এমন বেইনসাফিতে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠার কথা

ইমদাদ হক
Published : 3 April 2011, 07:14 PM
Updated : 3 April 2011, 07:14 PM

(লিখেছেন মা হ মু দু র র হ মা ন)

কড়া পুলিশ পাহারায় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ালাম। খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, আবদুর রাজ্জাক, সানাউল্লাহ মিঞাসহ আমার পক্ষে প্রায় একশ' আইনজীবী। সরকারপক্ষেও তাবত্ পিপিসহ আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের ছড়াছড়ি। পেশাজীবী আন্দোলনে আমার সহযোগীরাও আদালতে সহমর্মিতা জানাতে এসেছেন। কালো শ্মশ্রুমণ্ডিত, কপালে নিয়মিত নামাজ পড়ার গাঢ় চিহ্নযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখলে যে কেউ তাকে কট্টর মৌলবাদীর তালিকায় ফেলে দেবেন।

আমার পক্ষভুক্ত ঢাকা বারের একজন আইনজীবী অবশ্য অনুচ্চ কণ্ঠে আমাকে চেহারা দেখে বিভ্রান্ত না হতে পরামর্শ দিলেন। আদালতপাড়ায় নাকি এই ম্যাজিস্ট্রেট নির্ভেজাল সরকারপন্থী হিসেবে সবিশেষ পরিচিত। সরকারপক্ষ তাদের বক্তব্য শুরু করলেন। তেজগাঁও থানার যে মামলায় আমাকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, সেই মামলাতেই সরকার নতুন করে সাত দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করল। সরকারপক্ষের উকিল তেজগাঁও থানার আইও রেজাউল করিমের ঢাকা জেলগেটে তিন দিন আগে করা মন্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করে বললেন, আমাকে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন এবং

জেলগেটে সেই বিশেষ পদ্ধতির জিজ্ঞাসাবাদের (পড়ুন নির্যাতন) পরিবেশ নেই। পিপি আরও অভিযোগ করলেন, জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমি যেহেতু প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে অসৌজন্যমূলক ভাষা প্রয়োগ করেছি, কাজেই আমার শক্তির উত্স খুঁজে বের করার জন্যও থানা হেফাজতে রিমান্ড আবশ্যক। সরকারপক্ষের বক্তব্য শেষ হলে একে একে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, এ জে মোহাম্মদ আলী এবং সানাউল্লাহ মিঞা উঠে দাঁড়িয়ে রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করলেন। ঢাকা বারের সভাপতি সানাউল্লাহ মিঞার বক্তব্য প্রদানের সময় সরকারপক্ষ বার বার বাধা সৃষ্টি করায় আদালতের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট বিচারকসুলভ

আত্মসংযম হারালেন এবং অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিঞার বক্তব্যের মাঝেই সবাইকে চমকে একেবারে হুঙ্কার দিয়ে সজোরে টেবিল চাপড়ে উঠলেন। এই অসৌজন্যমূলক আচরণে কয়েক সেকেন্ডের জন্য পুরো কোর্ট স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। এই অপমান কেবল ঢাকা বারের সভাপতির একার নয়, আজ ঘটনাক্রমে সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনও নিম্ন আদালতে উপস্থিত। বেঞ্চের এই অপ্রত্যাশিত আচরণ ঢাকা বারে আগে কোনোদিন পরিলক্ষিত হয়নি। বিস্ময় কাটিয়ে শতাধিক আইনজীবী ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। আদালতের অনভিপ্রেত ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে বিচারকার্য অব্যাহত রাখা সম্ভবপর হলো না। হট্টগোলের খবর

ততক্ষণে সিএমএম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সিএমএম এ কে এনামুল হক তার এজলাস থেকে ছুটে এসে ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান তালুকদারের পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় বিচারক বিব্রতবোধ করে শুনানি অসমাপ্ত রেখেই এজলাস ত্যাগ করলেন।
আমার পরবর্তী গন্তব্য ম্যাজিস্ট্রেট হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালত। এখানে বাদী কোতোয়ালি থানা। পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় আমার বিরুদ্ধে

পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা দেয়ার যে অবিশ্বাস্য ধরনের বানোয়াট মামলা দায়ের করা হয়েছে, তারই রিমান্ড শুনানির জন্য সদলবলে সেই আদালতে যাওয়া হলো। আমি নিশ্চিত ছিলাম, অন্তত এই মামলাটি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কেবল খারিজই করবেন না, আদালতের সময় নষ্ট করার জন্য সরকারপক্ষকে তিরস্কারও করবেন। ভুলে গিয়েছিলাম এটা বাংলাদেশ এবং মইন-ফখরুদ্দীন তাদের শাসনামলে দেশবাসীকে 'স্বাধীন বিচারব্যবস্থা' উপহার দিয়ে গেছেন। আমরা তো বটেই, এমনকি সরকারি পিপিকে পর্যন্ত হতবাক করে ম্যাজিস্ট্রেট একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলেন। শুনানির প্রহসন

সমাপ্ত করে আমাকে কোর্ট গারদে ফিরিয়ে আনা হলো। সারাদিনের অনাহারে, পরিশ্রমে, পানিশূন্যতায় তখন শরীরে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। যে নোংরা মেঝেতে বসার রুচি না হওয়ায় সকাল থেকে তিন ঘণ্টা অবিরত পায়চারি করে কাটিয়েছি, সেখানেই বসে পড়লাম। ৫টা বাজলো। পুলিশ এসে জানাল, যে মামলায় ঘণ্টা দুয়েক আগে আদালত বিব্রতবোধ করেছিল, সেই মামলায় নতুন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পুনঃশুনানি হবে। অতএব আবার শ'খানেক পুলিশ নিয়ে আদালত অভিমুখে মার্চ করলাম। সেখানে পৌঁছে আমি হতবাক। আমার পক্ষের কোনো আইনজীবী আদালতে উপস্থিত নেই

। ঘর ভর্তি করে রেখেছে সরকারি পিপি এবং আওয়ামীপন্থী উকিলের বহর। কী ঘটছে, তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উঠে জানালেন, আমার পক্ষের সিনিয়র আইনজীবীদের উচ্চ আদালতে মামলা থাকায় তারা সময় প্রার্থনা করেছিলেন এবং তাদের সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আদালতের সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আমার পক্ষের আইনজীবীরা সদলবলে শুনানি বর্জন করেছেন। এখন আমি চাইলে নিজেই যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করতে পারি।

নইলে নিরুপায় হয়ে আদালতকে একতরফা শুনেই রায় দিতে হবে। সরকারপক্ষের আইনজীবীরা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই নানা রকম অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে মন্তব্য করছিলেন, আমি এতই মন্দ প্রকৃতির যে আমার মামলা লড়ার জন্যে কোনো আইনজীবী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মধ্য থেকেই একজন রসিকতা করে প্রস্তাব করলেন, তিনি আমাকে আদালতে প্রতিনিধিত্ব করতে করুণাবশত সম্মত আছেন। আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে বললাম, এ অন্যায়, এর নাম বিচার হতে পারে

না। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট হবে। দেশে ন্যায়বিচার ব্যাহত হবে। অন্তত পরদিন পর্যন্ত শুনানি মুলতবি রাখার আবেদন করলাম। ম্যাজিস্ট্রেট তার অপারগতা জানিয়ে সরকারপক্ষকে তাদের যুক্তি-তর্ক পেশের নির্দেশ দিলেন। আমি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। সরকারি উকিলের পর উকিল হাত-পা নেড়ে কী বলে যাচ্ছিলেন, তার এক বর্ণ কানে ঢোকেনি। তাদের বাগ্মিতা কখন শেষ হয়েছে, তাও বলতে পারব না। চমক ভাঙল ম্যাজিস্ট্রেটের কথায়। স্মিত হাসিতে মুখ ভরিয়ে ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, আমার

