তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া নানা জানা-অজানা ও এক্সক্লুসিভ বিষয়ের বর্ণনা নিয়ে ১০১ পর্বের ধারাবাহিকের ৮ম পর্ব

হাসান
Published : 24 May 2011, 07:13 PM
Updated : 24 May 2011, 07:13 PM

কূটনৈতিক তৎপরতা ফিরে দেখা:
আ'লীগ নির্বাচনের দিকেই এগোচ্ছে
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রাষ্ট্রপতি নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করছেন : বাউচার

দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিচার্ড বাউচার বলেন," বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৪ ডিসেম্বর ২০০৬ ওয়াশিংটন ডিসিতে এক আলোচনা সভায় বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে মার্কিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেন। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে বলে স্পষ্ট আলামত দেখা যাচ্ছে। ভোটারদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে এমন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে যারাই সরকার গঠন করবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন করবে। আর এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিরপেক্ষতার সঙ্গে তার সাংবিধানিক দায়িত¦ পালন করছেন বলে আমরা মনে করি। এ জন্য তাকে যে ধরনের ঝক্কি-ঝামেলা সইতে হচ্ছে সে জন্য তার প্রতি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি।"

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফের সমঝোতার আহ্বান জানান কফি আনান
জাতিসংঘের বিদায়ী মহাসচিব কফি আনান জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরাজমান সমস্যা নিরসনে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার আহ্বান জানান। ১৫ ডিসেম্বর ২০০৬ নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে বাংলাদেশ-বিষয়ক এ-সংক্রান্ত বিবৃতিটি সাংবাদিকদের পড়ে শোনান মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিখ।

বিবৃতিতে বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। কফি আনান তার বিবৃতিতে নির্বাচন কমিশনের ওপর সব মহলের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য তত্ত¦াবধায়ক সরকারের ভারসাম্যমূলক আচরণ কামনা করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সহিংসতার পথ পরিহার করা এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য বিবৃতিতে কফি আনান আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতিসংঘ মহাসচিব অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনার জন্য তার বিশেষ দূত পাঠান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বিবৃতি দেন।

শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন ও ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত
মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া এ. বিউটেনিস ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ৬ জানুয়ারি ২০০৭ রাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সুধা সদন বাসভবনে তাদের এ বৈঠক হয়। তিন দিনব্যাপী শুরু হওয়া অবরোধের আগের রাতে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুই রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনার সঙ্গে অন্য কেউ উপস্থিত ছিলেন না। বৈঠক শেষে তারা বৈঠকের বিষয়বস্ত– সম্পর্কে সাংবাদিকদের কিছুই জানানো থেকে বিরত থাকেন। আওয়ামী লীগ নেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বৈঠকের বিষয় স¤পর্কে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা অসুস্থ বোধ করায় তাদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারেননি। তাই বৈঠকের বিষয়বস্ত– সম্পর্কে তিনি ছাড়া অন্য কোনো নেতা কিছু জানেন না

বেগম জিয়ার সঙ্গে বিউটেনিস ও আনোয়ার চৌধুরীর রুদ্ধদ্বার বৈঠক
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ৭ জানুয়ারি ২০০৭ রাতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টার কিছু পর পর্যন্ত এ বৈঠক চলে। বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়াও উপস্থিত থাকেন।

বৈঠক সম্পর্কে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা হয় এবং রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদ্বয়ও এ ব্যাপারে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান।

নির্বাচন নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের বিবৃতি প্রদানের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস যে বিবৃতি দেয় তা কূটনৈতিক রীতিনীতি বহির্ভূত আখ্যায়িত করে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান সুপ্রিমকোর্টের শতাধিক আইনজীবী। পাশাপাশি ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী নির্বাচন নিয়ে যে মন্তব্য করেন তা অনভিপ্রেত বলে উল্লেখ করা হয়। এক যুক্ত বিবৃতিতে আইনজীবীরা এ নিন্দা জানান। জাতীয় নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের এ বিবৃতিকে আইনজীবীরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সুস্পষ্ট হস্তক্ষেপের শামিল ও পক্ষপাতদুষ্ট বলে উল্লেখ করেন। বিবৃতিতে আইনজীবীরা বলেন, কোনো কারণ ছাড়া যখন আওয়ামী লীগ নির্বাচন হতে সরে দাঁড়ায়, তখন ব্রিটিশ হাইকমিশনার বললেন, 'আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচন গ্রহণ যোগ্য হবে না। এ ধরনের বিবৃতি একটি দলের পক্ষে ও অন্যদের বিপক্ষে ওকালতির শামিল। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কূটনীতিকদের কোনো কথা বলার অধিকার নেই বলে তারা উল্লেখ করেন।

