চীনের ডায়েরি: সাগর পাহাড় সবুজ প্রকৃতির দেশে

জয়নাল আবেদীন
Published : 8 August 2015, 03:16 PM
Updated : 8 August 2015, 03:16 PM

৮ জুন ২০১৫। ঘড়িতে ঠিক দুপুর ১২টা। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে উড়াল দিল 'চায়না সাউদার্ন'। অনেক যাত্রীর ভিড়ে আমিও একজন। সিট নম্বর ৪২(এ)। চীনের অন্যতম প্রধান এই বিমানের গন্তব্য বাণিজ্যিক নগরী গুয়াংজু।

এর আগে রাতে বিমান ভ্রমণ করেছিলাম। ফলে মেঘের ওপরের স্বচ্ছ নীলাকাশ উপভোগের সুযোগ হয়নি। এবার সুযোগ হলো। খণ্ড মেঘের ভেতরে লুকিয়ে গেল আস্ত বিমান। খানিক বাদেই দেখা গেল- আমরা তখন মেঘের ওপর। জমি থেকে তাকালে মেঘ তো দেখিই। মেঘের ওপরে আকাশের বিশালতা দেখলাম এবার।

আকাশে মেঘের উড়াউড়ি আর তার ওপরের নীল দেখতে দেখতে কখন যে সাড়ে তিন ঘণ্টা কেটে গেল বুঝতেই পারিনি। বিমানবালাদের আপ্যায়ন তো ছিলই। বাংলাদেশ সময় বিকাল সাড়ে তিনটায় বিমান অবতরণ করল চীনের বাইয়ুন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। সেখানে তখন সময় বিকাল সাড়ে পাঁচটা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ইমিগ্রেশনসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পাদন হলো।

তখনও এয়ারপোর্টের ত্রিসীমানা থেকে বের হইনি। গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় পা পড়লো না। সরাসরি বাসে। হ্যাঁ, বাস প্রস্তুত থাকে সবার জন্যই। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসগুলো সব রুটেই চলাচল করে। আপনি যেখানেই যেতে চান, পারবেন। অল্পবয়সী দুই মেয়ে লাগেজ নিয়ে জায়গামতো রেখে টোকেন হাতে ধরিয়ে দিল। আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে বাসের সিট বরাদ্দ। অর্ধেক সংখ্যক আসন খালি রেখেই বাস যাত্রা শুরু করল।

আমি যাচ্ছি গুয়াংজু সিটির সান ইয়ান লি এলাকায়। চাইনিজ মুদ্রায় ১৭ আরএমবি ভাড়া (এক আরএমবি মানে প্রায় ১৩ টাকা)। সুবিশাল বিমানবন্দরের সৌন্দর্য অবলোকন করে শেষ করা যায় না। প্রথম চীন ভ্রমণের শুভযাত্রা। অনুভূতির পারদ নড়তে শুরু করেছে। খুব কাছে থেকে দেখা চীন, যেন স্বপ্নের নগরী। ছবির মতো দেশ। যেদিকেই চোখ যায়, শুধই সবুজের আচ্ছ্বাদন। পরে জানতে পারলাম, গুয়াংজু শহরকে বলা হয়- গ্রীন সিটি।

আট লেন সড়ক ধরে এগোতে থাকে বাস। গতির ওপর নির্ভর করে একেক ধরনের যান একেক লাইনে চলছে। নিয়মের ব্যত্যয় নেই। কোথাও ট্রাফিক পুলিশের দেখা মেলে না। অথচ সিগন্যালে লাল বাতি জ্বলতেই থেমে যায় গাড়ি। নেই যানজট, জনজট। বাংলাদেশের করুণ অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে নেবার সুযোগ এলো বুঝি। বাসের ভেতরে বসে কাচ ভেদ করে এক ঝলকে যতটুকু দেখেছি, তাতেই আফসোস- কেন সফরসূচিটা আরেকটু দীর্ঘ হলো না! মাত্র সাতদিন- তাতে কী সম্ভব এত সুন্দর উপভোগের!

