নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতনে নন্দকুমারের ভূমিকা (পর্ব-৩)

মাহফুজুল ইসলাম
Published : 24 Oct 2014, 10:18 AM
Updated : 24 Oct 2014, 10:18 AM

বেশ কিছু ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদগন প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সন্তুষ্টিলাভের জন্য দুর্বলচিত্তের জাতি বা সম্প্রদায়কে বিকৃতভাবে হেনস্হা  করে ইতিহাস রচনা করেন । সেই সব ইতিহাসবিদগন সাধারণ মানুষের মনে নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে অত্যাচারী বা লম্পট শাসকরূপে এবং তার পতনের পিছনে প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীদের আড়াল করে শুধু মাত্র মীরজাফরকে দোষী চিহ্নিত করে প্রকৃত সত্য ঘটনাকে আড়াল করে রেখেছেন । তেমনই এক দৃষ্টান্ত নবাব সিরাজ উদ দৌলা । ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিভিন্ন দালিলিক প্রমানপত্রে স্পষ্ট ভাবে লেখা আছে বাংলার শেষ নবাবের পতনের পিছনে মূল ষড়যন্ত্রকারী কে কে ছিল । আমি শেষ পর্বে এই রকমই কিছু দালিলিক প্রমান পত্র উপস্হাপন করব ।

সম্রাটের দুটি ফরমান ও সুবেদারের নিশানা বলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজস্ব কুঠিতে বসবাস করে বিনা মাশুলে অবাধ বানিজ্য করার সুবাদে অন্যান্য বনিকরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল । কোম্পানির রিপোর্ট লেখক ব্রুস সাহেবের মতে এ সময় বানিজ্যে মাশুলের হার ছিল বিদেশী বনিকদের শতকরা সাড়ে তিন টাকা, মুসলিম ব্যবসায়ীদের আড়াই টাকা, হিন্দুদের পাঁচ টাকা । তবে ইংরেজ বনিকদের মাশুল দিতে না হলেও মাঝে মধ্যে দরবারে উপস্হিত হয়ে নবাবদের দেশী মুদ্রা ও বিলাতী দ্রব্য উপহার দিতে হতো । বিদেশী বনিক বাদ দিয়ে দেশের ভিতরে বানিজ্যের ক্ষেত্রে যে সামাজিক বৈষম্য বিরাজ করছিল এটাও মুসলিম সাম্রাজ্য পতনের একটা কারণ ।

কুঠি করার জন্য প্রাপ্ত ভূমিই পরবর্তীতে ইংরেজ বনিকদের ঠিকানা ছিল । এই ঘটনার কয়েক বছর পর ভারতের মাটিতে আস্ত একটা বন্দর প্রাপ্তি ঘটেছিল  ইংরেজ বনিকদের । ১৬৬০ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় চার্লস ইংল্যান্ডের সিংহাসনে  বসার  পর পূর্তগীজ রাজকুমারী ক্যাথরিনের সাথে তার বিবাহ হয় । এই বিবাহে পূর্তগীজ রাজা কন্যার জামাতাকে যৌতুক হিসেবে পশ্চিম ভারতে পূর্তগীজদের অধিকৃত কালান নামক বন্দরটি দান করেন ১৬৬৫ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে । সেই বন্দরটিই এখন আধুনিক মুুম্বাই  ।

১৬৬৬ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বরে চার্লস ভারতে বানিজ্যরত  ইংরেজ বনিকদের কাছে কালান বন্দরকে বাৎসরিক বার হাজার পাউন্ডে  লিজ দেন । এরপর থেকেই ইংরেজ বনিকরা মাথা ঘামাতে শুরু করে ভারতের মাটিতে ইংরেজ কলোনী করা যায় কিনা । কিন্তু কলোনী করার জন্য তো নিজস্ব জমি দরকার । বুদ্ধি থাকলে সবকিছুই সম্ভব । ইংরেজ বনিকরা জানত এদেশের নবাবদের খুশি করতে পারলেই সব কিছু আদায় করা সম্ভব । কোম্পানির কর্মকর্তারা দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের সহায়তায় ১৬৯৮ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে ধুরন্দর ইংরেজ কর্মচারী মিঃ ওয়ালেসকে বর্ধমানে পাঠিয়ে দেয় । সে সময় বর্ধমান ছিল সুবে বাংলার পশ্চিম অঞ্চলের রাজস্ব উশুলের তহশিল দপ্তর । মিঃ ওয়ালেস বেশ কিছুদিন ধর্না দিয়ে সুবেদার আজিমুশসানের সাথে সাক্ষাত করে বিলাতী দ্রব্যের উপটৌকন আর দেশীয় ১৬ হাজার আসরুপি নজরানা দিয়ে ৫৪৫২ বিঘা জমি কিনার অনুমতি নিয়ে নেন । মিঃ ওয়ালেস সাহেব সুবেদার আজিমুশসানের নিকট হতে অনুমতি লাভের পর পরই সহযোগীদের সাথে দ্রুত তাদের ঠিকানা হুগলিতে ফিরেই কাল বিলম্ব না করে চাঁদপাল ঘাটের পূর্ব ও উত্তর দক্ষিনের তিনটি গ্রাম জমিদার সুবর্ণ চৌধুরীর নিকট থেকে কিনে নেন । মূলত ক্রয়কৃত ঐ জমিগুলো ছিল জঙ্গল আর পতিত । জমি কিনার সাথে সাথেই জঙ্গল পরিস্কার করে একটি দুর্গ তৈরীর কাজে হাত দেন । একই সাথে চাঁদপাল ঘাটের পূর্ব দিকের জঙ্গল পরিস্কার করে একটি শহর তৈরীর কাজেও হাত দেন । ঐ শহরই আজকের কলকাতা নগরী । ১৭০০ খৃষ্টাব্দের শেষের দিকে এই দুর্গেরই নাম করণ করা হয় ফোরট উইলিয়াম ( মাটির নীচে ক্যান্টনমেন্ট স্হাপন করা হয় ) । এই দুর্গ থেকেই নৌ সেনাপতি ওয়াটসন আর স্হল সেনাপতি কর্নেল ক্লাইভ সেনাবাহিনী পরিচালনা করে নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতন ঘটিয়েছিল ।

