বন্যার্তদের দুর্ভোগ বনাম গণমাধ্যম কর্তাদের রসিকতা

জামাইল বশীর (জেবি)
Published : 17 August 2017, 01:16 AM
Updated : 17 August 2017, 01:16 AM

.

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের দেয়া তথ্যমতে, সরকারী হিসেবে দেশের বন্যা কবলিত ২২ জেলায় এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১০৭ জন এবং পানিবন্দি আছে ৮ লাখ ৭০ হাজার ৫২টি পরিবারের প্রায় সাড়ে ৩৩ লাখ মানুষ।

এরপরেও দেশের তথাকথিত "সেলিব্রেটি" সাংবাদিকের ভাষায় এটা "কিচ্ছু না"! সেইসব গণমাধ্যমের কাছ থেকে দায়িত্বশীল খবর দূরের কথা, সত্য আশা করাই বৃথা। সাংবাদিকতার "এথিক্স", "নর্মস"…. এগুলো তো কল্পনার বাইরের জিনিস।

অবশ্য তাদেরও দোষ দিয়ে লাভ নেই। সাংবাদিকতার বড় একটি গুণ হল নিয়মিত পড়ালেখা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিষয় ভিত্তিক জ্ঞানার্জন করা, যা আমাদের দেশে (হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া) নেই বললেই চলে। আবার আপনি যদি এইসব জ্ঞান পাপীদের সামনে পড়েন দেখবেন তাদের মুখ দিয়ে মৌলিকতা, এথিক্স, নর্মস… শব্দগুলির খৈ ফুটছে।

এইসব বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানহীন অধিক পান্ডিত্য প্রদর্শনকারী সাংবাদিকদের অতি উৎসাহী বেহায়াপনার কারণে আমরা বারবার দ্বিধাগ্রস্থ হই।

বন্যা, ঝুঁকি, দুর্যোগঃ

বন্যা, প্লাবন ও জলাবদ্ধতা (Flood, Inundation, Waterlogging) শব্দগুলির আলাদা মানে থাকলেও গণহারে সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করে আমরা একজন গরীব চাষীর মাটির ঘরে একহাটু পানি ওঠার চেয়ে বড়লোকের শান বাধানো পুকুর ডুবে যাওয়াকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে ফেলেছি।

প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট কারণে কোন ব্যক্তির স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজে বিঘ্নসৃষ্টি ও কোনো কিছু হারানোর সম্ভাবনাই হচ্ছে ঝুঁকি। আর যখন ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে মৃত্যু আশংকা থাকে বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য বাইরের সাহায্য প্রয়োজন হয়, তখন তার জন্য এটা দুর্যোগ। আর পুরোটাই হচ্ছে আপদকালীন সময়। (সহজ ব্যাখ্যা, এর বেশি জানতে চাইলে নিজ দায়িত্বে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের বইপত্র পড়ুন।)

এই আপদকালীন ঘটনা যদি কোনো ব্যক্তির জীবনে নিয়মিত ঘটে তাহলে তার ঝুঁকির পরিমাণ কমে যায়। কারণ, বাস্তবিক অভিজ্ঞতায় সে বা তারা নিজেরাই আপদের সাথে "অভিযোজন" করে ফেলে।

.

কিন্তু যদি প্রথমবারের মত এই আপদ কারো জীবনে আসে তার ঝুঁকি দ্রুতই দুর্যোগে পরিণত হয়। এছাড়া আপদের দ্রুতগতিতা ও দীর্ঘব্যাপ্তিতাও অভিজ্ঞ ব্যক্তির ঝুঁকিকে দুর্যোগে পরিণত করে। যেমনটি এবার ঘটেছে উত্তরাঞ্চলে। ঢাকা থেকে অনেক জায়গায় হাটু পানি দেখলেও, সেই হাটু পানিই কেড়ে নিয়েছে ১০৭টি প্রাণ, বন্দি করেছে ৩৩ লক্ষাধিক মানুকে। নষ্ট করেছে কয়েক লক্ষ হেক্টর ক্ষেতের ফসল, ধ্বংস করেছে হাজার হাজার স্থাপনা, বিপন্ন করেছে লক্ষাধিক গৃহপালিত পশু-পাখির জীবন। এছাড়াও উজাড় হয়েছে হিসেবহীন প্রাকৃতিক সম্পদ। অনেক জায়গায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সরকারের "অপ্রতুল" ত্রাণের অংশটুকুও দুর্গতদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। পানিবন্দি মানুষ, সাথে গবাদী পশু-পাখি না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। শিশু, গর্ভবতী নারী ও বৃদ্ধরা আছে চরম দুর্ভোগে। আছে খাবার পানির তীব্র সংকট।

এগুলো যদি কারো কাছে "কিচ্ছু না" হয়ে থাকে, তাহলে তার মস্তিস্কের চিকিৎসা অতি জরুরী।

বন্যার পানি চিরস্থায়ী নয়, উত্তরে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পানি কমতে শুরু করলেও যমুনার পানি বেড়ে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর জেলার বিস্তৃর্ণ অঞ্চল। বাংলাদেশের ভূমিরূপ উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে ঢালু। উত্তরের বন্যার বিশাল জলরাশি বাষ্প হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে- এমন ধারণা করাটা বোকামী। এই পানি দেশের মধ্যাঞ্চল (ঢাকা ও আশপাশসহ) ভাসিয়ে বঙ্গোপসাগরে যাবে। যেখানে গত কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিতে মধ্যাঞ্চলের জলাধারগুলো ইতোমধ্যেই পানিতে টইটম্বুর হয়ে আছে। আবার ওয়েদার ফোরকাস্টে আগামী কদিন ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা ও ২১শে অগাস্ট আমাবস্যার ফলে সৃষ্ট জোয়ারের পানি মোহনাতে বানের জলকে সাগরে যেতে বাধা দিবে। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলেও তাৎক্ষণিক বন্যার সম্ভবনা আছে।

গণমাধ্যমের কাছে আবেদন, সঠিক তথ্য দিতে না পারলে অন্তত দুর্গতদের নিয়ে মশকরা করবেন না। সরকার, বিভিন্ন এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ সংগ্রহ চলছে। আপনিও সহযোগিতা করুন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সহায় হোন। নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যকেও নিরাপদ থাকতে সাহায্য করুন। দুর্গতদের পাশে দাঁড়ান।