হঠাৎ চীন ভ্রমণ কেন? সেটা বলতে হবে না? সফরটা পূর্ব পরিকল্পনারই অংশ। না, সফরটা পেশাগত না। সাংবাদিকতার সকাল-সন্ধ্যা এই সাতটা দিনের জন্যে চুকে যাক! অন্যদিকে একটুখানি মনোসংযোগ দিতেই এই সফর। সেই দিকটাও বলা হবে। এখন না, পরে। সফরের প্রাপ্তি অনেক কিছুই। কিন্তু একটু শূন্যতা আমাকে পেয়ে বসে গোটা সাতটা দিন। সেটা হলো- আমার হৃদয়ের প্রাণভোমরা ছিল না সঙ্গে। বলছি শান্তা ইসলামের কথা; এ প্রথম বোধহয় দেশে বা বিদেশের কোন ট্যুরে শান্তাহীন আমি। অবশ্য সঙ্গে ছিলেন দুজন; শান্তার মা-বাবা- মীর মিজানুর রহমান এবং তাসলিমা রহমান।

প্রায় আধঘণ্টা চলার পর বাসের চাকা থামল আমাদের নামাতে। পৌঁছে গেলাম সান ইয়ান লি। গুয়াংজু সিটির ব্যস্ততায়। পূর্ব নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছেই ফ্রি ওয়াইফাই সংযোগ নিলাম। চীনে মোবাইল ফোনের কলরেট অনেক বেশি। সিমের নতুন সংযোগ হাজার টাকার অধিক। তবে যে কোন আবাসিক-অনাবাসিক হোটেল, অফিস এমনকি ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ওয়াইফাই সক্রিয়। ফলে সিম কিনতে হলো না। ওয়াইফাই সংযোগেই দেশে যোগাযোগের ব্যবস্থা হলো। প্রযুক্তির উৎকর্ষে বাংলাদেশও তো কম যায় না। গ্রামে ইন্টারনেটের গতির দুর্গতি বাদ দিলে বাকিটা তো আশাব্যঞ্জক। উইচ্যাট, হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার, আরো কত কি। চীনে পৌঁছে গেছি- এই মুডে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করতে যাবেন, ধাক্কাটা খাবেন তখনই। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা এই ফেসবুকটা যে নিষিদ্ধ চীনে!

উদ্দেশ্যমূলক ব্যস্ততার কারণে খুব একটা ঘুরতে যাওয়া হয়নি। কাজের ফাঁকে যতটা সম্ভব আশপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। এই ঘোরা তো কেবল ঘোরা না, আমি তো অন্য ঘোরেও আছি। সাংবাদিক তো। পেশাটাই কেমন জানি। যেখানে সেখানে সাংবাদিকতা না করলে যে পেটের খাবার হজম হতে চায় না! তাই, ওখানকার সুন্দরের ভেতরে আমি খোঁজার চেষ্টা করেছি প্রিয় জন্মভূমির অস্ফূটিত সৌন্দর্য। প্রকৃতিতে, নদীতে, রাস্তাঘাটে, পার্কে আমি খুঁজে পেয়েছি এই বাংলার লুকোনো সুন্দরের ছবি। আমাদের ব্যবস্থাপনা আর নজরদারির অভাবে হয়তো বাংলা নিজেকে মেলে ধরতে পারছে না। পারছে চীন। কারণ, তারা সভ্য। তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাদের আছে সঠিক নজরদারি, সুস্থ ব্যবস্থাপনা। তাতেই তারা সুখী-সমৃদ্ধ।

চীনের ভেতরে বাইরে বয়ে গেছে বহু সাগর-নদী। দেশটির সামুদ্রিক অঞ্চলের পরিমাণই তিন লাখ ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের অসংখ্য দ্বীপ আছে। চীন তো পাহাড়ের দেশও। দেশের মোট আয়তনের দুই-তৃতীয়াংশজুড়েই পাহাড়। নানা বৈচিত্র্যের এই দেশে মানুষের সংখ্যাও তো কম না। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার পাঁচভাগের এক ভাগ বাস করেন কেবল এই একটি দেশেই। সাগর ও পাহাড় বেস্টিত এই সবুজ প্রকৃতির দেশই হতে পারে আপনার ভ্রমণের অন্যতম লক্ষ্য।

