রামুতে ‘জামায়াতি’ সন্ত্রাস

সালাহউদ্দীন আহমদ
Published : 17 Feb 2011, 05:12 AM
Updated : 2 Oct 2012, 09:40 AM

ওরা সবসময় সক্রিয় থাকতে চেষ্টা করে। নিজেদের হীন কায়েমী স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ওদের চেষ্টার শেষ নেই। এ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকুক এটা ওরা কখনও-ই চায়নি। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মুক্তবুদ্ধির বাংলাদেশ গঠনের বিরুদ্ধে সবসময় কাজ করেছে ওরা। একটি কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এই অঞ্চলে ঐতিহাসিক কাল থেকেই ধর্মীয় সহিষ্ণুতা নষ্ট করার চেষ্টা করে গেছে। সফল ওরা কখনও-ই হয়নি। এখনও হবে না বলে আমি আশাবাদী।

দেশের পার্বত্য অঞ্চলে অস্থিরতা ছিল দীর্ঘদিন থেকেই কিন্তু সেখানকার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা বা ঘরবাড়ির ওপর এত ব্যাপক হামলার ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। রামু, উখিয়া, পটিয়া, টেকনাফে আজ যা ঘটেছে তা অকল্পনীয়। ওই কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীটি কি তাই চাচ্ছিল? শুনেছি ফেসবুকে কক্সবাজারের এক বৌদ্ধ তরুণের ওয়ালে কিছু একটা প্রকাশ নিয়ে এ নিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। এটা কেন হবে? আমার ধর্মকে কেউ অবমাননা করেছে–এ যুক্তিতে অন্যের ধর্মকে আমি অবমাননা করব? ফেসবুকের ওই তথাকথিত বিষয়টি নিয়ে ইসলামকে কতটা অবমাননা করা হয়েছে তা আমি নিশ্চিত নই। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, কিছু লোক এ দেশে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের অস্তিত্ব থাকুক সেটা চায় না। আর চায় না বলেই নানা যুক্তিতে তারা অন্য ধর্মের মানুষের বিশ্বাস ও মর্যাদায় আঘাত করে বারবার।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলাও ওদের একটি উদ্দেশ্য। ওরা চায় না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি সরকার ক্ষমতায় থাকুক। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী এ দেশের রাজাকার-আলবদরদের বিচার হোক। আর তাই এ সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে প্রকট করে তোলা ওদের উদ্দেশ্য। পানিটা ঘোলা হলে ওরা তো সহজেই মাছ শিকার করতে পারবে।

আমার জন্ম ১৯২২ সালে। ব্রিটিশ পিরিয়ড দেখেছি, পাকিস্তান আমলও দেখলাম। এরপর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের গর্বিত অভ্যুদয়ের সাক্ষী হয়েছি। আমাদের প্রজন্মটিকে 'ত্রিকালদর্শী' বলা হয়। ১৯৪৬ সালে আমি পরিপূর্ণ যুবক। সে সময় এই ভূখণ্ডে সাম্প্রদায়িক সংহতি নষ্ট করার চেষ্টা করেছিল কিছু কায়েমী গোষ্ঠী। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এই ভূখণ্ডে সরকারের মদদেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে। কারণ পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি সহিষ্ণুতা ছিল না।

কিন্তু এখানকার বাঙালি জাতি তখন পাকিস্তানের কৃত্রিম ধর্মভিত্তিক জাতিসত্তার বাইরে গিয়ে, ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর প্রতিবাদ করছিল। বাঙালির এই চেতনার পূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজন ছিল নতুন একটি রাষ্ট্রগঠন যে রাষ্ট্রের ধারণাটি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মধ্যেই ছিল। জিন্নাহসহ অন্যান্য মুসলিম লীগের নেতাদের ষড়যন্ত্রের মুখে যে ধারণাটির সঙ্গে প্রতারণা করে গঠিত হয়েছিল একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র 'পাকিস্তান।' এ রকম একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। আর সে জন্যই ষাটের দশকের মধ্যে তারা ব্যাপক হারে ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে যান। পঁয়ষট্টিতেও এখানে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিকে অস্থির করার চেষ্টা হয়েছিল, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে।

সবসময়ই দেখেছি, এক সম্প্রদায়ের ওপর অন্য সম্প্রদায়ের হামলার ঘটনায় রাষ্ট্র যে ধর্মাবলম্বীদের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়, বিশেষ কোনও ধর্মকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা গঠন করে রাষ্ট্রকে ওই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়- তখন ওই রাষ্ট্রে অন্য ধর্মের মানুষ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হন। তাই তারা নিজেদের বাঁচাতে অন্য কোনও রাষ্ট্রে চলে যেতে চান যেখানে তুলনামূলকভাবে তাদের জন্য অনুকূল কোনও পরিবেশ আছে বা যে রাষ্ট্র ধর্মভিত্তিক নয়, ধর্মনিরপেক্ষ।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর আমাদের এখানে এক শ্রেণির লোকের ধারণাই ছিল যে এখানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের কোনও প্রয়োজন নেই। তারা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ ভারতে চলে যাক এটা রাষ্ট্র চেয়েছিল। তাই অসংখ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভিটেমাটি ছেড়ে পরবাসী হতে না চাইলেও বাধ্য হয়েছেন একসময়। এভাবে পাকিস্তানের আড়াই দশকের মধ্যে এখানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল।

পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার সময়ই বাঙালি জাতির মধ্যে একই নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাগত ঐক্যের কারণে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে। এই চেতনার মূলে ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা। তাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু ওই যে বললাম, বিশেষ একটি গোষ্ঠী কখনও-ই চায় না এ দেশটা আধুনিক একটি রাষ্ট্রে পরিণত হোক। তাই তাদের ষড়যন্ত্রে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুক নৃশংসভাবে হত্যা করা হল। এর পর থেকে শুরু হল আমাদের উল্টোরথে যাত্রা।

পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসনামলের প্রতিটি সরকারই আমাদের এ ভূখণ্ডে ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। সত্তরের দশকে জিয়া রাষ্ট্রের চার মূলনীতিকেই বদলে ফেললেন। বাদ গেল ধর্মনিরপেক্ষতা। এর বদলে যোগ করা হল 'পরম করুণাময় আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস।' এভাবে রাষ্ট্রকে বিশেষ ধর্মের অনুগামী করা শুরু হল। আশির দশকে এসে এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করলেন। এরপর থেকে কিন্তু অন্য ধর্মাবলম্বীরা এ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হলেন।

অন্য ধর্মাবলম্বীকে আঘাত করা, তার ধর্মীয় আচারবিধি পালনে বাধা দেওয়া, তাকে নিজ গৃহে পরবাসী করে রাখাই ধর্মভিত্তিক কোনও রাজনৈতিক দলের অন্যতম মূল লক্ষ্য। তা না হলে তো তার পক্ষে নিজেদের হীন স্বার্থ হাসিল করা সম্ভব নয়। এ রকম কিছু দল বা গোষ্ঠীর মদদে এ দেশে পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা বন্ধ করার চেষ্টা বরাবরই হয়েছে। ওরা সফল হয়নি, কারণ বাঙালি জাতি ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করেছে সবসময়। বাঙালি মুসলমান যেমন হিন্দুদের পূজা-পার্বণে অংশীদার হয়েছে- বাঙালি হিন্দুও তেমন মুসলামানের ঈদ-উৎসবে শরীক হয়েছে। এভাবেই এখানে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বজায় থেকেছে।

কিন্তু পরমতসহিষ্ণুতার এই চর্চা যাদের ভালো লাগেনি তারা মানুষকে সবসবময় নানা ইস্যুতে উস্কে দিতে চেষ্টা করেছে। নব্বইয়ের দশকে ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের চেষ্টার পর আমাদের দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। আমরা যারা ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ চেয়েছি সবসময়- তারা তখন কায়েমী স্বার্থবাদীদের ওই প্রচেষ্টা রুখে দিতে কাজ করেছি। এরপরও নানাভাবে চেষ্টা হয়েছে। ওরা পারেনি।

এখন আবার ওই চিহ্নিত গ্রুপগুলোই আমাদের সাম্প্রদায়িক সংহতি নষ্ট করার চেষ্টা করছে। তা না হলে ফেসবুকের একটি অনুল্লেখযোগ্য বিষয়কে সামনে নিয়ে আসার প্রয়োজন কী ছিল? এরা সেই পুরনো জামায়াত-শিবির গোষ্ঠী। জানা গেছে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘিরে ওদের কিছু তৎপরতা আছে। গত জুনে মিয়ানমারে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী ব্যাপক হামলা চালিয়েছিল। জানমাল বাঁচাতে ওরা এ দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। গত দু'দশক ধরে এভাবে নানা সময়ে নিপীড়নের ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এ দেশে এসেছে। রোহিঙ্গা সমস্যার একটি কার্যকর সমাধান চাওয়ার পরিবর্তে ওই গোষ্ঠীটি বরং ওই জনগোষ্ঠীকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। আরও ব্যাপক আকারে করতে চাচ্ছে। তাই ওরা এখন দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে অস্থিরতা তৈরি করছে।

তবু আমি মনে করি ওরা সফল হবে না। সরকার দ্রুত এই বিষয়গুলোতে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে। রামুতে তিনশ বছরের পুরনো বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ভগবান বুদ্ধের যে মূর্তিটি অহিংসাবাণী ছড়িয়ে দিতে টিকে রয়েছে- মানবতার জয়গান কিন্তু ওখানেই। এই সত্যটি যদি আমরা ভুলে যাই তবে মানুষ হিসেবে আমরা নিকৃষ্টতার প্রমাণ রাখব। আমি আশাবাদী। খুবই আশাবাদী। বাঙালি জাতি তার ধর্মনিরপেক্ষতা ও পরমতসহিষ্ণুতার চেতনা থেকে সরে যাবে না।

ড. সালাহউদ্দীন আহমদ: জাতীয় অধ্যাপক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।