হার না মানা লিপির জীবনের নিষ্ঠুর গল্প

জয়নাল আবেদীন
Published : 21 July 2016, 04:53 AM
Updated : 21 July 2016, 04:53 AM

বয়স তখন মাত্র ১২ বছর। গ্রাম ছেড়ে চট্টগ্রাম নগরীতে পাড়ি জমান লিপি আক্তার। সঙ্গে নেন জনমদুঃখিনী মাকে। বাবার মুখ দেখেননি। একমাত্র ভাইও বেঁচে রইলেন না। লিপিই তখন মায়ের অন্ধের যষ্ঠি। মাত্র ৮০০ টাকা বেতনে লেগে যান একটি পোশাক কারখানার কাজে।

১৯ বছর পর। শৈশব, কৈশর, তারুণ্য পেরিয়ে আসা লিপি যৌবনেও ঘর বাঁধেননি। একমাত্র মায়ের কথা ভেবেই বিসর্জন দিয়েছেন নিজের সমস্ত সুখস্বপ্ন। ১২ হাজার টাকা বেতনে মাকে নিয়ে বেশ সুখেই কাটছিলো একেকটি দিনরাত্রি। টানা দুইবছর অতিরিক্ত কাজ (ওভারটাইম) করে জমানো টাকায় মায়ের নামে কেনেন একখণ্ড জমি। স্বপ্ন ছিলো, আরো একটি বছর টানা পরিশ্রমের পরে মাকে একটি ঘর বেঁধে দেবেন; যিনি কি-না কখনই নিজের বলতে কোনো ঘর পাননি।

তারপর একদিন সব স্বপ্ন উড়ে যায়। লিপির শরীরে বাসা বাঁধে মরণব্যাধি ক্যান্সার। কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসা করার মতো অর্থ তাঁর নেই। দিনদিন মৃত্যুর দিকেই এগোতে থাকে একটি অদম্য সংগ্রামী জীবন। সেই অবস্থায় লিপি আক্তারের জীবনালেখ্য তুলে ধরি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এবং বিডিনিউজের ব্লগে। সাড়া জাগে দেশ-বিদেশে। এগিয়ে আসেন মানবতার কাণ্ডারিরা।

লিপির মায়ের নাম রোজিয়া বেগম। তিনি যখন মাত্র তিন মাসের নবজাতক, এক দুর্ঘটনায় হারিয়ে ফেলেন বাবা-মাকে। এরপর নানির কোলেই মানুষ হন। অনেক চড়াই উতরাই জীবন নিয়ে টিকে থাকেন তিনি। বিয়ে হয় মিরসরাই পৌরসদরের বাসিন্দা কবির আহমেদের সঙ্গে। প্রথমে তাদের ঘরে আসে একটি ছেলে সন্তান। কয়েক বছর পর রোজিয়া যখন দ্বিতীয়বার সন্তানসম্ভবা, তখনই অসুখে ভুগে মারা যান কবির।

ছেলে আর অনাগত সন্তানকে নিয়ে চরম কষ্টে দিন কাটতে থাকে রোজিয়ার। তারপর একদিন পৃথিবীর মুখ দেখে তাঁর অনাগত সন্তান। সেই নবজাতকই আজকের লিপি আক্তার। কয়েকবছর পর রোজিয়ার একমাত্র ছেলেরও জীবনপ্রদীপ নিভে যায়।

মায়ের জীবনের পরতে পরতে লেগে থাকা কষ্টের ক্ষত বেশ কাঁদায় মেয়েটিকে। সে কারণেই মাকে এক চিলতে সুখ এনে দিতে প্রাণান্ত চেষ্টা ছিলো জীবনভর। কিন্তু জীবনের ছন্দপতনে তিনি চরমভাবে পরাজিত হতে থাকেন মরণব্যাধির কাছে।
লিপি আক্তার এবং তাঁর মায়ের জীবনের নাটকীয় নিষ্ঠুর গল্পগুলো সমাজের মানবতাবোধ বিবেকে ঝড় তোলে। মাঠপর্যায়ে নেমে পড়ে একদল তরুণ-তরুণী। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার এবং পথেঘাটে প্রচারণা চালিয়ে জোগাড় করতে থাকে লিপির চিকিৎসার অর্থ।

গত ২১ মে চিকিৎসার জন্য লিপিকে নিয়ে ভারতে পাড়ি দিই। এরপর চিকিৎসার নানা ধাপ পেরিয়ে গত ২৭ জুন ভারতের ভেলোরে অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসালয় সিএমসি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয় লিপির। জটিল অনিশ্চয়তা পেরিয়ে গতকাল সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, লিপি এখন ক্যান্সারমুক্ত। তাঁর বায়োপসি রিপোর্টে আর কোনো ক্যান্সারের জীবানুর অবস্থান পাওয়া যায়নি।

লিপির চিকিৎসায় নিযুক্ত চিকিৎসক দলের নেতৃত্বে থাকা ডা. ঝিঁ ঝিঁ ভারগিস জানান, ভবিষ্যতে লিপি যেন আর কোনো ক্যান্সারে আক্রান্ত না হন, এর জন্য কমপক্ষে আটটি কেমোথেরাপি দিতে হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেনেছ, এ ক্ষেত্রে কমপক্ষে চার লাখ টাকা ব্যয় হবে।

ইতোমধ্যে তার চিকিৎসায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ টাকা এসেছে বিভিন্ন স্তরের মানুষের অনুদান থেকে। লিপিকে বাঁচাতে দেশে বিদেশে অনেকেই শ্রম দিয়েছেন। মানুষের সহানুভূতির কারণেই তাঁর চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে।

আমরা লিপিকে নতুন জীবন দিতে চেয়েছি। নিঃসন্দেহে আমরা লক্ষ্য পূরণের পথে। কিন্তু মধ্যবর্তী সময়ে এসে হাল ছেড়ে দিলে লিপি আবারও জীবনের অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবেন। কেমোথেরাপির জন্য যে চার লাখ টাকা দরকার, সেটিই এখন বড় সংকট।

অদম্য সংগ্রামী লিপি আক্তার এখনও স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেননি। তিনি চান সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে কাজে ফিরবেন। মায়ের জন্য কেনা জমিতে একটি ঘর বানাবেন। লিপিই মায়ের একমাত্র সম্বল। লিপিদের মা-মেয়ের জীবনের নিষ্ঠুর নিয়তি যেন গল্পকেও হার মানায়।

তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে চার লাখ টাকার সংকট রয়েছে। এ জন্য সহৃদয়বান মানুষের সহানুভূতি চেয়েছেন তারা। তাঁর পাশে দাঁড়াতে যে কোনো অংকের অনুদান পাঠাতে ০১৯১৩৪২১৭৩৯ এবং ০১৬৮২৭৬২০৪৪ নাম্বারে বিকাশ করতে পারেন।

ক্যান্সার জয় করেছেন অদম্য সংগ্রামী বোন লিপি আক্তার। বাকি রইলো আটটি কেমোথেরাপি। এর জন্য দরকার আর মাত্র ৪ লাখ টাকা। আগের মতো এবারও এগিয়ে আসুন মানবতার কাণ্ডারি ভাই-বোনেরা। আপনাদের সহানুভূতিতেই লিপি পাবে নতুন করে বাঁচার দিশা।

লেখক : সাংবাদিক, ০১৯১৩৪২১৭৩৯

লিপির চিকিৎসার নিয়মিত আপডেট পেতে লেখকের ফেসবুক আইডিতে দেখতে ক্লিক করুন Joinal Abedin

এ সংক্রান্ত আরো লেখা :