কূটনীতিকদের তৎপরতায় নাটকীয় মোড়
নির্ধারিত দিনের নির্বাচন স্থগিত করার ব্যাপারে পশ্চিমা কূটনীতিকদের একটি অংশের নাটকীয় তৎপরতা শুরু হয় ৮ জানুয়ারি ২০০৭। দুই প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূত এ তৎপরতায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তারা এর আগের দুই দিন দুই প্রধান নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সম্মত করতে না পারার পর নিজেদের মতামত সরাসরি জানাতে শুরু করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল ও ক্ষমতার কেন্দ্রে। ৮ জানুয়ারি দুই প্রভাবশালী কূটনীতিকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ভাবে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে জানানো হয় রাজনৈতিক পক্ষদ্বয়ের একটি নির্বাচনে না গেলে সে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য মনে করা হবে না। তাদের একজনের বক্তব্যের সঙ্গে কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতার বক্তব্য মিলে যায়। তার বক্তব্য হলো, সংবিধানের নির্ধারিত ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতার কথা বলা হলেও রেফারেন্ডামের মাধ্যমে এর ব্যতিক্রম ঘটানো সম্ভব। অন্য এক কূটনীতিক দুর্নীতি মামলায় ২ বছর সাজাপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সরাসরি মন্তব্য করেন, এক পক্ষের অংশগ্রহণের নির্বাচন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ধরনের নির্বাচন মেনে নেবে না। তিনি সংবিধানের যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে হতে হবে, আইনের দোহাই দিয়ে লাভ নেই।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্সি জার্মান রাষ্ট্রদূত এবং অস্ট্রেলীয় রাষ্ট্রদূতও সৃষ্ট পরিস্থিতিতে নানা মহলে যোগাযোগ করেন। সার্বিকভাবে টুয়েস ডে গ্রুপ একটি অবস্থান নিচ্ছে বলে জল্পনা চলে কূটনৈতিক মহলে।
এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে পশ্চিমা কয়েকটি দেশের কূটনীতিকরা যেভাবে কথা বলেন, তাতে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা কথা বলার মাত্রা ছাড়িয়ে যায় মর্মে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়।

কূটনীতিকদের বক্তব্যে যে ধরনের রাখঢাক ছিল, তা ক্রমেই সরে যায়। রাজনৈতিক সমস্যা নিরসনে সংবিধান গুরুত্ব পাওয়া উচিত না এমন বক্তব্য বহুদিন ধরে ১৪ দল ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা দিচ্ছিলেন। তাদের বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায় কূটনীতিকদের বক্তব্য।

পশ্চিমা কূটনীতিকদের হঠাৎ তৎপর হয়ে ওঠার বিষয়টিকে রহস্যজনক মনে করেন অনেকে। এর পেছনে দেশের অভ্যন্তরীণ তৎপরতার চেয়ে বাইরের তৎপরতা অধিক কাজ করে। বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। মহাজোটের কিছু নেতা ছাড়াও সুশীল সমাজের সদস্য হিসেবে পরিচিত কিছু ব্যক্তিও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন।

পশ্চিমা কূটনীতিকরা এর আগে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বার বার আহ্বান জানানোর পর তা মহাজোট দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ধরে নেয়া হয় চাপ সৃষ্টি করে চার দলকে মহাজোটের অবস্থানে নিয়ে আসতে হবে। শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী পশ্চিমা কূটনীতিকরা সে বিষয়টিতে প্রভাবিত হন। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদত্যাগী চার উপদেষ্টা সরকারে থাকতেই নানা বক্তব্য ও তথ্য দিয়ে পশ্চিমা কূটনীতিকদের প্রভাবিত করতে চেষ্টা করেন। নতুন চার উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ার পর সে ধারা আগের মতো না হলেও কম-বেশি চলতে থাকে। উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরাসরি আবার ক্ষেত্রবিশেষে পরোক্ষভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে নানা তথ্য অন্তরালে প্রকাশ করতে থাকেন। এভাবে কূটনীতিকদের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি একটি অনাস্থা তৈরির জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা চলে। নির্বাচন প্রশ্নে কূটনীতিকদের তৎপরতার নাটকীয় মোড় পরিবর্তনের পেছনে এর ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। পশ্চিমা কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের তৎপরতাকে শুধু নির্বাচন পেছানোর ক্ষেত্রেই নয়, একই সঙ্গে তাদের উদ্যোগকে সরকার পরিবর্তন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। তফসিল পরিবর্তন করে নির্বাচন পেছানোর সঙ্গে সঙ্গে বলা হবে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে না। নিরপেক্ষ কারো হাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে। এ দাবিই শেষ পর্যন্ত উচ্চারিত হয় দুই প্রভাবশালী কূটনীতিকের মুখ থেকে।