আমিই শিশু পাচারকারী!

জয়নাল আবেদীন
Published : 17 Sept 2015, 03:52 PM
Updated : 17 Sept 2015, 03:52 PM

এক:

ছুটির গল্পে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, তের-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নেই। শোভাও নাই, কোন কাজেও লাগে না…। ফটিক চক্রবর্তীর ভেতরে রবীন্দ্রনাথ এই বয়সী ছেলেদের চরিত্র তুলে ধরেছিলেন। কমলাপুর রেলস্টেশন কিংবা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে এমন হাজারো ফটিক ছড়িয়ে আছে। ঢাকায় দলে দলে ফটিকেরা নেশায় বুঁদ। তারা চুরি করে, নেশা করে। গল্পের ফটিকের চাইতেও ভয়ংকর চরিত্র তাদের।

চৌদ্দ বছরের শাহীন বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে বছরখানেক আগে। নেশাগ্রস্থ 'বাবাকে' একদিন 'গানজুইট্টা' বলেছিল শাহীন, 'বাবার' সেকি বেদম প্রহার। সেদিনই বাড়ি ছাড়ল ছেলেটি। আর ফিরে যায়নি ময়মনসিংহে। যাবে কোথায়? ছোটকালে বাবা নিখোঁজের কিছুদিন পরই শাহীনের মা অন্য একজনকে বিয়ে করেন। মায়ের সেই স্বামীই মাদকাসক্ত। তাই মায়ের প্রতিও প্রচণ্ড ঘৃণা তার। তবে মন কাঁদে ছোট্ট ভাইটির জন্য। ঢাকায় এসে পথশিশুদের সঙ্গে মিশে যায় শাহীন। আস্তে আস্তে বিপথে পা বাড়াতে থাকে। পেটের তাড়নায় ভ্যান ঠেলে, বিড়িও টানে। দুঃখভরা মনে বাড়ি পালানো ছেলেটির জীবন অগোছালোই হয়ে যায়।

ছবি: মজার ইশকুল-এ কয়েকজন শিশুর লেখালেখি চলছে

দুই:
একদিন পড়ন্ত বিকেল। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট পেরিয়ে পশ্চিম পাশের হাতিরপুল লিংক রোড ধরে এগোচ্ছিলাম। ওই সড়কটায় রিক্শা ছাড়া বড় গাড়ি খুব একটা চলে না। একটু এগোতেই চোখ আটকে গেল, সড়ক বিভাজনের দুই পাশে দুই ভাগে শিশুদের কোলাহল।

প্রাইমারির অভিজ্ঞতা কার কার মনে আছে? শ্রেণিকক্ষের ভেতরে সে কি আওয়াজ। ছুটির শেষে সমস্বর কণ্ঠে খুশির বারতা। সবই এখন অতীত। এক চিলতে অতীত ফিরে পেলাম ঢাকার এই নির্জন সড়কে; যেখানে রিক্শার টুনটুন শব্দ ছাড়া আর কোলাহল থাকে না। একদল শিশু পড়ছে আওয়াজ করে। খোলা আকাশের নিচে। তাদের আওয়াজ হাওয়ায় মিশে যায়। কালো ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে। আছেন দুজন শিক্ষক। একজন ছেলে, অন্যজন মেয়ে। চলন্ত রিকশায় এর চাইতে বেশি জানার সুযোগ হয়নি।

 ছবি: এদের বেশিরভাগই নিজেদের পরিচয় জানে না। ছিল পথশিশু। এখন স্বপ্ন দেখে নতুন জীবন গড়ার

বহুদিন পর খবর নিয়ে জানতে পারি, শাহবাগে খোলা আকাশের নিচে সেদিন শিশুদের যে পাঠশালা দেখেছিলাম, সেটির নাম_ 'মজার ইশকুল'। কেন এটির নাম মজার ইশকুল হলো? কারণ, এখানে শুধু গৎবাধা পড়াশোনাই হয় না, হয় আরো অনেক কিছু। বাচ্চারা অ আ ক খ শেখে। এ বি সি শেখে। নামতা পড়ে। বাংলা পড়ে, ইংরেজি পড়ে। ইংরেজি শব্দের অর্থ শেখে।

