ভাষার মাসে জোর দাবি: বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসা থেকে উর্দু উঠিয়ে দেয়া হোক

ইলিয়াস মাহমুদ
Published : 12 Feb 2016, 08:15 PM
Updated : 12 Feb 2016, 08:15 PM

বাংলাদেশে এক অদ্ভুত শিক্ষা ব্যাবস্তার নাম কওমী মাদ্রাসা । ইচ্চা করলেই যে কেউ মক্তব ইয়েজদাহম, দাহম, নাহম (ক্লাস ওয়ান, টু, থ্রি) পড়েও তার ঘরের পাশে শহড় কিংবা অজপাড়া গায়েঁ খুলে বসতে পারেন ধর্মের নামে এই প্রতিষ্ঠানটি ।

আমার কাছে কওমী শিক্ষানীতিকে অনেকটা বাংলাদেশে অবস্থানরত "বিহারীদের" জীবনের মত মনে হয় । এই বিহারীদের আদিনিবাস ভারতের বিহারে । ১৯৪৭ সালের পর থেকে এদের একটা অংশ থাকে বাংলাদেশে । আর তাদের ভালবাসা , প্রেম পাকিস্তানের জন্য । অদ্ভুত না!?  আদি নিবাস ভারতে, থাকে বাংলাদেশে আর ভালবাসে পাকিস্তান কে !

কওমী মাদ্রাসাও অনেক টা সে রকম ।

কওমী নিয়ে লেখার আগে তাদের ইতিহাস টা একটু জেনে নেই ।

১৭৫৭ সালে শেষ নবাবের পতনের মাধ্যমে উপমহাদেশে মুসলিম শাসকদের পাঁচশ বছরের রাজত্যের পরিসমাপ্তি ঘটে । স্বল্প সংখক বৃটিশরা বিশাল উপমহাদেশ পরিচালনার জন্য বেছে নেয় "ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি । সদ্য রাজত্য হারানো  শিক্ষা দিক্ষায় উন্নত মুসলিমদের কে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার প্রধান  বাধা হিসেবে নিয়ে "হিরক রাজা"র মত শিক্ষা ব্যাবস্থা থেকে মুসলমানদের নিরক্ষর করার এক বিশাল পরিকল্পনা করে মাঠে নামে ইংরেজরা ।

আঠারো শ' সাতান্ন সালের সিপাহী বিপ্লবে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে ঘোর অন্ধকার নেমে আসলো ভারতের ভাগ্যাকাশে। ফলে বৃটিশউপনিবেশ সাম্রাজ্যবাদীদের শাসন ক্ষমতা আরো সুসংহত হয়। দিল্লীর মসনদে বৃটিশরা পাকাপোক্ত হওয়ার পর প্রথমেই যে কাজটিকে গুরুত্ব দিয়েছিল, তা ছিল ইসলাম-মুসলমানদের দীনী ঐতিহ্য, সভ্যতা, শিক্ষা-সংস্কৃতিচিরতরে ধ্বংস করা, যাতে মুসলমানরা কোন দিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। যে জাতিকে ভয়ভীতি প্রদর্শনকরে, চাপপ্রয়োগ করে দাবানো যায়নি, তাদেরচিন্তাধারায় আস্তে আস্তেএমন পরিবর্তন আনতে হবে যে,তারা এক ভিন্ন জাতি হিসেবে যেন নিজেদের অস্তিত্বভুলে যায়। তারা নিজেদের দীনী ঐতিহ্য,সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং সোনালী অতীত থেকে দিনে দিনে সরে  যায়।এমনকি দীর্ঘদিন পরে যেন তাদের এক থাস্মরণ না থাকে যে,তারা কেমন সিংহের জাতি ছিল অথচ আজ শৃগালে পরিণত হয়েছে।

এ লক্ষকে সামনে রেখে 'লর্ড ম্যাকল' এদেশের মানুষের জন্য এক নতুন শিক্ষানীতির সুপারিশ করেন। তা বাস্তবায়নের লক্ষে তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন। তাতে ভারতবর্ষের জাতীয় শিক্ষানীতি তথা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ন্যাক্কারজনক ভাবে উপহাস করা হয়। এবং ওলামায়ে কেরামের উপর ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপন করা হয় পরিশেষে তিনি স্পষ্ঠ ভাষায় লেখেন, " এখন আমাদের কর্তব্য হল, এমন একদল লোক তৈরি করা যারা আমাদের অধিকৃত অঞ্চলের অধিবাসী ও আমাদের মাঝে দোভাষীর দায়িত্ব পালন করবে। যারা রক্ত ও বর্ণে হিন্দুস্তানী হলেও চিন্তা-চেতনা, মেধা-মনন ও চারিত্রিক দৃষ্টিকোন থেকে হবে ইংরেজ্"

বিশাল হিন্দু সম্প্রদায় তালিয়া বাজায় । স্বাগত জানায় তাদের নীতি কে ।

ইংরেজরা টোটাল পরিবেশটাকে এমন ভাবে ক্রিয়েট করে যাতে মুসলমানরা সব কিছুতেই তাদের উপর খারাপ ধারণা পোষণ করে তারা যা করবে মুসলমানরা সেটার বিপরীত থাকে । হলোও তাই ।