১৭১২ খৃষ্টাব্দে মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হয়েই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকদের ডেকে বানিজ্য করার মাশুল দিতে বলেন অন্যথায় বাংলা ছাড়তে বলেন । নবান মুর্শিদ কুলি খাঁর এহেন পদক্ষেপে কোম্পানির গভর্নর হেজেস ১৭১৭ খৃষ্টাব্দে এ্যাডওয়ার্ড ষ্টিফেনসন ও জন সরম্যান নামক দুজন কঠিয়ালকে প্রতিনিধি করে দিল্লীর বাদশাহকে বিষয়টি অবগত করার জন্য পাঠিয়ে দেন । সাথে এদের উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন ডাঃ হ্যামিলটন । দিল্লীতে গিয়ে এরা শুনেন বাদশাহ  গুুরুতর  অসুস্হ । বিলেতী মূল্যবান বস্ত্র কাঁচ পাত্র ও অন্যান্য সামগ্রী শাহী মহলে পাঠিয়ে দিয়ে মেহমান খানায় অপেক্ষা করতে থাকেন । দিল্লীর বাদশাহ ফরুখ শিয়ার ডাঃ হ্যামিলটনের অধীনে চিকিৎসা নিততে থাকেন ও দ্রুত সুস্হ হয়ে উঠেন । দিল্লীর বাদশাহ খুশিতে গদগদ হয়ে সম্র্রাট শাজাহানের জারিকৃত ফরমানকে সামনে রেখে আরও একটি ফরমান জারি করেন । এই ফরমানে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বানিজ্যের সকল মাশুল রহিত করণ ছাড়াও আরও চারটি বিশেষ সুবিধা লাভ করে । প্রথমত কোলকাতার দক্ষিনের ৩৮ টি গ্রামের প্রজাস্বত্ব ক্রয়ের ক্ষমতা, দ্বিতীয়ত কোম্পানির নিকট ঋনগ্রস্ত দেশী ও বিদেশী সকলকেই গ্রেপ্তারের ক্ষমতা, তৃতীয়ত কোম্পানির কোন পন্যই বাংলার রাজ কর্মচারীগন আটক না করার ক্ষমতা, চতুর্থত ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে মুদ্রা তৈরীর ক্ষমতা । এই বিশেষ চারটি ক্ষমতা চাওয়ার পিছনে দেশীয় হিন্দু রাজাদের ষড়যন্ত্র ছিল ।

১৭৫৬ খৃষ্টাব্দে ৯ এপ্রিল নবাব আলীবরদী খাঁর ইন্তেকালের পর সিরাজ উদ দৌলা মুর্শিদাবাদের মসনদে আসীন হন । এরপর রাজ্যের প্রথা অনুযায়ী দেশের গন্যমান্য ব্যক্তি সওদাগর ব্যবসায়ীগন যথারীতি নজরানা সহ দরবারে উপস্হিত হয়ে নতুন নবাবকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করে । এই সংবাদ দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর বিদেশী বনিকরাও যথারীতি উপটৌকন নিয়ে দরবারে উপস্হিত হয়ে নতুন নবাবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেন । কিন্তু ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেউ অভিনন্দন জানাতে দরবারে কেউ উপস্হিত হননি । এদিকে মহারাজা নন্দকুমার ও দেশীয় হিন্দুরাজাদের পরামর্শে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের ইচ্ছামত কুঠি নির্মাণ ও দেশের মানুষের উপর জুলুম নির্যাতন করতে থাকে  ।