এর বাইরে বাচ্চারা পড়ে জাফর ইকবালের 'আমি তপু'! পড়ে জীবনকে জানার-বোঝার আরো হরেক রকমের মজার মজার বই। বাচ্চারা মাঝে মাঝে চিড়িয়াখানায় যায়। হাতি দেখে, বাঘ দেখে, হরিণ দেখে। কোয়েল, ময়না, পেঙ্গুইন দেখে। বানর, সজারু, ময়ূর, উটপাখি, সাপ আরো কত কি।

'আমি তপু' কেন পড়ে? লেখক জাফর ইকবালের তপু মানেই একজন পথশিশু। যে শিশুটি মায়ের অবহেলায় বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসে। কমলাপুরের পথশিশুদের দলে যোগ দিয়ে পা বাড়ায় বিপথে। পরে এক বন্ধুর হাত ধরে আবার ফিরে আসে আলোর নিচে। বিস্ময়কর তথ্য হলো_ 'মজার ইশকুল'-এর সবগুলো শিশুই একেকজন তপু। আর, এই তপুরাই এখন একই আলোর নিচে।

ছবি: পথশিশুদের স্বপ্ন দেখালেন যারা- আরিয়ান ও জাকিয়া

এই আলোর মশাল জ্বালিয়েছিলেন কিছু স্বপ্নবাজ তারুণ্য। ঐতিহাসিক একটি দিবস ১০ জানুয়ারি; ২০১৩ সালের সেই দিনটি থেকে যাত্রা মজার ইশকুল-এর। কয়েকজন তরুণ-তরুণীর অদম্য ইচ্ছার প্রতিফল এটি। তাঁদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে মজার ইশকুল। পায় সরকারি নিবন্ধনও। স্বপ্নবাজ তারুণ্যের নেতৃত্বে আছেন দুজন- আরিয়ান ও জাকিয়া।

তাঁদের মিশন হলো- 'প্রশিক্ষিত শিক্ষিত মানুষ, রাস্তা থেকে যাকে আমরা বাসার আলো পর্যন্ত পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর'। কেবলমাত্র শিক্ষা না, তাঁরা নিশ্চিত করেছে পথশিশুদের খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপদ বাসস্থান, এমনকি প্রযুক্তিও। পথশিশুদের অন্ধকার পৃথিবীকে আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিতে তাদের আরো নানা প্রচেষ্টা। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, শাহবাগের উদ্যান, আগারগাঁও বস্তি এবং রামপুরায়- এই পাঁচটি স্থানে চলে মজার ইশকুলের কার্যক্রম।

ছবি: পাঠদান শুরুর আগে শিশুদের নিয়মিত শপথ গ্রহণের অংশ

স্বপ্নবাজ তারুণ্যের উদ্দেশ্য হলো- বন্ধু হয়ে পথশিশুদের পাশে থাকা, তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা এবং সুস্থ জীবন উপহার দেওয়া। পরম মমতায় তাদের গড়ে তোলা, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করা। পরিচয় সন্ধান করে অবস্থা অনুযায়ী শিশুগুলোকে ঘরে ফিরিয়ে দেওয়া। আর, যে শিশুদের পরিচয় জানা নেই, ঘরে ফেরার পরিস্থিতি নেই, তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়া। এ সবই করছেন এই তরুণ-তরুণীরা। তারা গড়ে তুলেছেন বায়ান্ন শেল্টার হোম; যেখানে পরম মমতায় বেড়ে উঠবে পথশিশুরা। তাদের আছে অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন; সবগুলো সামাজিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় যে সংগঠনের আওতায়।

তিন,

ময়মনসিংহের শাহীন আর বাড়ি ফেরেনি। ফিরবেও না। কারণ, সে পেয়ে গেছে মজার ইশকুল। সে বড় হতে চায়। পড়ালেখা শিখে ভাল কাজ করতে চায়। শাহীনও এখন স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। তার স্বপ্ন- সে যদি কোনদিন সত্যিই বড় হতে পারে, তাহলে কাজ করবে পথশিশুদের জন্য। কাউকে যেন তার মতো পথশিশু হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে না হয়। আরিয়ান আর জাকিয়াদের মমতায় এই শাহীন এখন জীবনের সঠিক রাস্তায়।

