স্মরণ করছে শ্রদ্ধাভরে। মহাকাব্যের সেই কবির প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছি প্রতিটি ক্ষণে। অমর কবিতার জন্মক্ষণটি কিন্তু খুব সুগম ছিল না। বরং ক্ষণটি ছিল কণ্টকময়, অস্থির, দুর্গম। কবির ভুল শব্দের মধ্যে দিয়ে রচিত হতে পারতো ভিন্ন ইতিহাস।
মহান নেতার বিচক্ষণতা, ভিতরকার আর্তনাদ, নির্যাতিত মানুষের কান্নার হাহাকার, রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার দৃশ্যপট, বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের তীব্র শব্দ কবিকে করেছে আরো পরিশুদ্ধ। এই ইতিহাস একদিনের নয়, এই ইতিহাস দীর্ঘ তেইশ বছরে নিপীড়িত, বঞ্চিত হওয়ার। এই ইতিহাস শোষণের, শোষিত হওয়ার। এই ইতিহাস অসংখ্য স্বাধীনতাকামী মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষার ইতিহাস।
ইতিহাসের সেই অমর কাব্য শোনার জন্য সেই দিনের অপেক্ষা সবার। কখন আসবে স্বাধীনতার ঘোষণা বহনকারী সেই কবি? যিনি বাঙালির জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন। যিনি সবার অজান্তে নিজের জীবনের প্রতিটা রক্ত বিন্দু উৎসর্গ করে রেখেছেন। 'স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো' এই কবিতায় কবি নির্মলেন্দু গুণের মতো আমিও বলতে চাই।

একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে-
'কখন আসবে কবি?' 'কখন আসবে কবি?'

সাতই মার্চের উনিশ মিনিটের সেই অমর কবিতার প্রতিটি শব্দ এতো গভীর, এতো দৃপ্ত, এতো বেশি পরিমাণে সকলকে চিন্তার খোরাক দেয় যে তা বার বার শ্রবণের আগ্রহ তৈরি করে। এই তীব্র আগ্রহ নিবারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে রেসকোর্স ময়দানে। নির্মলেন্দু গুণের সাথে আমি বলতে চাই-

……এই মাঠে ছুটে এসেছিল
কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক, লাঙল জোয়াল কাঁধে
এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে
এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক, হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে
এসেছিল মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা,
ভবঘুরে আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।

এই কবিতায় বঙ্গবন্ধু ব্যক্ত করেছেন বাঙালির দুঃখের কথা, নিজের আকুলতার কথা, বাঙালির অধিকারের কথা। কবি নিজেকে উদারভাবে তুলে ধরেছেন কোটি কোটি মানুষের সামনে। এই কবিতায় একদিকে যেমন দুঃখের কথা উঠে এসেছে, তেমনি উঠে এসেছে নিজেদের অধিকারের ছিনিয়ে নিলে বাঙালি কিভাবে তা হরণ করে নিবে তার কথাও।

'প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।
তোমাদের যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।'

১০৩টি লাইনের সেই অমর কবিতায় শত্রুপক্ষকে এতো নিখুঁতভাবে সুকৌশলে কবি নিয়ন্ত্রণ করেছেন যা ইতিহাস স্মরণে রেখেছে। ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর আচরণ বঙ্গবন্ধুর একদমই পছন্দ না কিন্তু তিনি নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঠিকই তা দূরদর্শীতা দিয়ে। শত্রুপক্ষের সেনাবাহিনীকে তিনি অধিকারের স্বরে বলছেন-

তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো,
কেউ কিছু বলবে না।
গুলী চালালে আর ভাল হবে না।
সাত কোটি মানুষকে আর দাবীয়ে রাখতে পারবা না।
বাঙ্গালী মরতে শিখেছে,
তাদের কেউ দাবাতে পারবে না।

একটি দেশকে সতর্কবাণী দেয়া ছাড়াও নিজেদের দেশের প্রতিটি মানুষের প্রতি নির্দেশনাও ছিল স্পষ্ট। নিরপরাধ, নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করার জন্য এই একটি ভাষণই ছিল যথেস্ট। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু দলমত, ধর্মবর্ণ সব ভুলে সবাইকে প্রস্তুতি নেয়ার আহবান জানান। যে কোনো মূল্যে নিজের মাতৃভূমি রক্ষা করতে হবে।

'প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলো।
তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকবা।
রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো।
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।'

পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র অলিখিত ভাষণ, যা বঙ্গবন্ধু নিজের বোধ থেকে বলেছেন এবং কোটি কোটি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার দাবীতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। একাত্তরের রেসকোর্স ময়দানের সেই ভাষণটি আসলে ছিল মহাকাব্য। মার্কিন 'টাইমস' পত্রিকা 'পয়েট অব পলিটিকস' শিরোনামে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি প্রচ্ছদ স্টোরি করেছিল। এমনকি মার্কিনরাও এই ভাষণ স্টাডি করে তার মধ্যে কবিতার সন্ধান পেয়েছিল।
সেই অমর কবিতার মহান কবি পরিশেষে বজ্রকণ্ঠে মঞ্চ কাঁপিয়ে সবাইকে শোনালেন-

'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'