কিছু বলার আছে কি-না। ইচ্ছা হলে আমি সরকারপক্ষের অভিযোগ খণ্ডন করে বক্তব্য দিতে পারি। তিনি আরও মন্তব্য করলেন, আমিও তো লেখাপড়া জানি; সুতরাং আইনজীবী না থাকলেও চলবে। হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আমি কেবল বললাম, আইনজীবী নিয়োগ আমার সাংবিধানিক অধিকার এবং আমার আইনজীবীদের অনুপস্থিতিতে বিচারকার্য চলতে পারে না। বিচারের নামে এই একতরফা শুনানি ভবিষ্যতের জন্য অতি মন্দ নজির হয়ে থাকবে।

কে শোনে কার কথা! ম্যাজিস্ট্রেট তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে এজলাস ত্যাগ করলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, রিমান্ডের সিদ্ধান্ত নেয়াই ছিল, আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ঘোষণা করা হলো মাত্র। সিএমএম আদালতের নিচে নেমে দেখি, পিপি গোষ্ঠী সংবাদমাধ্যমের কাছে বীরদর্পে তাদের বিজয়বার্তা বয়ান করছে। গ্রেফতার হওয়ার পর সাত দিনে পদে পদে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। কিন্তু আজকের মতো হতাশ ও বিমর্ষ আর কখনও বোধ করিনি। পাঠক ভাববেন না রিমান্ডের কারণে আমার এই হতাশা। আমি শুধু ভাবছিলাম বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে। আমার যদি

এমন হাল হয়ে থাকে, তাহলে এদেশের দরিদ্র, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত মানুষগুলো বেঁচে আছে কেমন করে? এমন বেইনসাফিতে তো আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠার কথা। কোর্ট গারদে অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যা ৬টা পেরিয়ে গেল। শেষতক কোর্ট পুলিশ এসে গারদের তালা খুলে দিলে জিজ্ঞেস করলাম, কোন থানা থেকে রিমান্ড শুরু হচ্ছে। জবাব শুনে খানিকটা অবাকই হলাম। আমার আয়ু একদিন বাড়ানো হয়েছে। অর্থাত্ আজ রাতের মতো জেলখানায় ফেরত যাচ্ছি। কাল আরও দু'টি মামলায় রিমান্ড শুনানি রয়েছে। সেগুলো শেষ করে তারপর থানায় নিয়ে ধোলাই শুরু হবে। সাত নম্বর

সেলে ফিরে দেখি, আমার প্রতিবেশীরা মন খারাপ করে বসে আছে। রেডিও মারফত রিমান্ডের খবর তারা আগেই পেয়েছে। বাবুর কাছে যে কাগজের টুকরোগুলো পারভীনকে পৌঁছে দেয়ার জন্য গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলাম, সেগুলো আর ফেরত নিলাম না। চৌবাচ্চার ধারে দাঁড়িয়ে গোসল করেই সেলে ঢুকে শুয়ে পড়লাম। সারাদিন কিছু খাইনি, তারপরও ক্ষিদে নেই। বাবু এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এলো। ওটুকুই রাতের আহার। সারারাত না ঘুমিয়ে ৫৭ বছরের দীর্ঘ জীবনের ডেবিট-ক্রেডিট মেলানোর চেষ্টা করলাম।
প্রায় নির্ঘুম রাতের সব চিন্তা

প্রধানত আমার প্রিয়জনদের ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। তাদের প্রতি কৃত সমুদয় অবিচারের স্মৃতি আরও একবার জীবন্ত হয়ে ধিক্কারে ধিক্কারে আমাকে নিজের কাছেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে তুলল। ক্ষমা চাওয়ারও তো আর সুযোগ রইল না। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে স্বজন হয়ে ওঠা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ৮ জুন সকালে বিদায় নিলাম। রিমান্ডের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার

স্বাক্ষর সর্বাঙ্গের ক্ষতচিহ্নে বহন করছে, এমন দু'জন কয়েদি সকাল থেকে চুপচাপ আমার সেলে এসে বসে রইল। তাদের দু'চোখে সারাক্ষণ অশ্রু টলমল করছিল। সেদিন কোর্ট থেকে আমাকে যে সরাসরি রিমান্ডে নেয়া হবে, সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহই ছিলাম। তবে কোথা থেকে জানি না, এক রাতের মধ্যে যথেষ্ট মানসিক শক্তি অর্জন করে ফেলেছিলাম।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রিমান্ডে আমাকে শেষ করে দেয়ার ব্যাপারে কেন জানি না একরকম নিশ্চিত হয়েই কোর্টের উদ্দেশে প্রিজন ভ্যানে উঠলাম। কিন্তু অবাক কাণ্ড, এক প্রকার গর্ববোধ মৃত্যুভয়কে বার বার অতিক্রম করে যাচ্ছিল। এই সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের কুিসত চেহারা আমাকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতির সামনে উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা আমার ৫৭ বছরের অকিঞ্চিত্কর জীবনকে নিজের কাছেই এক ভিন্ন মর্যাদায় অভিষিক্ত করে তুলছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন

হওয়ার পর আমিই সর্বপ্রথম লেখা এবং বক্তব্যের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের সিলমোহর তাদের কপালে সেঁটে দিয়েছিলাম। ২০০৮-এর সাধারণ নির্বাচন-পরবর্তী দেড় বছরে অবশ্য ফরহাদ মজহার, বদরুদ্দীন উমর প্রমুখও এই বিশেষণটি একাধিকবার ব্যবহার করেছেন। অন্যান্য দিনের মতোই দুপুর ২টার পর আমাকে কাঠগড়ায় তোলা হলো। জনাকীর্ণ আদালতে ইসলামী জঙ্গিত্বের

মামলায় আমার সপক্ষে আমি নিজেই বক্তব্য দিলাম। বললাম, হিযবুত তাহিররের সঙ্গে আমাকে জড়ানোর অপচেষ্টা কেবল নির্জলা মিথ্যাই নয়, এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী সব কণ্ঠ নানা কৌশলে রোধ করা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত সত্যের বিজয়ই সাধিত হয়। আমার ক্ষেত্রেও ইনশাআল্লাহ এর অন্যথা হবে না। মিনিট পাঁচেক বক্তব্য না দিতেই পিপি বাহিনী এবং আওয়ামী আইনজীবী গোষ্ঠী সমস্বরে চিত্কার করে আমার কথা বলায় বাধা দিতে লাগল।

শেষ যে কথাটি বলতে পেরেছিলাম তা হলো, আমাকে হত্যা করা যাবে; কিন্তু জালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমার ঈমানের শক্তিকে দুর্বল করা যাবে না। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় আমি কথা না বলে সপক্ষের আইনজীবীদের শুনানি করতে দিতে সম্মত হলাম। সানাউল্লাহ মিঞা, মাসুদ তালুকদারসহ আরও কয়েকজনের যুক্তি-তর্ক পেশ শেষে মামলার রায় শুনে এই বৈরী পরিবেশে, এত হতাশার মধ্যেও হেসে ফেললাম। উভয় মামলায় চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন তরুণ সেই ম্যাজিস্ট্রেট।

রসিকতা করে ঢাকা বারের সভাপতি সানাউল্লাহ মিঞাকে বললাম, আমার আর আপনার মধ্যে আজ থেকে পেশাগত কোনো পার্থক্য নেই। আমি শুনানি করলে চার দিন রিমান্ড, আপনি করলেও তা-ই। আমি কেবল ভাবছিলাম, যারা অতিশয় গম্ভীর চেহারা নিয়ে তরুণ বয়সেই নিম্ন আদালতে বিচারকের চেয়ারে বসেন, তাদের কি এই জীবন ভালো লাগে? আমি তো জানতাম তারুণ্য সততা