১৭৮০ সালে বাংলার ফোর্ট উইলিয়ামের গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিসং কর্তৃক কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় মাদ্রাসা ই আলিয়া ।  ইংরেজ শাসনের প্রাথমিক পর্বে প্রশাসন পরিচালিত হতো প্রচলিত ফার্সি ভাষায় রচিত আইন অনুসারে। এ কারণে প্রশাসনের জন্য, বিশেষ করে বিচার বিভাগের জন্য প্রয়োজন ছিল আরবি, ফার্সি ও বাংলা ভাষায় দক্ষতা। এ ছাড়া মুসলিম আইনের ব্যাখ্যা ও মামলায় রায় দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল অনেক মৌলবি ও মুফতির। একই সঙ্গে মৌলবি ও মুফতিদের ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান থাকারও প্রয়োজন ছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস মুসলমানদের জন্য একটি মাদ্রাসা ও হিন্দুদের জন্য একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

যেহেতু এই মাদ্রাসাটি ইংরেজ দ্বারা পরিচালিত তাই আলেমদের বড় একটা অংশ এটাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেতে থাকলেন । তারা মুসলমানদের এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে নিরুৎসাহিত করলেন । তারা ইংরেজদের সব কিছুকেই হারাম বললেন । সেটা তাদের হাটা চলা , খাওয়া পোষাক সব কিছুই ।

ইংরেজরা চাচ্ছিল সেটাই । তাদের পাতা ফাঁদেই পা দিল তৎকালীন আলেমরা । তারা শুধু  উর্দু ও ফার্সি ভাষায় তাদের বই রচনা করে কুরআন হাদিস (এর সাথে এই রিলেটেড কিছু কিতাব রেখে) বাদে বাকী সব সাবজেক্ট বাদ দিয়ে দেন । যে মুসলমানরা পৃথিবীক্ষাত বিখ্যাত ইবনে সিনা, আল জাবের , আবু আব্দুল্লাহ্‌ মুহম্মদ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজ্‌মি (ভূগোলবিদ, জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ ও দার্শনিক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী জন্মদিল )  রসায়ন বিজ্ঞানী আবু মুসা জাবির ইবনে হাইয়ান আল-আযদী, সহ অসংখ বিজ্ঞানী । যারা আজকের আধুনিক প্রথিবীর কর্ণধার ।

তাদের সে পথে না হেটে মুসলমানদের অন্ধকার জগতের দিকে নিয়ে যেতে থাকেন । তারই ধারাবাহিকতায়

১৮৬৬ সালে ভারতের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী (রঃ), রশিদ আহম্মদ গাঙ্গুহী (রঃ), হাজী আবেদ হুসাইন (রঃ)

মোল্লা মাহমুদ, তার ছাত্র মাহমুদুল হাসান সহ তৎকালীন  আলেমদের হাত ধরে দেওবন্দ মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়  ।

ভারতে , পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা বহুল প্রচলিত। ভারত উপমহাদেশের পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। তবে উপমহাদেশের বাইরে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সাধারণত খুব একটা দেখা যায় না ।  

বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসার একটা গ্রাফ উল্লেখ করি…

২০০৯ সালের এপ্রিলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৬৪ জেলার প্রশাসকদের অধীনস্থ কওমি মাদ্রসার সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ২৫ হাজার ৯০৬টি । কিন্তু বাস্তবতা এর থেকে দুই বা তিন গুন বেশি হতে পারে কেননা.. জেলা প্রশাসকদের তথ্যে চট্টগ্রামে ৭৪৮টি মাদ্রাসার উল্লেখ থাকলেও ২০১২ সালের এপ্রিলে পুলিশ সদর দফতরের এক এআইজির তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম জেলায় ১৫ হাজার ১৬৪টি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে । সে হিসেবে দেশে কওমি মাদ্রসার সংখ্যা ৫০ হাজরের বেশি হতে পারে । যদিও উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে মাত্র ১৫ হাজারের কিছু বেশি উল্লেখ করা আছে । যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫০ হাজার (প্লাস/মাইনাস) ধরি তা হলে এর ছাত্র সংখ্যা শিক্ষক শুভাকাংক্ষি কত ? এর একটা ধারণা হয়তো অনেকেই ৫ই মে হেফাজতের উথ্থানের সময় কিছুটা পেয়ে থাকবেন ।

বাংলাদেশের আর্থ –সামাজিক উন্নয়নেই বা এই বিশাল জনশক্তির ভুমিকা কতটুকু । সেটা অবশ্য গবেষণার বিষয় ।

শিরোনামের বিষয়ে আসি, ১৮৬৬ সাল থেকে ১৯৪৭ এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই সময় পর্যন্ত যদি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার ভাষা যদি উর্দু ও ফার্সির প্রয়োজনীয়তা থেকেও থাকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে উর্দুর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই । ১৯৫২ সালে যে ভাষার জন্য রফিক সালাম বরকতরা জীবন দিল সেই দেশের বিশাল একটা জনশক্তির শিক্ষার ভাষা হবে উর্দু এটা মেনে নেয়ার মত না ।

কওমী আলেমরা এখনো যে বৃটিশদের পাতা ফাঁদ থেকে উঠতে পারেন নি তার প্রধান যুক্তি হল উর্দুর প্রতি তাদের এই দুর্বলতা । এটা কি তাদের পাকিস্তান প্রীতি না অঙ্গতা ? উর্দু কি তাদের মাতৃভাষা? ইসলামের ভাষা?? জান্নাতের ভাষা??? অথবা আন্তর্যাতিক ভাষা ????? কোনটা ?

ভাষার মাসে সব শেষে কওমী নেতৃবৃন্দ এবং সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে বিশাল এই জনশক্তিকে কোন ভাবেই যাতে গোড়ামীর কারনে পিছিয়ে না থাকে সে জন্য কওমী মাদ্রাসায় উর্দু ফার্সি ভাষা তুলে দিয়ে শুধু মাত্র আরবী বাংলা এবং ইংরেজী ভাষাতে বই রচনার জন্য অনুরোধ থাকবে ।