মহাকবি ইকবাল কেবল পাকিস্তানের কবি নন। সীমানা ছাড়িয়ে গেছে তাঁর কাব্য; বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর খ্যাতি। বিদেশি ভাষায় তাঁর রচনাবলীর তরজমার কলেবর দিন দিন হচ্ছে পরিবর্ধিত। দেশ-বিদেশের সাহিত্যিক, পণ্ডিত ঐতিহাসিক ও দার্শনিক সমাজে তাঁর সাহিত্যকীর্তি সম্পর্কে সৃষ্টি হয়েছে প্রবল আগ্রহ। সত্যি বলতে কি, ইকবালের সাহিত্য-সাধনার সুচারু পরিক্রমণ ব্যতিরেকে পাক-ভারতের আধুনিক সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস সম্পর্কে কোনো প্রকার ঐকান্তিক গবেষণা মোটেই সম্ভব নয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ভুক্ত দেশগুলোতেও মহাকবি ইকবাল সুপরিচিত। রুশ ভাষায় বেশ ক'বারই তাঁর কাব্য সংকলন অনূদিত হয়েছে। তাজিকিস্তানে তিনবার তাঁর কাব্যের তর্জমা প্রকাশিত হয়। মশহুর তাজিক কবি মীর সাঈদ মীর সাকেব রচনা করেছেন তরজমাগুলোর মুখবন্ধ। তাজিকরা এখন ফরাসী ও মাতৃভাষায় ইকবালের কাব্যসুধা পান করতে পারে! সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাচ্য ভাষাবিদদের ইকবালের সাহিত্যচর্চা প্রসঙ্গে একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে। ইকবাল এই সেদিনও তাঁদের কাছে ছিলেন রাজনীতিক ও দার্শনিক। তাঁর গবেষকদের মধ্যে ঐতিহাসিক লিউডমিলা গর্ডন পনস্কয়া ও দার্শনিক নিকোলাই অনিকেভের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। দর্শন ও রাজনীতির বেদীতে বসিয়েই তাঁরা ইকবালকে বিচার করেছেন, করেছেন তাঁর সাহিত্য সাধনার মূল্যায়ন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, রাশিয়ায় ইকবাল চর্চার ক্ষেত্রে এঁরা দু'জন হলেন পথিকৃৎ। নাতালিয়া প্রিগারিনার গবেষণামূলক প্রবন্ধটি রাশিয়ায় কবির বহুমুখী প্রতিভার সাথে পরিচিত হওয়ার নবতর প্রচেষ্টা হিসেবে একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। রুশ বিজ্ঞান একাডেমীর এশীয় ইনস্টিটিউটের এই সুধী মহিলা তাঁর থিসিসে কবি ইকবালের দর্শনসম্পৃক্ত গীতি-কবিতাগুলোর বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্যের বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। ইকবাল সম্পর্কে রাশিয়ায় এটিই প্রথম বড় রকমের গবেষণা। নাতালিয়া প্রিগারিনা সুদীর্ঘ দশটি বছর ধরে ইকবালের রচনাসমগ্রে নিমগ্ন ছিলেন। তিনি কবির সাধনাকে করেছেন মন্থন। কবি সম্পর্কে তিনি অনেকগুলো প্রবন্ধ লিখেছেন, সেগুলো প্রকাশিতও হয়েছে বিভিন্ন রুশ পত্র-পত্রিকায়। ঐ আলোচ্য থিসিসটিতে তিনি কবির অগাধ পাণ্ডিত্যের গভীরতম প্রদেশে প্রবেশ করতে চেয়েছেন, কবির অননুকরণীয় সৃজনশীল ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ দার্শনিক কবি ইকবালের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর সাহিত্য সাধনার সাথে পরিচিত সকল সুধী ব্যক্তিই একবাক্যে এ কথা স্বীকার করেছেন। ধর্ম ও দর্শনের অবয়বে যে মানবত্ববোধ কবির রচনায় বাঙ্ঘময় হয়ে উঠেছে, নাতালিয়া তার স্বরূপ আন্দোলনের পটভুমিতে রচিত কবির গীতিকাব্য বিচার করতে গিয়ে মানুষ সম্পর্কে কবির ধারণা থেকেই বিশ্লেষণ শুরু করেছেন। 'আসরারে খুদী' ও 'রুমূযে বে-খুদী' এই দুই কবিতায় তিনি কবির মর্দে মুমিন দর্শন বিশ্লেষণ করেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন। কবি প্রথমটিতে মানবের সীমাহীন সম্ভাবনার জয়গান এবং দ্বিতীয়টিতে মানুষের সমাজ সেবার পবিত্র দায়িত্বের বাণী প্রচার করে গেছেন। নাতালিয়া ইকবালের শ্রেষ্ঠতম রচনা 'পয়াম-ই-মাশরিক' (প্রাচ্যের বাণী)-এ কাব্যের ভাবাদর্শ, শব্দ চয়ন ও স্টাইলের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেন যে, কাব্যটি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। কারণ এটি একটি অত্যুৎকৃষ্ট ও অনন্য কাব্য; দর্শন ও কাব্য-সৌন্দর্যের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটছে এই কাব্যে। নাতালিয়ার মতে, কাব্যটিতে কবি ইকবাল দার্শনিক ও রাজনীতিক ইকবাল থেকে অনেক অগ্রগামী। নাতালিয়ার ভাষায়, ইকবাল রোমান্টিক কবি। তবে কবির রোমান্টিসিজম ও তাঁর মনে ক্রিয়াশীল পাশ্চাত্য ভাবধারায় আগুনের মাঝে তিনি টেনে দিয়েছেন সীমারেখা। ইকবালের কাব্যের ইমেজ নতুন, নতুন এর বিষয়বস্তু, বিশ শতকের প্রথম যাদের বৈপ্লবিক ভাব-তরঙ্গে আবেগচঞ্চল। প্রথম মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে ও রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক অক্টোবর বিপ্লবের প্রত্য প্রভাবে ১৯১৩-২৩ সালে ভারতের বৈপ্লবিক জাগৃতির ণে রচিত কবিতাগুলো ইকবালের দেশাত্মবোধ ও নাগরিকবোধে ভাস্বর। এ প্রসঙ্গে কবির সামাজিক ও নৈতিক ধ্যান-ধারণার রূপায়ণের যে প্রভাব, নাতালিয়া প্রিগারিনা তা ব্যাখ্যা করেছেন। উপসংহারে নাতালিয়া বলেন যে, কবির কাব্যের সুর লহরী ও মোহিনী শক্তিতে পাঠক মায়ামুগ্ধ ও বিমোহিত না হয়ে পারে না। কবিতার প্রতিটি কথা, প্রতি চরণের সাথে ইকবালের সত্তা নিবিড়ভাবে মিশে আছে। তাঁর কবিতা পড়লেই মনে হয়, এগুলো যেনো শুকনো খড়। সেই খড়ে লেগেছে আগুন। মৃদুমন্দ হাওয়ার পরশে সেই আগুন গনগনিয়ে উঠেছে বারুদের মতো। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে খড়কুটোকে এবং সর্বশেষ তা অপরের হৃদয়ে জ্বেলে দিচ্ছে অনির্বাণ অগ্নিশিখা।
[রুশ লেখক এল. মিরনভের কলম থেকে-সংকলিত]