আত্মহত্যা, না পরিকল্পিত হত্যা?

কবীর চৌধুরী তন্ময়
Published : 15 May 2017, 09:56 AM
Updated : 15 May 2017, 09:56 AM

সাম্প্রতিক সময়ে গাজীপুরে বাবা-মেয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাটি শুধু সমাজ আর রাষ্ট্রযন্ত্রকেই নয়, স্বয়ং রাষ্ট্রকেই বুঝিয়ে দিয়ে গেছে- কারো প্রতি তাঁদের বিশ্বাস ছিল না! ন্যায় বিচার পাওয়ার আশায় সমাজের স্থানীয় বিচারকখ্যাত জনপ্রতিনিধির কাছে গিয়েও লাঞ্ছিত হয়েছে। থানায় জিডি করার পরও পুলিশের থেকে তেমন গুরুত্ব পাওয়া যায়নি। বরং অভিযোগ করার পরিপ্রেক্ষিতে নানা ধরনের হুমকি-ধমক আর মানসিক নির্যাতন নেমে এসেছিল তাঁদের জীবনে।

এদিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে বিচারের আশা নিয়ে মেয়ে আয়শাকে যে শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, সে বিষয়ে অত্র থানায় জিডিও করেছিল হযরত আলী। শুধু তাই নয়, কী কী অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে সেগুলোও সাধারণ ডায়রিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

অবাক ব্যাপার, একটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ যেখানে লিখিত প্রতিবেদন তৈরি করার কথা ছিল, সেখানে তা না করে কেবল সে বিষয়ে তদন্ত করেছে এবং বাদীর সঙ্গে কথা বলেছে! শুধু তাই নয় যে পুলিশ প্রশাসন অভিযোগ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তার বলয় তৈরি করার কথা, তারাও হযরত আলী ও তাঁর মেয়ে আয়েশার অভিযোগটাকে গুরুত্ব দেয়নি!

অন্যদিকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছে বিচার চেয়েও বিচার পায়নি। বরং উল্টো পাশের ধানক্ষেতে ছাগল গিয়ে ফসল নষ্ট করা হয়েছে বলে মিথ্যা অভিযোগ তৈরি করে হযরত আলীকে হত্যার উদ্দেশ্যে দা ও লাঠি নিয়ে মহড়া দেয় ওই এলাকার কিছু বর্বর পশু! অপরদিকে যে জনপ্রতিনিধি সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল; সে জনপ্রতিনিধি বিচারের নামে আপস-মীমাংসার প্রস্তাব দিয়েছে।

একটু পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাষ্ট্রযন্ত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি যে এবারই প্রথম নাগরিক অভিযোগ গুরুত্ব না দেওয়ার প্রশ্ন উঠেছে তা কিন্তু নয়। ২০১৫ সালের ৭ আগস্টে খুন হওয়া ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় তাঁর জীবনের নিরাপত্তার শঙ্কা থেকে থানায় জিডি করতে গেলে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা সাধারণ ডায়েরি না নিয়ে তখন বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন! যা নিলয় তাঁর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে অন্যদের জানিয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র তখন নিলয়ের শঙ্কাকে রাষ্ট্রের শঙ্কা মনে করলে কিংবা অভিযোগকে গুরুত্ব দিলে হয়তো নিলয়কে চাপাতির কোপে খুন হতে হতো না।

হযরত আলী রাষ্ট্রের কাছে বিচার চেয়েও বিচারহীনতায় থেকেছে দীর্ঘদিন। আবার অপেক্ষমাণ বিচারের মাঝখানে দুর্বৃত্তরা যখন গরু চুরি করে নিয়ে মানসিকভাবে নির্যাতন শুরু করে, তখন সেই রাষ্ট্রযন্ত্র বা রাষ্ট্রের প্রতি শুধু আয়শার বাবা হযরত আলীরই বিশ্বাস নষ্ট হবে না; জাতি তখন অসহায়বোধ করে। নিরাপত্তাহীনতায় শঙ্কিত হয়। একটা সময় হারিয়ে ফেলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা-বিশ্বাস।আর  এখানে স্পষ্টই দেখা যায়, বিচারহীনতার পরিবেশ থেকে হযরত আলীর মনে জন্ম নিয়েছে সমাজ-রাষ্ট্রযন্ত্র তথা রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা-ক্ষোভ! কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? কে তাঁর মেয়ের মানসিক নির্যাতন আর শ্লীলতাহানির বিচার করবে? কে তাঁর মর্যাদা নিশ্চিত করবে? মেয়েটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনের কলঙ্কের কালো ছায়াও বড় হবে। তখনো সমাজ-রাষ্ট্রের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা ফারুকের মতো নরপশুরা আবারও হয়তো তাঁর মেয়েটিকে খুঁজে বের করবে। সমাজপতিরা তখন এক হাজারের বদলে ১০০ টাকায় আপোস করার প্রস্তাব দিবে- এমনটি ভাবার পাশাপাশি আয়শার নিরাপত্তহীনতার পরিবেশ দেখে আলীর মনে রাগ-ক্ষোভ জন্ম নিয়েছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অবহেলা ব্যাপারটি তাঁকে প্রতিনিয়ত বিধ্বস্ত করেছে।

সমাজের আর  ১০ জনের মতো হযরত আলী তার পালিত মেয়ে আয়েশা খাতুনকে নিয়ে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে চেয়েছিল। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তার সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার বিপরীতে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে। আট বছরের মেয়ের সম্ভ্রম এক হাজার টাকায় মূল্য নির্ধারণের মতো জঘন্য অপরাধ করেছে।

বাবা-মেয়ের মৃত্যুটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড! একটি স্বার্থান্বেষী মহল দীর্ঘদিন ধরে হযরত আলীর দখলে থাকা সরকারি সম্পত্তি নিজেরা দখল করতে চেয়েছিল। তখনো আপস, টাকার লোভ আর ভয়-ভীতি দেখিয়ে একপর্যায়ে কোনো লাভ না হওয়ায় পরে বাস্তবেই শুরু করেছে হযরত আলীর পরিবারের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন। তার বিচার চাইতে গেলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও সেই একই সুরে কথা বলে। আপস হয়ে যাও!

রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর বিশ্বাস-বিচারহীনতায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি মহলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র আদৌ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কি না, তা সময়ই তা বলে দেবে। তবে এই বিচারহীনতার অবিশ্বাস থেকে হযরত আলী-আয়শা খাতুনের হত্যার বিচার করতে আমরা ব্যর্থ হলে, ভবিষ্যতে এই মৃত্যুর মিছিলে অন্য কোনো বাবা-মেয়ের নাম যুক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)