রাতের চীন :
রাতের চীন ভালোই লাগল। সড়কের ওপর একাধিক উড়ালসড়ক। একটা, দুইটা, তিনটা করে চারটা পর্যন্ত গুনতে হলো কৌতূহলে। যানজট থাকবে কেন, যেখানে সড়কের ওপরে চার চারটি উড়াল সড়ক থাকে! চীনের শহরে রাতের আকাশে জোনাকির মিটিমিটি আলো নেই, তবে সড়কবাতি, বাড়ি বা হোটেলের আলোকসাজ থাকলে জোনাকির মিটিমিটি বাতি তো লাগে না। রাতের চীন মুগ্ধ করে।

চাইনিজদের ইংরেজি শেখা :
আগে থেকেই জানা ছিল- চাইনিজরা আন্তর্জাতিক ভাষার ব্যাপারে আগ্রহী নন। ইংরেজি বলতে পারেন না, বুঝতেও পারেন না। তবে পরিবর্তনের খণ্ড খণ্ড চিত্র দেখেছি। আপনি যতই উন্নত আর সমৃদ্ধ হোন না কেন, বিশ্ব সম্প্রদায়ে মাথা তুলতে গেলে আপনাকে ইংরেজি জানতে হবে, বুঝতে হবে। এতকাল পরে চীন সরকার হয়তো বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে। আর সে কারণেই ওরা নতুন প্রজন্মকে ইংরেজির জ্ঞানটুকুও দিতে চাইছে। পাঠ্যকার্যক্রমে ইংরেজির গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে। বেসরকারিভাবেও চাইনিজদের ইংরেজির প্রতি আকর্ষণ বাড়ানো হচ্ছে। স্কুল ছুটির পর শিশু-কিশোরদের নিয়ে ইংরেজি শেখার আসর বসছে। ইংরেজির প্রতি চীনের নতুন প্রজন্মের ভেতরে আগ্রহ বাড়াতে স্লোগান দেওয়া হয়েছে- ল্যাংগুয়েজ ইজ দ্য কি অব কমিউনিকেশন্স।

পার্ল- যেন আমার স্বপ্নের নদী :
আমি তিলোত্তমা ঢাকার পাশ ঘেঁষে ছুটে চলা বুড়িগঙ্গা দেখেছি। দেখেছি লুসাই পাহাড় থেকে ধেয়ে আসা কর্ণফুলী। এবার আমি দেখেছি চীনের পার্ল নদী। পার্ল নদীর ভেতরে অনুভব করেছি আমাদের বুড়িগঙ্গা, আমাদের কর্ণফুলী। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে জন্ম নেওয়া পার্ল নদীর দেহ অনেক বড়- প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার। চীনের তৃতীয় বৃহত্তম নদী এটি। পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম নদীও কিন্তু চীনে। নাম- ইয়াংজি নদী, এ নদীর তীরে সাংহাই শহর। বৈচিত্র্যগত দিক থেকে চীনে নদীর তালিকায় ইয়াংজির পরেই পার্ল।

পার্ল নদী কেন আমাকে আকৃষ্ট করল? চীনের মতো উন্নত দেশে নদী তো বাড়তি সুরভী ছড়াবে- এটাই স্বাভাবিক। না, আমার আগ্রহ অন্যখানে। পার্ল শুধু একটি নদী না। এটি চীনের দুটো শহরের মাঝখানের সেতুবন্ধন। নদীর দুই পারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দেখা মিলল। নদীর পাশ ঘেঁষে রেলিং ধরে এগোচ্ছিলাম, পাশে পড়ে আছে বিশাল ওয়ার্কওয়ে। মানুষের হাঁটার জন্য যে পরিমাণ জায়গাটা রাখা হয়েছে, সেটি আমাদের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মতোই প্রশস্ত!

যদি পার্ল নদীটা সঙ্গে আনা যেত, তবে কত ভালই না হতো। তা কী করে সম্ভব! ওই নদীটার কিছু পরপরই সেতু গড়ে রেখেছে চীন সরকার। জলযান চলাচলে যেন ব্যঘাত না ঘটে, তাই সেতুগুলো বানানো হয়েছে কোন খুঁটি ছাড়াই। সেখানে এগুলোকে বলা হয় ঝুলন্ত সেতু। আমাদের বুড়িগঙ্গাকে ওভাবে গড়ে তুললে ঢাকা দ্বিগুণ হবে, কর্ণফুলী পাবে বাড়তি সৌন্দর্য। যতই কল্পনা করি- বুড়িগঙ্গা কিংবা কর্ণফুলী তো আর পার্ল নদী না!

সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা :
গুয়াংজু সিটি চীনের অন্যতম ব্যস্ত শহর। এটিকে বাণিজ্যিক নগরী বলা হয়। অনেক মানুষ, অনেক গাড়ি। অথচ কোন জট নেই। নেই যানজট, নেই জনজট। এত মানুষের শহরেও শৃঙ্খল ধরে রাখার একটাই কারণ- ওখানে সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। রাস্তাঘাট সবই পরিচ্ছন্ন। একটি কাগজের টুকরো বেশিক্ষণ সড়কে পড়ে থাকে না। টহলরত পরিচ্ছন্নকর্মী সঙ্গে সঙ্গেই সেটি সরিয়ে নেন।

হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় টেক্সিক্যাব। সবগুলোই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। কোথায় যাবেন- সেটি চালককে বলবেন। ঠিকানা জানা না থাকলে যার কাছে যাবেন, তার সঙ্গে চালককে ফোনে ধরিয়ে দেবেন। তাতেই আপনি নিশ্চিন্ত। আপনি বসে থাকবেন। চালক ঠিক জায়গামতো পৌঁছে দেবে। মিটারের বাইরে এক পয়সাও ভাড়ার দরকার নেই। তবে চীনে লোকাল বাসই শ্রেয়। লোকাল বাস শুনে ঢাকা শহরের লক্কড়-ঝক্কড় বাস ভাবলে কার দোষ! ঢাকার রাস্তায় যে নতুন বাসটি গতকাল নামানো হয়েছে, সেটির চাইতেও ওখানকার লোকাল বাসটি অনেক পরিপাটি। সবগুলোই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। যেখানেই যান, ভাড়া ২ আরএমবি। চালকের পাশে থাকা নির্ধারিত বক্সে ভাড়াটা নিজ দায়িত্বে রেখে দিতে হয়। চালকের সহকারি থাকে না। আর যাদের কার্ড আছে, তারা ওঠার সময় কেবল কার্ডটা পাঞ্চ করলেই হলো। বাসের ভেতরে-বাইরে একাধিক সিসি ক্যামেরা।

চীনের প্রতিটি সড়কেই আছে বিদ্যুৎ চালিত বাস। বাংলাদেশের বৈদ্যুতিক ব্যাটারিচালিত অটোর কাহিনি মনে করার কিছু নাই। সেখানে সড়ক যতদূর গেছে, ওপর দিয়ে বৈদ্যুতিক তারও ঝুলানো আছে। আর বিদ্যুৎচালিত বাসগুলো ছাদের ওপরে ছোট আকৃতির ক্রেন বসিয়ে ওই তারের সঙ্গে সংযোগ দিয়েছে। সারাক্ষণ বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকে বলে বাস চলতে একটু বেগ পেতে হয় না।

মহানবীর (সা.) সাহাবীর মাজার :

আমরা যে হোটেলে উঠেছি, সেখান থেকে পায়ে হাঁটা ১০ মিনিটের দূরত্বে এক বিখ্যাত মানুষের মাজার। তিনি হলেন সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (র.)। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অন্যতম প্রধান সাহাবী ছিলেন তিনি। জানা গেল, ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারীদের মধ্যে ১৭তম ব্যক্তি ছিলেন আবি ওয়াক্কাস (র.)। মাজার ঘিরে চারপাশের প্রকৃতি সাজানো গোছানো। মনে হয় মনের মতো করে সাজানো সবকিছু। অনেক বড় আয়তনের কিছুটা উঁচু জায়গাজুড়ে সংরক্ষিত এ মাজার। আছে বড় ধরনের মসজিদসহ সংশ্লিষ্টদের থাকার জন্য আবাসনও। এ ছাড়া কয়েকটি আলাদা আলাদা স্থাপনাও চোখে পড়ল।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চীন সফররত মুসলমান নারী-পুরুষ ওই মাজারে যান। শুক্রবার অনেক মানুষের সমাগম ঘটে। আমিও গেলাম সেই শুক্রবারেই। ওখানে মহানবীর (সা.) এই সাহাবীর মাজার জিয়ারত, দোয়া তো আছেই; এর বাইরেও একটি বিষয় লক্ষণীয়- মাজারের পানি পান। ঠিক যেই কবরটায় শুয়ে আছেন সাহাবী, তার খুব কাছেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় উত্তোলন করা হয় পানি। ওই কাজে সর্বদা নিযুক্ত থাকেন দুজন। তারা মাজারে আগতদের মধ্যে পানি বিতরণেই ব্যস্ত থাকেন। ছায়া সুনিবিড় সবুজ-শ্যামল পুরো প্রকৃতিই মায়ামাখা। তবে ওই সময় বৃষ্টির কারণে মাজারের দায়িত্বশীল কারো সাক্ষাত পাইনি। ফলে জানার অনেক কিছুই বাকি রয়ে গেল।

