কালো আফ্রিকার মুক্তিদূত নেলসন ম্যান্ডেলা

জাহেদ সরওয়ার
Published : 8 Dec 2013, 09:09 AM
Updated : 8 Dec 2013, 09:09 AM

কোনো নিপীড়িত জনসমাজকে তারা নিজেরা ছাড়া অন্য কেউ মুক্ত করতে পারে না– নেলসন ম্যান্ডেলা
রোবেন দ্বীপের সুদীর্ঘ ২৭ বছর জেলজীবনেই ম্যান্ডেলা প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক মানের নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ম্যান্ডেলার কারামুক্তি উপলক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকায় দুনিয়ার রাষ্ট্রনেতাদের যেই মিলনমেলা বসেছিল সেখানে কিউবার আরেক বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো তাই বলেছিলেন যে মুক্ত ম্যান্ডেলার চাইতে বন্দী ম্যান্ডেলাই ছিলেন ক্ষমতাবান। আপোষের বহু প্রস্তাব চোখের সামনে ঝুলে থাকা সত্ত্বেও ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ শাসক পি ডব্লিউ বোথাসহ শাসকগোষ্ঠীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, `আমি জনগণের জন্মগত অধিকার বিক্রি করে নিজের মুক্তি কিনতে রাজী নই।' এমনকি তার মা ও সন্তানের মৃতদেহ দেখার জন্যও তাকে যেতে দেয়া হয় নি। তাতেও তিনি ভেঙ্গে পড়েন নি।

নেলসন ম্যান্ডেলা প্রকৃতপক্ষে ছিলেন আফ্রিকার নিখাদ আত্মা। শুধু আফ্রিকারই বা কেন বলা হবে? তিনিতো অগণিত সাধারণ শোষিত মানুষেরও প্রেরণা। আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ থেকে তিনি পদার্পন করেছিলেন সাম্যবাদী ম্যান্ডেলায়। বন্দী থাকা অবস্থায় সারা পৃথিবীতেই তার মুক্তির জন্য উম্মত্ত হয়ে উঠেছিল অজস্র শোষিত মানুষ। অগণিত দেশের সরকার তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দিয়েছিলেন। অগণিত বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট প্রদান করেছিল। অগণিত শহরের রাস্তার, পার্কের নামকরণ করা হয়েছিল তার নামে। এসবই ছিল তার প্রতি মানুষের ভালবাসার প্রকাশ। নোবেল পুরষ্কারের কথা না হয় বাদই দিলাম। যা কিনা সবাই জ্ঞাত।


দুনিয়ার অনেক সামরিক বেসামরিক সরকার বা স্বৈরাচারীই বিপ্লবী বিদ্রোহী বা অধিকারের লড়াকুদের অনেক রকমভাবেই দমনপীড়ন করেছেন। এখনো করছেন। চে গেবারাকে হত্যা করা হয়েছিল বলিভিয়ার গহীন জঙ্গলে। ফিদেল কাস্ত্রোকেও জেল খাটতে হয়েছিল। আজরাইলের মুখোমুখি হতে হয়েছিল বহুবার। লাতিন আমেরিকার আরো অনেক দেশেই, যেমন চিলিতে হত্যা করা হয়েছিল সালভাদর আইয়েন্দেসহ অনেক বিপ্লবীদের। মাত্র দুইমাসের ব্যবধানের উড়ন্ত বিমানে বিষ্ফোরক ফাটিয়ে হত্যা করা হয় গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্ট হাকাবো আরভেঞ্জ ও পানামার জাতীয়তাবাদী নেতা ওমর তোরিজোকে। কিন্তু জীবিত অবস্থায় এত সুদীর্ঘ কাল নির্মম নির্বাসনে দুনিয়ার খুব বেশি নেতাকে তার সমগ্র জীবন দেশের সাধারণ জনগণের মুক্তির জন্য ত্যাগ করতে দেখা যায় নাই, একমাত্র ম্যান্ডেলা ছাড়া।

মহাত্মা ভলতেয়ার হয়তো তাই বলেছিলেন, দুর্নীতিগ্রস্থ রাষ্ট্রে প্রকৃত মানুষদের একমাত্র বাসস্থান কারাগার। বন্দীত্বের আগে মুক্ত ম্যান্ডেলার জীবন ছিল আরো দুর্বিসহ। শুধু ম্যান্ডেলা কেন? দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্ত মানুষকেই বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার একেরপর এক দমনমূলক আইনের শেখলে বেধেছিল। আফ্রিকার আদিবাসীদের স্বদেশেই সভ্য করার নামে পরবাসী ভিখিরিতে পরিণত করেছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্বর্ণখনি, কয়লার খনিসহ নানা প্রাকৃতিক সম্পদের দখল নিতে এবং সেইসব খনিতে আদিবাসী আফ্রিকাবাসীদের সস্তা শ্রমিক বানানোই ছিল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। সাধারণ আফ্রিকাবাসীদের কাছ থেকে নানা আইনি জটিলতায় ফেলে কেড়ে নেয়া হচ্ছিল তাদের বাসস্থান। আইনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চলাফেরা করার উপর আরোপ করা হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা।