শুধু শাহীন নয়, জাফর ইকবালের গল্পের সব তপুরাই এখন সঠিক রাস্তায় হাঁটছে মজার ইশকুলের আলোর পরশে। আরিয়ান-জাকিয়ার নেতৃত্বগুণে অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন এখন ৪০০ সদসের বড় পরিবার। আর, সরাসরি পথশিশুদের জন্য সময় দিচ্ছেন ২০০ জন। মজার ইশকুল কাজ করছে হাজারো পথশিশুকে নিয়ে। শিশুগুলোর সেবা-যত্নেরও কমতি নেই। ওই অদম্য তরুণেরাই তাদের হাত-পায়ের নখ কেটে দেয়। তাদের গোসল করিয়ে দেয়। অনেককে খাইয়ে দেয়। স্কুল শেষে কলা-পাউরুটি তো আছেই।

মধু মাসে আকাশে বাতাসে ফলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এমন দিনে আম, জাম, লিচু, কাঁঠালের ঘ্রাণে ভরে ওঠে ঘর থেকে ঘর। কিন্তু পথশিশুরা কেবল গন্ধ শুঁকেই তৃপ্ত হয়। নতুবা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া ফলের উচ্ছ্বিষ্ট অংশেই তাদের মধু মাস কাটে। বিচিত্র উদ্যোগ মজার ইশকুল-এর। তারা গত বছরের মধু মাসে উদযাপন করেছে 'মজার ইশকুল : ফল উৎসব'। ওই উৎসবে মুখ রাঙিয়েছিল ৯০০ পথশিশু।


ছবি: গত বছর ৩৬৫ শিশুকে ভালো হোটেলে পোলাও মাংস খাইয়েছিল মজার ইশকুল

রেস্টুরেন্টে মজার মজার খাবার তৈরি হয়। সে খাবার খেয়ে সাহেবেরা বের হতে গেলে হাত পাতে পথশিশু। সেখানেও তারা তুচ্ছ। হোটেলের খাবারের গন্ধ শুঁকেই ফ্যালফ্যাল চোখে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে পথশিশুরা। মজার ইশকুল গত বছর আয়োজন করে পোলাও উৎসব। রাজধানীর ৩৬৫ জন পথশিশুকে বড় হোটেলের চেয়ারে বসিয়ে পোলাও মাংসে ভুরিভোজ করিয়েছে মজার ইশকুল। হোটেলে এই পথশিশুরা পেয়েছে অভুতপূর্ব আতিথেয়তা।

হাড়কাঁপা শীতে পথশিশুরা পায় গরম কাপড়। ঈদের মতো বড় উৎসবে পায় নতুন জামা। মজার ইশকুল শুধুমাত্র একটি পাঠশালা নয়, পথশিশুদের পরম বন্ধু। অতি আপন ঠিকানা। এই ঠিকানার ছায়াতলে গেলে পথশিশু আর ঠিকানাহীন থাকে না। আরিয়ান-জাকিয়াদের মমতায় এই শিশুরা ভুলে যায় বহুদিনের অতৃপ্ত মাতৃস্নেহে। ফটিক-তপুরা মনের কোনে বাঁধে নতুন নতুন স্বপ্ন। মজার ইশকুল যেন দিনে দিনে ক্ষয়িষ্ণু মানবতাকে জাগিয়ে তোলার অনন্য প্রতীক।

শেষ,
পথশিশুদের অন্ধকার জীবন থেকে ফেরানোর অদম্য কাণ্ডারি আরিয়ান-জাকিয়া এখন নিজেরাই অন্ধকার কারাগারে! তাদের সঙ্গী আরো দুজন। দুদিনের রিমান্ড শেষে তারা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সবকিছু যেন নিমিষেই ধুলোয় মিশে গেল!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পের কিশোর ফটিক থেকে আরিয়ান-জাকিয়াদের মজার ইশকুল- একেকটি অনুচ্ছেদ শুধুই গল্প নয়, বাস্তব। প্রতিটি অনুচ্ছেদের বাঁকে বাঁকে মানবতার জয়গান আছে। আছে দেশপ্রেমের চেতনা। অথচ জাগ্রত মানবতার সেই কারিগরদের নেওয়া হলো রিমান্ডে!

