ঈদ এবং বেতন না পাওয়া সাংবাদিকের আর্তনাদ

কেফায়েত শাকিল
Published : 2 Sept 2017, 01:04 AM
Updated : 2 Sept 2017, 01:04 AM


সম্প্রতি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল মালিক তাদের কর্মীদের বেতন ভাতা পরিশোধ না করে হঠাৎ গণমাধ্যমটি বন্ধ করে দিয়েছে। একে ঈদ আসন্ন তার সাথে হঠাৎ কর্মস্থল বন্ধের ঘেষণা, তাও আবার দু-তিন মাসের বেতন ভাতা বাকি। সব মিলিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় দিন কাটছে গণমাধ্যমটিতে কর্মরত সাংবাদিকদের মাঝে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদের মাধ্যমে এবং সেই অফিসের কর্মরতদের মাধ্যমে যতটুকু জেনেছি গত ১৩ আগস্ট পোর্টালটি বন্ধ হলেও দীর্ঘদিন মালিকপক্ষের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে নিজেদের পাওনা বুঝে নেয়ার চেষ্টা করে আসছিল সেখানকার সাংবাদিকরা। কিন্তু মালিকপক্ষ আলোচনার প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে উল্টে তাদের বিভিন্ন ভাবে হুমকি দিয়ে আসছে এবং তাদের চরিত্র হননের লক্ষে সেই পোর্টালটিতে বানোয়াট নিউজ প্রকাশ করতে থাকে।

অপরদিকে সেখানকার সাংবাদিকরা সমাধানের কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে স্মরণাপন্ন হন সাংবাদিক সংগঠনগুলোর। সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতারও মালিক পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। যা জানতে পারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে নেতাদের দেয়া বক্তব্য থেকে। সেদিন প্রেসক্লাবের সামনের সামবেশে সাংবাদিক নেতারা মালিক পক্ষের এমন আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানান। এরপর নাকি মালিকপক্ষ নিউজের মাধ্যমে সাংবাদিক নেতাদের নিয়েও নানা মন্তব্য করে আসছে। যা রীতিমত হাসি ঠাট্টার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

.

রাত পোহালেই ঈদ। ফেসবুকে আনেকে ঈদ শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে। এরই মাঝে একটি মেসেজ পেলাম। খুলে দেখি আমার খুব কাছের এক সাংবাদিক সহকর্মীর স্ট্যাটাস। স্ট্যাটাসটি পড়ে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারিনি। নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। কেন সাংবাদিকতা করছি তা নিয়েও প্রশ্ন জাগলো মনে। অজানা শঙ্কা তৈরি হলো এ পেশার ভবিষ্যত নিয়ে। ভাবতে থাকলাম গার্মেন্টস কর্মী হলেতো অন্তত শ্রম মন্ত্রণালয় বেতনের বিষয়টি দেখতো। প্রশ্ন জাগলো তথ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়েও। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কি মিডিয়ার অনুমতি দেয়া আর মনমতো না হলে বন্ধ করে দেয়া? এসব গণমাধ্যমে কারা কাজ করবে তাদের বেতন ভাতার ধরণ কেমন হবে, তা আদায়ের সিস্টেম কেমন হবে এটা কি দেখার দায়িত্ব তাদের নেই। গণমাধ্যম কর্মীরা বেতন না পেলে তা আদায় করে দেয়ার দায়িত্ব যদি নিতে না পারেন তাহলে এই মন্ত্রণালয়কে দিয়ে সাংবাদিকদের কি লাভ?

.

তাছাড়া, তথ্য-প্রযুক্তি আইনে অনেক সাংবাদিককে গ্রেফতার হতে দেখছি অথচ নিয়মিত বানোয়াট তথ্য প্রচার করে তথ্য সন্ত্রাস চালিয়ে গেলেও এদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না তথ্য মন্ত্রণালয়? জানি বেশি আশা করেও লাভ নেই। তাই করিও না। তবে আজকের আমার এই লেখার প্রধান উদ্দেশ্য মজলুম এই সাংবাদিক বন্ধুর হৃদয়ের আর্তনাদটুকু অন্তত মাননীয় তথ্যমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছানো। তথ্যমন্ত্রী মহোদয় যদি আমার সাংবাদিক বন্ধুটির হৃদয়ের আর্তনাদ দেখে একটু বুঝার চেষ্টা করেন যে সাংবাদিকরা কত নির্যাতিত, কতো অসহায় তাহলেই আমি স্বার্থক।

.

মাননীয় তথ্যমন্ত্রী মহোদয়কে উৎসর্গ করে পাঠকদের জন্য সাংবাদিক আবদুর রহিমের দেয়া স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো :

স্ট্যাটাসটি যেমন ছিলো ‍‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌"সূর্য ডুবে গেছে। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি। রাত পোহালেই পবিত্র ঈদুল আযহা। তাই আমার পাশের সহকর্মী ও বন্ধুদের মুখে হাসি। আনন্দ আছে আমার বাসার পাশের প্রতিবেশীদেরও। তবে আনন্দের রেশমাত্রও নেই আমার মুখে। কিভাবে থাকবে আমি যে পেটের ক্ষুদাও নিবারণ করতে পারছি না। গত ১৩ তারিখ থেকে টাকার অভাবে উপবাস ছিলাম বহুদিন। লজ্জায় কাউকে বলতেও পারিনি। আজ বিকেলে ওপার থেকে মায়ের ফোন… সঙ্গে আছে কান্নার শব্দ।
বাবা! তুই বাড়ী আসবি কখন? তাড়াতাড়ি আয়।

