জয়তু জননেতা আজিজুর রহমান

Published : 1 Feb 2012, 10:32 AM
Updated : 1 Nov 2020, 12:15 PM

বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ সংগঠক জননেতা অ্যাডভোকেট মো. আজিজুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী আজ ১ নভেম্বর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী। তারা একইসাথে বেকার হোস্টেলে থাকতেন। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী হিসাবে রাজনীতি করতেন কোলকাতায়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সত্যতার নিরিখে দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করা যায়, ১৯৭১ সালে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হলে দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সভাপতি হিসাবে তিনি দিনাজপুর শহরের পাহাড়পুর মহল্লায় তার বাসায় বিদ্রোহের সূত্র ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন এবং ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক নির্দেশনায় বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নির্বাচিত আহ্বায়ক হিসাবে জেলায় নেতাকর্মী ও তরুণদের সংগঠিত করেন। ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলে দিনাজপুর চলে গেলে, বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আঙ্গিক বদলে তাকে সভাপতি করে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় পরিষদ গঠিত হয়। একাত্তরের জুলাই মাসে যুদ্ধ সেক্টরগুলো পূর্ণতা পাবার আগ পর্যন্ত এ পদাধিকারবলেই মো. আজিজুর রহমান এম,এন,এ দিনাজপুর কেন্দ্রীয় মুক্তি-সংগ্রাম কমিটির সভাপতি হিসাবে মুক্তিযুদ্ধকালীন তার লেটারহেড প্যাডে অসংখ্য নির্দেশনা জারি করেছেন।

অতি গুরুত্বের সাথে ইতিহাস মনোযোগীদের জন্যে বলা দরকার, মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো সম্পন্ন করলে, তাকে মুক্তিযুদ্ধের ৭ নং এবং ৬ নং সেক্টর (অর্ধেক) অঞ্চলের লেফটেন্যান্ট  জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার, ফ্রিডম ফাইটার্স রিক্রুটিং ও লিয়াঁজো অফিসার পদে দায়িত্ব প্রদান করে। জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ৩০ অগাস্ট জারি করা গোপন পরিপত্র নং: ০০০৯জি/২ অনুযায়ী মো. আজিজুর রহমানের সদর দফতর ছিল ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত তরঙ্গপুরে।

মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত সেই গোপন পরিপত্র অনুয়ায়ী কার্যত তিনি ৭ নং এবং ৬ নং (অর্ধেক) সেক্টরের সকল মুক্তিযোদ্ধার রিক্রুটিং ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনায় সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ছিলেন। উক্ত সেক্টরের সামরিক কমান্ডার এবং অধীনস্ত সকলের জন্যে বেসামরিক বিষয়ে তার নির্দেশ মানাটা ছিল বাধ্যতামূলক। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য বিষয়েও পরামর্শ দেবার এখতিয়ার তার ছিল। সকল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তার সামরিক বিষয়ে প্রদত্ত পরামর্শ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সেক্টর কমান্ডারকে জানানোর নির্দেশ ছিল।

উল্লেখ্য, তিনি পশ্চিমাঞ্চল প্রশাসনিক 'ক' জোনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসাবেও দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এর উল্লেখ পাওয়া যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের অবিকৃত তালিকার লাল বই খ্যাত দলিলে লিখিত মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাঠামোয়। দলিলটি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত আছে। সে দলিল অনুযায়ী প্রথমেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম রাষ্ট্রপতি হিসেবে। প্রত্যেকের জন্যে অপরিবর্তনীয় একটি ইউনিক কোড রয়েছে সেখানে। যেমন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্যে প্রথমটি, কোড হলো ০৭০০০০০০০১। এই দলিলের ৯ নম্বর পৃষ্ঠায় 'স্বাধীনতার বীর সেনানী, স্বরণীয় যারা বরণীয় যারা' শিরোনাম অধিভুক্ত ক্রম অনুযায়ী আমার পিতা অ্যাডভোকেট মো. আজিজুর রহমান এর কোড দুবার এসেছে। প্রথমবার পশ্চিমাঞ্চলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে ০৭০০০০০০২১ এবং পরে দিনাজপুর-২ আসনের এম,এন,এ হিসাবে ০৭০০০০০০৩৯।

মূলত মো. আজিুজর রহমানের নেতৃত্বের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসক মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশদ্রোহীতা ও তিন হাজার লোককে গণহত্যার অভিযোগ এনে অক্টোবর মাসে সামরিক আদালতে তাকে হাজির হতে সমন জারি করে এবং পরে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি) রিপোর্টে বলা হয়, "১৭ আগস্ট ১৯৭১ দুই দফায় ৩০ এমএনএ-কে সামরিক আদালতে তলব। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে ঠাকুরগাঁয়ের মো. আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ সহযোগিতা ও ৩০০০ লোকের হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে আছে এক গর্ভস্থ মহিলাকে হত্যার পর টুকরা টুকরা করা। এরপর গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে।"

যুদ্ধের সময়ে দেখা যায়, তিনি কয়েকদফা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং দেশের ভেতর জুন মাসে অ্যামবুশে আটকা পড়েন। ধরেই নেয়া হলো তিনি নিহত। ফলে সীমান্তে এবং রায়গঞ্জে আব্বার গায়েবানা জানাজা পড়া হয়। এর দিন কয়েক পর ভারতীয় শিখ সৈন্যরা লড়াই করে আব্বাকে উদ্ধার করে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনে। তার অসীম সাহসের কারণেই তিনি একমাত্র নেতা, যিনি মিত্রবাহিনীর অগ্রগামী দলের সাথে যুদ্ধ করে ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁয়ে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দেন। তিনি ১৯৭১ সালে ২০ ডিসেম্বর দিনাজপুর শহরের গোরে শহীদ ময়দানে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর উপস্থিতিতে বিজয় উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন। তিনি ঐ অঞ্চলে শরনার্থী প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনেও নেতৃত্ব দেন।

যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন দেখতে পাই, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে দিনাজপুর শহরে ১৯৫২ সালে আওয়ামী লীগের প্রথম দিনাজপুর জেলা কমিটি গঠিত হয়। তখনকার দিনাজপুর জেলা হলো এখনকার দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় মিলিয়ে। সে জেলার প্রথম সভাপতি ছিলেন রহিমুদ্দিন উকিল সাহেব। কিন্তু ১৯৬৬ সালে জুন মাসে ছয় দফা ঘোষণার পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল জেনারেল আইয়ুব খানের জেল জুলুমের ভয়ে রহিমুদ্দিন সাহেব দল ছেড়ে দিলেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলীও চলে গেলেন জেনারেল অইয়ুব খানের দল পিডিবি'তে। দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ হয়ে পড়ল ফাঁকা। বঙ্গবন্ধুর সাহস সাথে করে তার আদর্শকে ধারণ করে রাজপথে রুখে দাঁড়ালেন জনতার অকুতভয় নেতা অ্যাডভোকেট মো. আজিজুর রহমান। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবে মাঠে থাকলেও, দৃশ্যত তিনি সভাপতি হয়ে উঠলেন জনমানসে।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মেহরাব আলী তার সম্পাদিত দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র, ৫ম খণ্ডে লিখেছেন, "দিনাজপুর বারের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, সুলেখক, সম্পাদক, সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ, দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহম্মদ আজিজুর রহমান 'আওয়াজ' নামে দিনাজপুরের সাপ্তাহিক পত্রিকা বার করেন ১৯৫৫ সালে। সেই সময়ে এই পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি যখন ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে বাঙ্গালীর জাতিসত্বা সৃষ্টিতে নবচেতনার উন্মেষ, রাজনীতিতে বিরোধী দলের উদ্ভব, স্বাধিকার ও সাধারণ নির্বাচনের দাবী, পাকিস্তানী স্বৈরশাসনে জর্জরিত জনজীবনে; তদুপরি বঙ্গবন্ধুর উদাত্ব আহ্বানে স্বাধীনতায় উত্তরণের সুষ্পষ্ট পূর্বাভাস – এমনই এক অস্থির অস্বস্থিকর পরিস্থিতিতে 'সাপ্তাহিক আওয়াজ' জেলাবাসীর মনোভুমি সৃষ্টিতে অসাধারণ চেতনা জাগায়।"

বঙ্গবন্ধুর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে, প্রায় দুইশত মাইল বিস্তৃত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় এক প্রান্ত হতে আরেক প্রান্তে টিনের চোঙ্গা হাতে ছুটে অকুতোভয় নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়ে ক্রমান্বয়ে দলকে চাঙ্গা করে তোলেন তিনি। জনগণও আওয়ামী লীগের ছাতার তলে এসে জমায়েত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় দিনাজপুরের নেতাকর্মীরা ভালোবেসে ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ এবং ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ তাকে দিনাজপুর জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করেন। তবে ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা পরবর্তী কাউন্সিল অনুষ্ঠিত না হওয়ায়, পূর্বের কমিটিই দায়িত্ব পালন করে, বিধায় মো. আজিজুর রহমান, এম,এন,এ ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন।

অ্যাডভোকেট মো. আজিজুর রহমান, এম,এন,এ স্বাধীনতা উত্তর সংবিধান প্রনয়ণে এম,সি,এ (মেমবার অব দ্যা কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লি) হিসেবে ২৬ অক্টোবর ১৯৭২ সালে সংসদে খসড়া সংবিধানের উপর এক ঘন্টার মূল্যবান বক্তব্যের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই উজ্জ্বল নেতা ১৯৪৫ সালে ডিস্টিংশন (৮৫% প্রতি বিষয়ে) সহ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে তৃতীয় স্থান অধিকার করে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। বৃটিশবিরোধী স্বদেশী রাজনীতির সাথে যুক্ত তার বিপ্লবী পিতা মাওলানা আকিমুদ্দিন সরকারের হাত ধরে তিনি স্কুল জীবনে ১৯৩৭ সালে শেরে এ বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পাটির সদস্যপদ গ্রহণ করে তার রাজনৈতিক অভিযাত্রা শুরু করেন।

ছাত্র জীবনে তুখোড় মেধাবী ও মানবিকগুণাবলী সম্পন্ন এ নেতার দুয়ার সকলের জন্যে ছিল উন্মুক্ত। ১৯২০ সালের ১ নভেম্বর তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহুকুমার মোহম্মদপুর গ্রামে স্বদেশী বিপ্লবী মওলানা আকিমুদ্দিন সরকার ও মা আলেকজা নেসার কোল আলো করে তিনি জন্ম নেন এবং ৪ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে দিনাজপুর শহরের ঘাসিপাড়া মহল্লায় ভাড়াবাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

দেশের এমন এক সূর্য সন্তানের জন্মদিনে তার পুত্র হিসাবে জনতার পক্ষ হতে তাকে স্মরণ করি। জয়গান গাই তার দেশপ্রেমের।