১০ শিশুকে নিয়ে 'বায়ান্ন শেল্টার হোম' খুলেছিল অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন। অনেক বড় স্বপ্ন ছিল। একদিন এই শেল্টার হোমই হবে দেশের সব বঞ্চিত পথশিশুদের আপন ঘর। স্বপ্নের সেই ঘরে আজ কেবলই বিষাদ। ঘরের কাণ্ডারি নেই বলে।

ওই ঘরের এক শিশুর চাচা মনির হোসেনের মামলার ওপর ভর করে গত শনিবার পুলিশ গ্রেপ্তার করে আরিয়ান, জাকিয়াসহ চারজনকে। শিশু পাচারকারী তকমা লাগানো হয় তাদের কপালে! আদালত দেয় দুইদিনের রিমান্ড! দেশজুড়ে হইচই। প্রতিবাদ, ক্ষোভ, মানবন্ধন। এখন আরিয়ান-জাকিয়াদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দাবি উঠছে- আমি আরিয়ান, আমি জাকিয়া, আমিই শিশু পাচারকারী!

ওই ১০ শিশুর নয়জনকে শেল্টার হোম থেকে নিয়ে তুলে নেওয়া হয় টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে। বাকি একজনকে পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া হয়, ওই শিশুর চাচাই মামলার আসামি। জানি না, মানবতার এই দুর্গম-কণ্টক-অদম্য যাত্রায় কেন তিনি কুড়াল মারলেন! তবে তিনি এখন অনুতপ্ত। মনির বলেছেন, "আমার মনে হয়েছিল, ওরা শিশু পাচারকারী। এখন আমার ভুল ভেঙেছে। পুলিশের তদন্তে আমার অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণ হলে মামলা চালানোর ইচ্ছে নেই।"

এই আজব দেশে প্রতি মিনিটেই কত রকমের অভিযোগ ওঠে। হাজার হাজার জিডি, শত শত মামলা। থানায় থানায় মামলার স্তুপ। কোন এক মনিরের মামলাটি পুলিশের কাছে এতটা দ্রুত গুরুত্ব পেয়েছে বলে আমি পুলিশি-কাণ্ডে চরম আশাবাদি। তবে এ ক্ষেত্রে পুলিশের অতি-উৎসাহী তৎপরতা প্রশ্নবিদ্ধ। এই স্বপ্নবাজদের গ্রেপ্তারের আগে বিষয়টির ন্যূনতম তদন্ত করার পথে কেন গেল না পুলিশ? কেন তদন্ত না করেই ওদের শিশু পাচারকারী তকমা দেওয়া হলো? কেন গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হলো?

ছবি: কয়েকজন পথশিশুর সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলেন মজার ইশকুল-এর উদ্যোক্তা আরিয়ান (ফাইল ছবি)

টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ওই শিশুগুলো ভালো নেই। তারা বলছে- আমাদের ফিরিয়ে দাও সেই রঙিন দিনগুলি। আমরা যেতে চাই আমাদের ঠিকানায়। যেখানে আরিয়ান-জাকিয়া নামের স্বপ্নবাজেরা থাকে। থাকে মানবতা, জীবনের সঠিক রাস্তা।

জানি না, এই শিশুগুলো আদৌ তাদের আপনঘরে ফিরতে পারবে কি না। আরিয়ান-জাকিয়ারা মুক্তি পেলেও স্বপ্নচ্যূত হয়ে পড়বে কি না। স্বপ্নভঙ্গের হতাশা তাদের ঘিরে ধরবে কি না। জানি না। যদি সবকিছু এলোমেলো হয়ে পড়ে, যদি মজার ইশকুল থেমে যায়, যদি পথশিশুদের স্বপ্ন সত্যিই ভেঙে যায়- তবে এই দায় কার? আমিও আজ আরিফ আর হোসেনের কণ্ঠে সংহতি জানাতে চাই- কিছু ছেলে এই অদ্ভুত দেশে, মজার ইশকুলের স্বপ্ন দেখে!

ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৫
লেখক : সাংবাদিক, news.joynal@gmail.com