ক্যাডেট কলেজ: অপ্রয়োজনীয় এক খাদক

কাওসার জামান
Published : 4 Feb 2015, 06:53 PM
Updated : 4 Feb 2015, 06:53 PM

জনগনের দেয়া টাকা জনগনের সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধনে ব্যয় করা ও সর্বাধিক কল্যাণমুখী খরচের খাত বাছাই করা সরকারের গুরু দায়িত্ব।

যেকোনো অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হল এ থেকে প্রাপ্তব্য সম্ভাব্য লাভ বা ইআরআর (Economic Rate of Return)। জনকল্যাণমুখী খাতে বিনিয়োগের লাভ নির্ধারিত হয় সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগ থেকে জনগন কতটা উপকার পাবে ও উপকারভোগীরা বিনিময়ে দেশের অর্থনীতিতে কতটা বাড়তি অবদান রাখবে তার হিসাব করে।

যেমন পদ্মা সেতুতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সরকার কীভাবে লাভবান হবে তা খালি চোখে ধরা পড়ে না। কিন্তু এ সেতু দেশের ঐ অংশে ব্যবসা ও যোগাযোগ খাতে যে বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে তা এক ধাক্কায় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ২%-৩% বাড়িয়ে দিবে। ফলে ঐ সেতুর জীবনকালের একপঞ্চমাংশ পূর্ণ হওয়ার আগেই সরকার বিনিয়োগ করা অর্থ ফিরে পাবে। আর সেতুর বাকী জীবনকাল বোনাস হিসেবে কাজ করবে, সাথে জনগনও উপকৃত হবে।

ক্যাডেট কলেজগুলির জন্য প্রতি বছর যে বিপুল পরিমান সরকারী অর্থ খরচ করা হয় তার তুলনায় এগুলি থেকে কি বাড়তি কোনো রিটার্ন পাওয়া যায়? একটা বেসরকারী স্কুল শুধু শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনের একটা অংশ সরকারের কাছ থেকে পেয়েই যে ফলাফল উপহার দিচ্ছে ক্যাডেট কলেজগুলি বিরাট বাজেটের সাথে এমনকি টেনিস খেলার মাঠ পরিচর্যার জন্য সরকারী অর্থ পেয়েও সেই মানের ফলাফল অর্জন করতে পারছে না।

সরকারী হিসাব অনুযায়ী, সাধারণ সরকারী স্কুলের একজন শিক্ষার্থীর তুলনায় ১৩ গুন এবং সাধারণ বেসরকারী স্কুলের একজন শিক্ষার্থীর তুলনায় ১০ গুন বেশি সরকারী অর্থ ক্যাডেট কলেজের একজন শিক্ষার্থীর জন্য ব্যয় করা হয়।

শিক্ষা খাতে অর্থনৈতিক লাভের কথা চিন্তা না করে সরকার বিনিয়োগ করতে পারে। তবে এজন্য শর্ত হল, প্রকৃত জনকল্যাণ নিশ্চিত করা। যেমন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রতি শিক্ষার্থীর পিছে সরকারের বার্ষিক ব্যয় ৮ লক্ষ টাকার উপর। মেডিকেল কলেজগুলিতে আরো বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থা যাই হোক, সরকারকে এ ব্যয় করে যেতেই হবে। কারণ উচ্চশিক্ষার সুযোগ অব্যাহত রাখা।

ক্যাডেট কলেজগুলি কি ঐ রকম কিছু? মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে অসংখ্য সাধারণ প্রতিষ্ঠান যেখানে ক্ষুদ্র সরকারী সাহায্য নিয়ে ক্যাডেট কলেজগুলির চেয়ে মানে-গুনে-পরিমানে অনেক উন্নত ফলাফল করছে সেখানে কেন ক্যাডেট কলেজগুলির পিছনে বাড়তি অর্থ শ্রাদ্ধ করতে হবে? টাকাগুলি কি গৌরী সেনের?