ও বিদ্রোহের প্রতীক।
চার পৃথক মামলায় সর্বমোট বারো দিনের রিমান্ডের বোঝা মাথায় নিয়ে কোর্ট গারদে ফিরে এলাম। সামনে অনিশ্চিত সময়। লড়াইয়ের ময়দানে আমি একা, নিঃসঙ্গ। মা আর স্ত্রীর চেহারা সামনে ভেসে উঠল। ছাব্বিশ বছরের সংসার জীবনের কত টুকরো স্মৃতি আনন্দ-বেদনার কাব্য হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে মনের গহিনে। আর কি তাদের সঙ্গে দেখা হবে জীবনে, নাকি এই শেষ!

বাবার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় আমার দুঃখিনী মা আমাকে নিয়ে দীর্ঘ নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছেন। স্কুলে থাকতে বিয়ে হয়েছিল। একমাত্র পুত্রকে বুকে নিয়ে জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত থেকেছেন। ছেলেকে বুয়েটে পড়িয়েছেন। মনে পড়ছিল, আমার কলেজ শিক্ষয়িত্রী মা চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় সেই দাউদকান্দির কর্মস্থল থেকে সে সময় দুষ্প্রাপ্য এক টিন কেরোসিন বাসে এবং রিকশায় করে ঢাকা শহরে বয়ে নিয়ে এসেছেন। রাজধানীতে তখন কেরোসিন দুষ্প্রাপ্য। রান্না করে ছেলের মুখে ভাত তুলে দেয়ার জন্যে একজন মহিলাকে অত দূর থেকে কেরোসিনের টিন ঘাড়ে করে আনতে হয়েছে।

সেই একই নারী জীবন সায়াহ্নে এসে দেখছেন—তার পুত্র রাষ্ট্রের একমাত্র হর্তাকর্তা, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আক্রোশের লক্ষ্য হয়ে বিনা অপরাধে রিমান্ডে নির্যাতনের মুখোমুখি। অপরদিকে সর্বংসহা, নিঃসঙ্গ স্ত্রী জায়নামাজকে আশ্রয় করে দিন-রাতের অধিকাংশ সময় সেখানেই অশ্রুজলে ভাসছে। সদ্য তরুণী মেয়েটি বিত্তহীন স্বামীর হাত ধরে বিত্তবান পিতার বিপুল বিত্ত-বৈভব ছেড়ে সংসার সমুদ্রে কিস্তি ভাসিয়েছিল প্রায় আড়াই দশক আগে। আজ রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম শিকারে পরিণত সেই

স্বামীকে আর কোনোদিন ফিরে না পাওয়ার আশঙ্কায় তার হৃদয়ভাঙা হাহাকারের তীব্রতা পাশে উপস্থিত না থেকেও যেন স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারছি। শোকাতুর দুই প্রবীণা ও মধ্যবয়সিনী নারীকে আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছিলাম। পুলিশের বুটের আওয়াজ আর গারদের তালা খোলার শব্দে চোখ খুললাম। কোনো কথা না বলে এগিয়ে গেলাম প্রিজন ভ্যানের দিকে।

একজন পুলিশ কর্মকর্তা পাশ থেকে বললেন, প্রথম দিনের রিমান্ড কোতোয়ালি থানায়। আমার কাছে এই তথ্য একেবারেই অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয়। জবাইয়ের পূর্বরাতে শিকারকে কোথায়, কেমন রাখল তা জেনে কী লাভ? ভ্যানের ভেতরে ঢুকতেই পেছনের দরজা সশব্দে বন্ধ করে তালা দিয়ে দু'জন অস্ত্রধারী পুলিশ অবস্থান নিল পাদানির সামনের একচিলতে জায়গায়। প্রিজন ভ্যানের ইঞ্জিন শব্দ করে জানান দিল, আসামির যাত্রা এবার রিমান্ড জীবনের অভিমুখে। (চলবে)

*** *** ***
E-mail : admahmudrahman@gmail.com