শহরের উর্বর অংশে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল শাদাদের কর্মস্থান ও বাসস্থান যেখানে কালোদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ আর শহরের অন্যপ্রান্তে যেখানে বস্তী, অস্বাস্থ্যকর যাকে হয়তো শহরতলীও বলা যাবে না, সেখানে কালোদেও বসবাসের অধিকার। তাও নানান বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দী। নিজেদের মর্জিমতো আইন করে ২০ লক্ষ শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যা অতি সহজেই এককোটির অধিক কৃষ্ণাঙ্গ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ ও পদানত করে রেখেছিল। শতকরা ৮৭ ভাগ জমি তাদের দখলে এবং বাকী ১৩ ভাগকে অবলম্বন করে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় কায়ক্লেশে জীবনধারণ করে মাত্র। সব সুযোগ সুবিধাগুলিকে নিজেদের করায়ত্ত রাখবার জন্য তারা আফ্রিকানদেরকে সরকারী কাজকর্ম থেকে, চার্চ থেকে, শিল্পোদ্যোগ থেকে, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। আফ্রিকানদের নামিয়ে দেয়া হয়েছে এমন নিচুতে যেখান থেকে তারা কোনোদিন শ্বেতাঙ্গপ্রভুত্বের বিরুদ্ধে মাথা তুলতে পারবে না।

ট্যানস্কি অঞ্চলের নিজের গ্রাম উমটাটা থেকে আলোঝলমলে শহর জোহান্সবার্গে পালিয়ে এসে এসবই দেখেছিলেন যুবক ম্যান্ডেলা। আইন পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। মনে মনে শপথ নিয়েছিলেন যে করেই হোক এই অধীনতা পরাধীনতা বৈদেশিক বেনিয়াদের হাত থেকে স্বদেশ স্বজাতি তথা সাধারণ নির্যাতিত মানুষকে রক্ষা করতেই হবে। আর এই হবে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাই যোগ দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একমাত্র উদারপন্থী রাজনৈতিক দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস তথা এএনসিতে। তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন এএনসির যুবসংগঠন যুবলীগের সভাপতিত্বে।

আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ধীরে চলো নীতি পছন্দ হচ্ছিল না যুবলীগের কর্মীদের। তারা চাইছিল র‌্যাডিক্যাল কিছু। বহু বছরের দমননীতি, আধিপত্যবাদের নির্মম নাগপাশ থেকে কালো মানুষদের মুক্ত করতে যুবলীগ ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দলের ম্যানিফেস্টোতে ঘোষণা করা হয়েছিল, এ এন সি পরিণত হবে এমন একটি উদ্দীপিত দলবদ্ধ সংস্থায় যার প্রতিটি সদস্য হবেন সচ্চরিত্র ও নিস্কলঙ্ক। এবং তারা হবেন আফ্রিকান জাতীয়তাবোধের শক্তিকেন্দ্র। প্রতিবাদের ভাষা থাকবে পূর্বের মতোই অহিংস, কিন্তু বর্জন করা হবে প্রতিনিধিদের বাগfড়ম্বর, একটির পর একটি আর্জি পেশ করা এবং স্থানে স্থানে বিক্ষিপ্ত কর্মকাণ্ড। এখন থেকে মুলমন্ত্র হবে ডাইরেক অ্যাকশন।

আন্দোলনের কাজে ম্যান্ডেলা জনসাধারণের মনে এমনই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে সেই বছরই তিনি ট্রান্সভাল প্রদেশের এএনসি-র সভাপতি নির্বাচিত হন। সরকার পক্ষ শ্যোনদুষ্টিতে এই উদীয়মান নেতার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার দিকে লক্ষ রেখেছিল। এদিকে আন্দোলন যত তীব্র হয় ততই সরকারি নিষেধাজ্ঞাও জারি হয় একের পর এক। নানাভাবে আইনের বেড়াজালে বন্দী করার চেষ্টা চলে। সোফিয়া টাউন ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে বহিষ্কারের নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তিনি গর্জে ওঠেন। ১৯৫২ সালের ১১ই ডিসেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। নিষেধাজ্ঞা অনুসারে তিনি কোনো সভা-সমিতি বা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন না। জোহান্সবার্গের নগর এলাকার বাইরে তাঁর যাতায়াত নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো। ট্রান্সভাল প্রদেশে এনএনসির উদ্দেশ্যে লিখিত তাঁর বক্তৃতা অপরের দ্বারা পঠিত হলো। এরপর সর্বশেষ মুক্তির আগ পর্যন্ত ম্যান্ডেলা বক্তৃতা লিখে গেছেন কিন্তু সেই বক্তৃতা তিনি নিজের দরাজ কণ্ঠে বলতে পারেন নাই। তার লিখিত বক্তৃতা অন্যের পাঠের মাধ্যমেই বিকশিত হয়ে উঠেছিল বিপ্লবের তীব্রতায়।

