জীবনে উন্নতি বনাম আমাদের মানসিকতা প্রসঙ্গে

সজীব জমশের আলি
Published : 18 August 2017, 07:16 PM
Updated : 18 August 2017, 07:16 PM

আমরা উপদেশ দিতে পছন্দ করি, মানতে না। আমার সামনে সেদিন কেউ একজন এমন একটা মন্তব্য করায় বিষয়টা আমাকে ভাবাল। বুঝলাম এর সত্যতা আছে। আর আমরা এই যে জীবনে উন্নতি করতে পারছি না এর পিছনেও এই "উপদেশ দেয়া, না মানা" এর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। উল্লেখ্য যে, কিছু টাকা পয়সা কামিয়ে তা দিয়ে আয়েশি দিন কাটানো জীবনের সত্যিকার উন্নতি কখনোই নয়।


আমার মনে আছে বাল্যবেলায় বিদ্যালয়ে পাঠানোর সময় আমাকে দাদু অনেক ভাল করে বলে দিতেন যে, "ভাই, মুন দিয়া পড়বা, মানুষের ন্যাগাল মানুষ অন্যাগবো।" আমি বিদ্যালয়ের প্রতি খানিক অনাগ্রহী ছিলাম। ঐ জগতটার প্রতি আমার কোন আগ্রহ ছিল না, বরং বিতৃষ্ণা ছিল। কেন ছিল তার ব্যাখ্যা হয়তো আধুনিক সাইকোলজি দিতে পারবে কিন্তু আপাতত আমাদের কাছে সেটা প্রয়োজনহীন। সেই অনাগ্রহের কারণেই গুরু জনরা আমাকে মানুষ হওয়ার মাহাত্য বেশি করে বুঝাতো। অজস্র নীতিকথার ক্রমাগত আঘাতে আমি অতিষ্ট হয়ে উঠতাম। তখন সেসব কথার মানে না বুঝতে পারাই স্বভাবিক ছিল। আস্তে আস্তে বড় হতে হতে লক্ষ করলাম সেই নীতিকথা এখন আর কেউ বলে না। এখন নতুন ইঙ্গিত চলে। বুঝতাম পরিবারের লোকজন যাদের অপছন্দ করে তাদেরকে আমারও অপছন্দ করতে হবে কারণ না থাকলেও। কখনো হত কি, যে আত্বীয়দের সাথে আমাদের বাড়ির লোকজনের মনমালিন্য আছে কোন কারণে তাদের বাড়ি ভুলে চলে গেলে উনারা জিজ্ঞেস করতেন "তোরে কি আমগো বাইত আইতে না করছে?" আমি প্রবল মাথা নেড়ে বলতাম "নাহ"!

কথা সত্যি ছিল, কেউ আমাকে যেতে বারণ করেনি মুখে, কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে ও বাড়ি যাসনে। ভিখিরি আসলে চাল একমুঠোর একটুও বেশি দেয়া যাবে না। গোলার ধান গোলায় থাকুক ভিখিরির থলিতে কেন ঢেলে দিতে যেতে হবে? আমার কাছে খুব অসহায় মনে হত "কাউকে হিংসা করো না, গরীবকে সাহায্য করো" এসব নীতিবাক্য গুলোকে। এতদিন বইপুস্তকে যা ছিল জীবনের বাস্তবতায় সবি উল্টো। উল্টোগুলো আমরা মুখে বলতে যাই না, মুখে তোতাপাখির মত বইপুস্তকের সংরক্ষিত নীতিকথাই থাকে, শুধু মাত্র প্রয়োগে এসে বদলে যায়। আমরা এমন করি আমাদের সাথে হয়ও এমন। রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গরা ইলেকশনের আগে তাদের বক্ততায় এমন সব প্রতিশ্রুতি দেয় যা তারা জীবনেও রক্ষা করবে না।

আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। খেয়ে পড়ে আমাদের ভালই চলে যায়। কখনো কখনো অভাব আসে, ঋণ হয়; আবার তা দূরও হয়। এখন কেউ বলে অভাবে স্বভাব নষ্ট হতে পারে, তবে তার কথাটা ফেলে দেয়া যাবে না কিন্তু এই নষ্ট স্বভাবের দায়টা সবসময় তার নিজস্ব। কারো নষ্ট স্বভাব তার অভাব থাকতে কারো ক্ষতি করে না। অভাব ফুরানোর পরও যখন তা থেকে যায় তখন সেটা ক্ষতিকর। আমাদের ক্যাটাগরি থেকে যারা অর্থনৈতিক ভাবে ভাল করেছে তারা পরবর্তিতে আরও চরম পর্যায়ের কৃপণ হয়েছে। এগুলোকে আমি ব্যাক্তিগত ও সামাজিক অবক্ষয়ই বলবো। চোখ মেলে তাকালে হাজার ভুলের মাঝেও সঠিকটাকে চেনা যায়। বস্তুত আমরা কাজ করার আগে বিবেকের পরামর্শ নেই না, মানসিকতার উস্কানিতে প্রাণিত হই।

মনে পড়ে, একবার এক বিত্তবানের বাসায় যেতে হয়েছিল। আমার কোন স্বার্থে নয়, তার কাজের জন্যেই অনেক অনুরোধ করায় গিয়েছিলাম মানবিকতা রক্ষার্থে। সেখানে অসামান্য যে আপ্যায়ন হল আমি শুধু ভাবলাম মানুষ এত নিচে কী করে নামতে পারে। কারো সামনে কয়েক সপ্তাহ আগের কেটে রাখা শুকিয়ে উঠা আপেল কি করে পরিবেশন করা সম্ভব? গরিব মানুষেরা খাবার কুড়িয়ে তুলে খায় খাবারের সম্মানে, আর এই ভদ্র পরিবার গুলো কাউকে পরিবেশন করা খাবারের বেচে যাওয়া অংশ যত্নে তুলে দিনের পর দিন ফ্রিজে রেখে দেয় অন্য কারো সৎকার করা যাবে সেটা চিন্তা করে। আমি হলফ করে বলতে পারি আমাদের স্পর্শ না করা সে সব অখাদ্য ফলমুল আবার ফ্রিজে তুলে রাখা হয়েছে। সবচে আশ্চর্যের কথা এই পরিবারের কর্তা একজন শিক্ষক। তার পরিবারের অবস্থাও এতটা শোচনীয়।

এটা হল ফিলহাল আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি। যথেষ্ট উন্নতই বলতে হবে। যতবড় মহা মানবই আসুক বাঙালিকে সোজা করতে পারবে না। তারা বরং ধর্মটাকেই আস্তাকুড় বানিয়ে ফেলবে। ব্যাপারটা ঠাট্টা নয় এটাই বাস্তব।

আমি বিশ্বাস করি অন্ধকার ক্ষনস্থায়ী। আলোর দিশা পৃথিবীকে কেউ না কেউ দিবেই। আমাদের দায়িত্ব হল সেই আলোকে বাঁচিয়ে রাখা। অন্ধকার আসতে না দেয়া। জীবনটা যে সুন্দর করা উচিত সেই বোধ জাগিয়ে তোলা। স্যার আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ কোন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন জীবনে জয় চেয়ো না, আনন্দ চেয়ো। আনন্দটা বুঝতে শেখাই জীবনের সবচে বড় সার্থকতা।
একটা বিপ্লব আসুক। জীবন নতুন করে সজ্ঞায়িত হোক। সেখানে সোন্দর্য আবার প্রতিষ্ঠিত হোক এই ভাবনায় চলুন বদলাই, জীবনে উন্নতি করি।