হালাল খাবারের সন্ধানে :
চীনে মোট জনসংখ্যার তুলনায় মুসলমান খুবই কম। তবে সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের চাইতে বেশি হতে পারে। মুসলিম হোটেল খুঁজে বের করা কঠিন, হালাল খাবারের অভাব বড্ড বেশি। বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা বা ভ্রমণে যাওয়া বেশিরভাগ মানুষই জুস, ফল, কোমলপানীয় খেয়ে বাঁচেন। বলে রাখা ভালো- চীনে গেলে বেশি বেশি ফলের জুস খেতে ভুলবেন না। নির্ভেজাল ফলের ম্রো ম্রো গন্ধে মাতোয়ারা হয়েছি। ফরমালিনের জালে আটকে থাকা বাঙালি চীনে গিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।

সামান্য কষ্ট করে মুসলিম হোটেল খুঁজে পাওয়া গেল- আবদুল্লাহ রেস্টুরেন্ট। কয়েক শত তালিকার মেনু ধরে আপনি পছন্দের যে খাবারটিই চাইবেন, পাবেন। সালাদে আলাদা আস্বাদন পেয়েছি। চিকেন ফ্রাইড রাইসের মধ্যেও হরেক রকমের পাওয়া গেল। রঙ-বেরঙের রাইস। তবে এসব সুস্বাদু খাবারের দাম বাংলাদেশের তুলনায় কমই।

কেনাকাটা করতে হবে না? :

চীনে অনেক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশির সন্ধান পেতে পারেন। তাদের সহায়তা নিলে খোঁজ মিলবে রকমারি জিনিষের আসল মার্কেট। একেক পণ্যের জন্য একেক মার্কেট প্রসিদ্ধ। মানে ভালো, দামে কম। বলা হয়ে থাকে, চীনের পণ্য বেশিদিন টেকে না। কথাটা অর্ধেক সত্যি। একটু ব্যাখ্যা দিলে ঘোর কাটবে।

চীনারা যে আইফোন কেনেন ৩০ হাজার টাকায়, সেটি আপনি বাংলাদেশে বিক্রির জন্য যদি ২০ হাজার টাকায় কিনতে চান, তাহলে মানে তো তফাৎ থাকবেই। অর্থ্যাৎ, আপনি চাইলে ওরা ১৫ হাজার টাকার বাজেটেও পরিপাটি একটি আইফোন বানিয়ে দেবে মুহূর্তের মধ্যেই। ঠিক এরকম প্রত্যেক পণ্যের বেলায়। বাংলাদেশের আমদানিকারকেরা পণ্য অর্ডারের সময় বলে দেন, সেটি কোন মানের হবে। এককথায় বলতে গেলে, চীনে একই পণ্য একাধিক মানে তৈরি হয়। যার যার চাহিদামতো। তবে চীনের মানুষ যেসব পণ্য ব্যবহার করে থাকেন, সেগুলো খুবই মানসম্পন্ন।