এক সময় ক্যাডেট কলেজগুলি পরীক্ষার ফলাফলে সেরা হত। কিন্তু গত ১৫ বছর যাবত সরকারী-বেসরকারী সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ফলাফলের ধারে-কাছেও আসতে পারছে না এগুলি। হ্যাঁ, তাদের ফলাফল খারাপ হচ্ছে না, কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্যাডেট কলেজগুলি কি সাধারণ প্রতিষ্ঠানগুলিকে টেক্কা দিতে পারছে?

অনেক প্রতিষ্ঠান নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে ভালো ফল করছে। প্রয়োজনে এগুলিতে বিনিয়োগ বাড়ানো যায়। মুষ্টিমেয় শিক্ষার্থীকে অপ্রয়োজনীয় সুবিধা দেয়ার জন্য ক্যাডেট কলেজ নামের হাতিগুলি পালনের কোনো দরকার নেই। এক ক্যাডেট কলেজ যে পরিমান সরকারী অর্থ অপচয় করে তা দিয়ে ১০ টি সাধারণ স্কুলের ব্যয় নির্বাহ হতে পারে।

তাছাড়া একেকটা ক্যাডেট কলেজ যে বিশাল পরিমান সরকারী জমি দখল করে আছে তাতে অন্ততঃ একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা ১০ টি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করা যাবে। গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশের জন্য যদি এত বড় পরিসর দরকার হয় তাহলে অন্য লাখো শিক্ষার্থী কেন এ সুযোগ পাবে না? যারা জিপিএ ৫ পায় তাদের ৯৫% তো ক্যাডেট কলেজ নয় এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী।

ক্যাডেট কলেজগুলি আদতে কলেজই নয়। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা পৃথিবীর সব দেশেই স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা। আমাদের বর্তমান শিক্ষানীতি অনুসারেও তাই। কিছু সহজাত মেধাবীকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়ে গিয়ে সামরিক আগডুম-বাগডুম শিখানোর এ অভিনব প্রথা পাকি সামরিক জান্তা চালু করেছিল তার সেবাদাসদের পুরস্কৃত করার কৌশল হিসেবে। শারিরীক ফিটনেস ছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রেই নিজেদের অগ্রগামিতার প্রমাণ রাখতে পারে নি ক্যাডেটরা। অধিকাংশ তুখোড় মেধাবী সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তৈরী।

ক্যাডেট কলেজগুলি নাকি ভবিষ্যৎ আর্মি অফিসারদের তৈরী করে। মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার চেয়ে বেশি জরুরী আর কি আছে? এইচএসসি পরীক্ষা পাশের পর যারা কমিশন্ড অফিসার হিসেবে সশস্ত্রবাহিনীতে যোগ দেয় তাদের বড় এক অংশ সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আসে। ক্যাডেট পড়ুয়ারা বরং ডাক্তার-প্রকৌশলী-ব্যাংকার হতে বেশি পছন্দ করে। যদি সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই আর্মি অফিসার হয় তাহলে ক্যাডেট কলেজের দরকার কী?

আর্মি অফিসাররা ক্যাডেট কলেজগুলির বিভিন্ন পদে বসে নিজেদের আখের গোছায়। ক্যাডেট কলেজগুলির জন্ম যেমন ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুবের হাতে তেমনি দেশে এগুলির সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেও শুধু দুই সামরিক স্বৈরাচার জিয়া ও এরশাদ এবং সামরিকতন্ত্রের এজেন্ট খালেদা। যেনতেনভাবে ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছায় আর্মি তোষণের জঘন্য নীতি ছাড়া আর কি এটা?

এদেশের আমলাতন্ত্র যেমন নিজেদের স্বার্থে এখনো ঔপনিবেশিক মানসিকতার ধারক ও বাহক তেমনি অধিকাংশ মধ্যবিত্তও হীনমন্যতার দরুণ এখনো এ মানসিকতার প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নি। তাই জনগনের টাকা নষ্ট করেও টিকে আছে তথাকথিত ক্যাডেট কলেজগুলি।