প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চলে আসা দীর্ঘকালীন নিপীড়নের ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে লেখা আরাকান থেকে বাংলাদেশ উপন্যাসের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে অমর একুশে গ্রন্থমেলার মঞ্চে এক আনন্দঘন পরিবেশে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন দৈনিক সমকালের নির্বাহী সম্পাদক বিশিষ্ট কবি মুস্তাফিজ শফি। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবি ও সাংবাদিক কাজী রফিক, দৈনিক কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার হায়দার আলী, কবি মাহমুদ নজরুল প্রমুখ।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সাংবাদিক মুস্তাফিজ শফি উপন্যাসের লেখক জয়নাল আবেদীনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, 'আমি জয়নালকে একজন সাংবাদিক হিসেবে চিনি। সে একজন মৃত্তিকালগ্ন সাংবাদিক। আমি বিশ্বাস করি, তার এই বইটিতেও সেই মৃত্তিকালগ্ন সাংবাদিকতার ছোঁয়া পাব।' আরাকান থেকে বাংলাদেশ উপন্যাসের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করেন তিনি।
সাংবাদিক হায়দার আলী বলেন, নাফ নদীর দুই পারে রোহিঙ্গাদের যে নির্মম অবস্থা, এই উপন্যাসে সেটি উঠে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ সরেজমিনে গিয়ে লেখকের করা খবরগুলো হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল। এই উপন্যাসেও লেখক তার পাণ্ডিত্য তুলে ধরতে পেরেছে নিশ্চয়ই।
আরাকান থেকে বাংলাদেশ উপন্যাস এবং লেখকের সাফল্য কামনা করে তিনি বলেন, 'একদিন জয়নাল আবেদীন তার সাংবাদিকতার প্রতিভাকে ছাড়িয়ে যাবে। দেশের অন্যতম একজন উপন্যাসিক হয়ে উঠবে।'
অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কবি মাহমুদ নজরুল বলেন, 'আরাকান থেকে বাংলাদেশ বইটির মোড়ক উন্মোচন করতে গিয়ে ভাবলাম বইটি সম্ভবত ভ্রমণ কাহিনী হবে। কিন্তু লেখকের বক্তব্যে ভুল ভাঙলো। নামের সাথে উপন্যাস হিসাবে মিলাতে পারলাম না। কিছুটা পড়ে বুঝলাম সম্পূর্ণ বাস্তবতার ছোঁয়ায় জীবন থেকে নেয়া উপন্যাস। ভালো লাগার মোহে মোহিত করবে প্রতিটি পাঠককে। নিঃশ্বাসের আগে নিঃশ্বেষ করে ফেলার তাড়না জাগাবে পাঠককে।'
নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সাংবাদিক জয়নাল আবেদীন বলেন, '১০৪ পৃষ্ঠার উপন্যাসে রোহিঙ্গা সংকটের চুম্বকাংশ উঠে এসেছে। মূলত নির্দিষ্ট কোনো পরিসীমায় তাদের জীবনাখ্যান তুলে ধরা সম্ভব না। কারণ, নাফ নদীর দুই পারে অর্থ্যাৎ কক্সবাজার এবং আরাকানে রোহিঙ্গাদের জীবনের যে গল্পগুলো জীবন্ত, সেগুলো হৃদয়স্পর্শী। মনযোগী পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পারে আরাকান থেকে বাংলাদেশ।'
যে কারণে রোহিঙ্গাদের নিয়ে উপন্যাস:
গত বছরের শেষদিকে যখন নাফ নদীতে আরাকানের রোহিঙ্গারা ভাসছিলেন, তখন মনে হয়েছিল ওদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। কারণ, বাংলাদেশে আগে থেকে অবস্থানরত এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশেও বাংলাদেশি পরিচয়ে রোহিঙ্গাদের অপরাধ কর্মকাণ্ডের নজির রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর দেশে-বিদেশে নানা রকম প্রতিক্রিয়া থাকাটা প্রাসঙ্গিক ছিল। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করার পক্ষে আমিও ছিলাম।
কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর আমার পুরোনো প্রতিক্রিয়া উল্টে গেল। বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে অনুপ্রবেশে সফল হওয়া রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে যখন শুনতে পাই একের পর এক হৃদয়স্পর্শী গল্প, তখন পুরোনো ক্ষোভটা পরিণত হল সমবেদনায়।
সমাজ এবং মানুষের প্রতি একজন সাংবাদিকের দায়বোধ থাকে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর সাম্প্রতিককালে চলা নিপীড়ন, নৃশংসতা তাদের প্রতি আমাকে আরও বেশি দায়বদ্ধ করে ফেলে। খবর লিখতে গিয়ে নিয়মের বাইরে যেতে পারিনি। নানা রকম সীমাবদ্ধতার ভেতর থেকেই লিখতে হয়। ইচ্ছে থাকলেও সেখানে নিজস্ব অনুভূতি নিজস্ব প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হয় না। উপন্যাস সেদিক থেকে একেবারেই ভিন্ন কিছু।
আমার কাছে এটি আরও বেশি ভিন্ন। কারণ, এটি আমার প্রথম উপন্যাস। সাংবাদিকতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে একটি উপন্যাস লেখা আমার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তবুও সেইসব রোহিঙ্গাদের নিষ্ঠুর জীবনাখ্যান এক মলাটে তুলে ধরার প্রতি আমি ছিলাম দৃঢ়প্রত্যয়ী। দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর চলে আসা ঘটনাবলীর আলোকে বিচ্ছিন্ন সত্য ঘটনাগুলোকে একটি প্লাটফর্মে রাখার কাজটি অবশেষে সফল হয়।
কঠিন চ্যালেঞ্জের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে মনে হচ্ছে উপন্যাসের প্রেমেই পড়ে গেলাম। এখন থেকে শুধু খবর নয়, আরও বেশি বেশি উপন্যাস লেখার আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠল। খুবই তড়িৎ গতিতে লেখাটি শেষ করার পরে যখন বুঝলাম উপন্যাস দাঁড়িয়ে গেল, তখন আবেগাপ্লুত হয়েই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে লিখেছিলাম- আমার কিছু রাত্রির কষ্ট বেচবো, কিনবেন?
শারীরিক অবস্থান ঢাকার চার দেয়ালে হলেও, সেই কয়েকটি রাত আমি যেন পড়েছিলাম নাফ নদের তীরে। যেখানে ভোর না হতেই সৃষ্টি হতে থাকে একেকটি করুণ গল্প। আরাকান থেকে বাংলাদেশ উপন্যাসটি হয়তো ১০৪ পৃষ্ঠার মধ্যেই আটকে থাকবে। কিন্তু দিনে দিনে দীর্ঘায়িত হতে থাকবে রোহিঙ্গাদের বাস্তবের জীবন।
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বলাকা প্রকাশের ৪৫৩ নাম্বার স্টলে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।