কিছু কিনতে গেলে গলদঘর্ম হয়ে যেতে হবে বিপণনকর্মীর সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে। সুন্দরী মেয়েরাই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিপণনকর্মী। কিভাবে ক্রেতা টানতে হয়, বোধহয় তারাই ভালো জানে। ওরা ইংরেজি জানে না, সমস্যাটা সেখানেই। বাংলাদেশি পর্যটকদের মধ্যে যারা ইংরেজি জানেনা বা কম জানেন, তাদের ক্ষেত্রে শারীরিক ভাষাই ভরসা। আর টুকটাক ইংরেজি বলতে পারা বা লিখতে পারা পর্যটকদের খুব একটা বেগ পেতে হয় না। বিপণনকর্মীদের আপনি যা বলতে চাইবেন, সেটি ইংরেজি ওদের মোবাইল ফোনে টাইপ করে দেবেন, ওরা চাইনিজ ভাষায় বদলে নিয়ে সেটা বুঝে নেবে। ভাষার আদান-প্রদানের এই প্রক্রিয়াটা বেশ ভালই লেগেছে।

গুয়াংজু সিটির লিয়ন প্লাজা অনেক বড় পরিসরে গড়া। কয়েক হাজার শপিং হাউজ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বলতে গেলে চাহিদার সবই পাওয়া যায় ওখানে। আছে লোটাস-এর মতো বৃহদাকার শপিংমল; যেখানে সবই মেলে। একাধিকবার গিয়েছি লিয়ন প্লাজায়। ঘুরে ঘুরে দেখেশুনে কিনতে পারলে কম টাকায় ভালো মানের পণ্য কিনে লাগেজ ভর্তি করা ব্যাপার না।

ফেরার পালা :

ঘুরতে ফিরতে সাতটা দিন কেটে গেল। ১৫ জুন চীনের স্থানীয় সময় ভোর পাঁচটায় হোটেল ছেড়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে বের হই। টেক্সিক্যাব নিয়েই ছুটছি। যত এগোচ্ছি ততই পেছনে ফেলে আসছি হাজারো স্মৃতি। সাতটা দিনে যেন অনেক আপন হয়ে গেছে চীন। টেক্সি চলছে ১২০ কিলোমিটার গতিতে। ভোরের সড়ক বলে গাড়ি নেহাত কম না। বড় বড় সড়কে অনেক গাড়িও বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। আধঘণ্টায় এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাই। সামগ্রিক প্রক্রিয়া সম্পাদনের পর স্থানীয় সময় ঠিক সোয়া আটটায় 'চায়না সাউদার্ন' উড়াল দিল।

 ক্যাপশন: আকাশ থেকে যেমন দেখা যায় চীনের গুয়াংজু সিটি

নীল-সাদা মেঘ-আকাশ মাড়িয়ে ছুটে চলেছে বিমান। প্রায় দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি পাহাড় ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। আরো ওপরে উঠে গেলে নিচে কেবল মেঘের ওড়াউড়িই দেখতে পাই। পাহাড় থেকে অনুমান করা গেল- তখন আমরা মিয়ানমারের আকাশসীমায়। তিন ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর সোনালী রোদ্দুর আকাশে আমরা। উঁচু-নিচু পথ ধরে এগোতে থাকে বিমানটি। মাঝে মধ্যে জনপদের দেখা মেলে, দেখি শহরের মাথাউঁচু ভবনও। সাড়ে তিন ঘণ্টা পর ঢাকা এয়ারপোর্টে। ঘণ্টাখানেক পর গাড়ির হর্ণ, আর মানুষের শোরগোলে মিশে যাওয়া নাগরিক। সেই চেনা শহর, ব্যস্ত ঢাকা। শেষটা মোটেও ভালো হলো না। কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরত্বের চীন থেকে বিমানে সাড়ে তিন ঘণ্টায় ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছাই। আর মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরত্বের এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফিরতে প্রাইভেটকারে আমাদের লেগে গেল পাক্কা পাঁচ ঘণ্টা!

আফসোসটা দীর্ঘ হয়। ইশ, আমার দেশটা যদি ওদের মতো হতো! আমার আফসোসটা যদি কেটে যেত! সেই যাই হোক। মাতৃভূমি বলে কথা। এ আমার দেশ। কথার ফুলঝুরি আর আড্ডায় মেতে ওঠার দেশ। মন মাতানো অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ার দেশ। আমার বাংলাদেশ।

লেখক : সাংবাদিক

news.joynal@gmail.com