সমসাময়কি দুনিয়ার ইতিহাসে অসমান্য এক গণনায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা। বর্ণবাদবিরোধী শান্তিকামী মানুষের স্বপ্নপ্রতীক। দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষকে তিনি আজ বর্ণবাদের বিষবাস্প থেকে মুক্তি দিয়েছেন। ছিনিয়ে এনেছেন শ্বেতাঙ্গ দখলদারদের কাছ থেকে নির্যাতিত কালোদের স্বাধীনতা। দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর মানবিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মহাসংগ্রামের এই অনন্য নেতার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ই জুলাই। উমতাতা জেলার এমভাসিতে। পুরো নাম রোলিহলাহলা নেলসন ডালিভুঙ্গা ম্যান্ডেলা। পিতার নাম হিন্ড্রি গাডলা এমফাকান ইয়াসয়া ও মাতার নাম নোমিকেনি ফ্যান্নি ম্যান্ডেলা। হিন্ড্রি সাহসী, রক্ষণশীল ও একগুঁয়ে ছিলেন। পরে পিতার এই গুণাবলি ম্যান্ডেলার উপর বর্তেছে বলে অনেকে মনে করেন। ম্যান্ডেলার পিতার বিবাহিত স্ত্রীর সংখ্যা ছিল চার। চার স্ত্রীর মধ্যে ম্যান্ডেলার মা নোমিকেনি ছিলেন তৃতীয়। নেলসন পিতা-মাতার সবচেয়ে বড় সন্তান। তার ছোট ছিল দু'বোন মেবেল ও লেবি। টেম্বু উপজাতির শাসক-পরিবারে জন্মসূত্রে তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে ট্র্যানস্কি গ্রামাঞ্চলে। অল্প বয়সে তিনি মেষপালকের কাজ করেছেন, শরীরের মাংসপেশী যখন শক্ত হতে শুরু করেছে তখন তিনি কৃষিকাজে সহযোগিতা করেছেন। শৈশবে ট্রানস্কিতে আদিবাসী বৃদ্ধদের কাছে তিনি পুরোনো দিনের কাহিনী শুনতেন। পুর্বপুরুষেরা পিতৃভূমি রক্ষার জন্য যে সব লড়াই করেছিল সে সব শুনতেন। সমস্ত আফ্রিকান জাতির গর্ব হিসাবে উচ্চারিত হতো ডিনগ্যান ও ব্যাম্বাটার নাম, হিন্টসা ও মাকানা, স্কোয়াংগ থি ও ভালাসিলে, মশুশু ও সেখুখুনির নাম। মনে মনে ম্যান্ডেলা ভাবতেন তিনিও হবেন সেই সব পৌরাণিক কাহিনীর নায়কের মতই স্বজাতির সেবক। রক্ষা করবেন নিজের দেশের জনগণকে। কৈশোরে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আদিবাসী আদালতে বসে শুনেছেন প্রধান কাজি তাঁর পিতৃব্য-পুত্রের সওয়াল-জবাব, ভেবেছেন বড় হয়ে তিনিও হবেন একজন আইনজীবী, আর স্বপ্ন দেখেছেন লোককথার বিখ্যাত আদিবাসী কালো বীরপুরুষদের।

যাইহোক জনসমক্ষে বক্তৃতা দিতে না পারলেও তিনি তার আপোষহীন বিপ্লবী বক্তৃতাগুলো দিতেন আদালতে। এরপর একের পর এক বিপ্লব দানা বাধতে থাকে। একের পর এক মামলায় ফাঁসানো হয় ম্যান্ডেলাকে। বন্দী ম্যান্ডেলাও সতত ক্রিয়াশীল। জেলের ভেতর থেকে তিনি দিকনির্দেশনা লিখে পাঠান সহযোদ্ধাদের কাছে। জেল থেকে সাড়া পেয়ে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি গেরিলা ট্রেনিং নেয়ার জন্য আফ্রিকার অন্যান্য দেশসমূহ আলজেরিয়া, কঙ্গো, মিশর ইত্যাদি ভ্রমণ করেন। জনমত তৈরি করেন। ম্যান্ডেলা এমন এক নেতা যার সমগ্র জীবনই আসলে সংগ্রাম। তাইতো তার বইয়ের নাম হয় সংগ্রামই আমার জীবন। ম্যান্ডেলার জীবন থেকে দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষেরা যন্ত্রণা সহ্যের সীমানা কতদূর হতে পারে তার শিক্ষা নিতে পারে। রোবেন দ্বীপের নির্মম বন্দী জীবনের যন্ত্রণা সবারই জানা। যুগে যুগে তিনি প্রেরণা হয়ে থাকবেন দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের। বন্দী ম্যান্ডেলা যেমন মুক্ত ম্যান্ডেলার চাইতে ক্ষমতাবান ছিলেন, তেমনি জীবিত ম্যান্ডেলার চাইতে মৃত ম্যান্ডেলা আরো বেশি প্রেরণা হয়ে উঠবেন মুক্তিকামী মানুষের। কমরেড ম্যান্ডেলা, লাল সালাম।