আমি বলার সাহস পাচ্ছি না, মাগো আমি টাকার অভাবে গত রাত এবং আজ সকালেও খেতে পারিনি। সহকর্মী প্রিয় শাকিল ভাই ৪০ টাকা দিয়ে গেছে দুপুরে খেতে। রাস্তার পাশে খোলা হোটেলে মাত্র খেয়ে আসলাম। পেটটা না এখন খুব শান্তি। মাগো তুমিতো জানো প্রতি ঈদে তোমার জন্য কিছু নিয়ে যাই। আব্বাকেও খুশি রাখার চেষ্টা করি। আর মাহি, মাজেদ, আফরিদা, শুভরা ঠিকই অপেক্ষা করছে মামা/কাকা আসছে তাদের জন্য ঠিকই কিছু নিয়ে আসবো। ক্ষমা করে দিও মা। এবার মনে হয় বাড়ী আসতে পারবো না। আমার পকেটে ১০টা টাকা নেই। গাড়ী ভাড়া নেই। মাথার চুলগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে টাকার অভাবে কাটতে পারছি না। গত তিনদিন আগে জুতাটিও ছিড়ে গেছে। সব মিলিয়ে বাসাই এখন আপন ঠিকানা। এক বন্ধুকে বলেছি এক হাজার টাকা দিতে। সে কথা দিয়েছে দেবে। যদি পাই তোমাকে দেখার মানসিকতা এখনো রাখি মা।

মা… তোমাকে বলতে পারিনি। বললে তুমি খুব চিন্তা করবে তাই। তবে আকবরকে (ছোট ভাই) বলেছি। গত ১৩ তারিখ আমার প্রাণের কর্মস্থল Jamunanews24.com কোনো ঘোষণা ছাড়াই ইন্টারনেটের সমস্যা বলে একদিন ছুটি দিয়ে এর পরদিন থেকে বন্ধ। অফিস এখনো তালা মারা। জানিনা তা আদৌ খুলবে কিনা। তবে এ নিয়ে কিছুদিন আগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠনের সব নেতারা দাবি জানিয়েছেন তা খুলে দিতে এবং আমাদের পাওনা টাকা সব পরিশোধ করতে। গত দু'মাসে আমার ঘাম ঝরানো টানা ১০ ঘন্টা করে পরিশ্রমে ২১ হাজার করে ৪২ হাজার টাকা এখনো আমি পাইনি। ঈদ বোনাস তা তো এখন স্বপ্ন। তবে এছাড়াও অফিসে আমার বেশ কিছু টাকা আটকে আছে। আমার ড্রয়ারে কিছু টাকা। আমার টেবিলের নিচে একটি মাটির ব্যাংকও আছে। তাতেও রয়েছে কিছু টাকা। তা অফিসের সবাই জানে। আছে আরো কিছু মূল্যবান জিনিস। তাও উদ্ধার করতে পারছি না।

মাগো বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে ভালো নেই আমি। আমি টাকা পাই, টাকা দেন। এ কথা বললেও এখন বিপদ। যারাই টাকা চাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অফিস গায়েবী নিউজ করছে। ইজ্জতের ভয়ে অনেকে নীরব আছে। কারণ তাদের হাত অনেক উপরে। আর আমরা সামান্য সাংবাদিক। মালিক পক্ষের কাছে আমরা বদলার মতো। মা তুমি মনে হয় জানো… গত ঈদে অফিসের সবাইকে নিয়ে গল্প করেছিলাম। তাদের মধ্যে অফিস সহকারী মুকুল, বার্তা সম্পাদক নয়ন ভাই, সিনিয়র রিপোর্টার জিসান ভাই, শুশান্ত দাদার বিরুদ্ধে কি-যে, মিথ্যা, বানোয়াট তথ্য দিয়ে নিউজ করেছে। আমার বলতেও থুতু আসছে। শুধু আমি না মা, কেউ-ই ভালো নেই।

আজ সকাল ১০ টা ১৮ মিনিটে আমিও হুমকি পেয়েছি। এক আইনজীবীর কাছ থেকে। আমি তার নাম বলতে চাই না। যে আইনজীবী আমার সাথে এর আগে একাধিকবার ফোনে কথা বলেছেন। এক টেবিলে বসে কথা হয়েছে। যে আমার শরীরের লোমের সংখ্যাও জানে সে আজ ফোন দিয়ে বলে আমি কোন পত্রিকার সাংবাদিক! আমার কী আইডি কার্ড আছে? আমাকে দেখে নেবে এবং আমার বিরুদ্ধে মামলা করবে।

আজ সকালে অফিসের সবার চেয়ে সিনিয়র লাবিব হাসান (ছদ্ম নাম) বড় ভাইকে ফোন দিয়েছিলাম, ভাই কেমন আছেন। জানো মা! ভাই কেঁদে দিলো। বললো, কাল ঈদ! আমার ঘরে ভাতের চাউল নেই। আমার ছোট ছেলে জিজ্ঞেস করছে বাবা আমাদের গরু কিনবে না! পাশের বাসার সবাই না বড় বড় গুরু গুলো কিনে ফেলেছে। আমার দু সন্তান ও স্ত্রীকে মুখ দেখাতে পারছি না। ভাইয়ের কথার পর সকাল থেকে কিছুটা স্বাভাবিক আছি। আমি না খেয়ে আছি তবে ভাইয়ের থেকে একটু ভালো আছি।

আবদুর রহিম
কম্পোজ: ৬ টা ১৫ মিনিট''