ঈশ্বর বিশ্বাসি খুনি ও তার শিকার

কাওসার জামান
Published : 1 March 2015, 01:52 PM
Updated : 1 March 2015, 01:52 PM

শুধু ভিন্নমত প্রকাশ করেছে বলে কাউকে ঠান্ডা মাথায় কুপিয়ে খুন করা কখনো কোনো মানুষের কাজ হতে পারে না। একজনের নিজস্ব বিশ্বাসের জন্য তার জীবনের ইতি টেনে দেয়ার অধিকার অন্য কারোর নেই, তার বিশ্বাস এমনকি ভুল হলেও।

কেউ যদি ভুলভাবে বা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অন্যের বিপক্ষে কিছু বলে তবে সত্য প্রকাশ করে এর জবাব দেয়া যায়, তাই দেয়া উচিতও। তা না করে তাকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলা মানে প্রমাণ করা যে, তার খুনীরা ভুল পথে চালিত হচ্ছে।

মহানবী (সা:) কর্তব্য পালন করতে গিয়ে দিনের পর দিন নিষ্ঠুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সয়েছেন। এরপরও তিনি শত্রুর উপর পাল্টা আঘাত করেন নি, বরং চারিত্রিক মাধুর্য ও যুক্তি দিয়ে চরম শত্রুদের মুগ্ধ করেছেন।

তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা শত্রুদের হাতে বারবার অন্যায়ভাবে অত্যাচারিত হয়ে শেষে তাদের থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। শত্রুরা যখন নবী ও তাঁর সঙ্গীদেরকে হত্যা করতে সেখানে গিয়েও হাজির হয়েছে তখন তিনি তাদের প্রতিরোধ করেছেন।

সেই নবীর কোনো অনুসারী কীভাবে এর বিপরীত কাজ করতে পারে? কখনোই পারে না। মুখোশ পরা ভন্ডরা জেনে-শুনেই উল্টোটা করে ক্ষমতালোভী ধর্ম ব্যবসায়ী জানোয়ারদের পোষা জন্তু হিসেবে, নিজেদের অন্তহীন অপরাধবোধ ঢাকা দিতে।

এরা মনে রাখতে চায় না যে, আল্লাহ্ সব মানুষকেই নিজ নিজ বিশ্বাস নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সুযোগ দিয়েছেন। আল্লার দেয়া এ সুযোগ কেড়ে নিতে চাইতে পারে কে? যারা মনে করে এটা কেড়ে নেয়ার অধিকার তাদের আছে তারা আল্লার চাওয়া পুরণ করে না।

আল্লাহ্‌ বলেছেন, "নিশ্চয় আমিই এ মহাগ্রন্থ (আল কুর্‌আন) অবতীর্ণ করেছি। আমিই এর রক্ষক।" অর্থাৎ ইসলামকে রক্ষার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লার হাতে। এটা জানার পর কোনো প্রকৃত মুসলমান কেন ভাববে যে, কেউ ইসলামকে ধ্বংস করে ফেলবে? সন্দেহ নেই, যারা ইসলাম রক্ষার নামে কাউকে খুন করে তারা শুধু খুনীই নয়, আল্লার ওয়াদায়ও তারা আস্থাহীন।

এদিকে মুক্ত চিন্তা করার নামে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী কিছু লোকের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্দিষ্ট কয়েকজন মহামানবকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা। চিন্তার মুক্তি তো আটকায় জীর্ণ সমাজ ব্যাবস্থায়। তাহলে কেন সমাজ বদলের পরিকল্পনা তৈরী করা নয়? কেন অন্যকে অযাচিতভাবে হেয় করতে যাওয়া? মনোযোগ আকর্ষনের চেষ্টায়?

ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বলে চিহ্নিত হওয়ার জন্য ঈশ্বর বিশ্বাসীদের বিপক্ষে বিষেদাগার করা কেন আবশ্যক হয়ে পড়লো? জানাবে তো ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হওয়ার যুক্তি ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। সেগুলি ভালোভাবে অনুধাবন না করেই ঈশ্বর বিশ্বাসীদের দাবিয়ে রাখার এত জোরালো ইচ্ছে পোষণ করা কেন?

কারোর ঈশ্বর বিশ্বাসী হওয়া না হওয়ায় পৃথিবীর কিছুই যায় আসে না। এটা সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। পৃথিবীকে প্রভাবিত করে শুধু সত্য। আর সত্যকে পাথেয় করে চলার জন্য কাউকে খুন করা যেমন জরুরী নয় তেমনি অন্যের বিশ্বাসকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আঘাত করাও মোটেই প্রয়োজনীয় নয়।

এদেশেরই কিছু মানুষ ঈশ্বর বিশ্বাসী না হয়েও জ্ঞান বিতরণ, সত্য চর্চা, বিনয় ও মানবপ্রেমে অনন্য হয়ে আছেন। যেমন আহমদ শরীফ ও আব্দুর রাজ্জাক। সত্যকে জানতে ও জানাতে তাঁরা নিষ্ঠাবান ও নৈর্ব্যক্তিক ছিলেন বলেই অন্যকে ছোট করা নয়, নিজের আবিস্কার ও যুক্তিকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করাই ছিল তাদের লক্ষ্য।

এখনকার অধিকাংশ ঈশ্বর অবিশ্বাসীর প্রথম কাজ হচ্ছে ধর্মের প্রাণপুরুষদের চরিত্র হননের চেষ্টা করা, বিশেষ করে ইসলামের নবীর। এজন্য মিথ্যার আশ্রয়ও নেয়া হয়। এক হাদিস হল, "নামাযের সময়ে অন্য কোনো কাজ নয়।" এটাকে এক ঈশ্বর অবিশ্বাসী বদলিয়ে লিখেছে, "পর্দা সরাও, বিছানায় চলো।" এর ভিত্তিতে আবার নবীর সমালোচনাও করেছে।

মহানবী (সাঃ) যে মানবীয় গুণের নিরিখে সর্বশ্রেষ্ঠদের একজন ছিলেন তা স্বীকার করার জন্য মুসলমান হওয়া লাগে না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক বিচার করলে মানুষ মুহাম্মদ (সাঃ) কে শ্রেষ্ঠতম স্থান দেয়া যে কারোরই দায়িত্বের মধ্যে পড়বে। যে পরিস্থিতিতে তিনি মানবতার সেরা বৈশিষ্টগুলি ধারণ করেছেন সেটাই তা দাবী করে।

আমেরিকান গবেষক মাইকেল এইচ হার্ট দীর্ঘ গবেষণার পর ১৯৭৮ সালে "দি হান্ড্রেড" নামে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটিতে মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্বাপেক্ষা প্রভাব বিস্তারকারী ১০০ জন মহামানবের নাম ক্রমানুসারে সাজানো। সেখানে প্রথম নাম মুহাম্মদ (সাঃ) এর, দ্বিতীয় নাম বিজ্ঞানী নিউটনের আর তৃতীয় নাম যীশুখ্রিস্টের।

নোবেল ও অস্কার পুরস্কার জয়ী পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বার্নাড শ বলে গেছেন, "একমাত্র মুহাম্মদের পক্ষেই পৃথিবীতে সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল।" সর্বোপরি চরম শত্রুরাও মানুষ মুহাম্মদকে মহত্তম বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।

সেই ব্যক্তি মুহাম্মদের ভুল বের করতে চাওয়া হাস্যকর ইচ্ছা নয়? পারলে ধর্মসমূহের খুঁত নির্দেশ করা যায় বা কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করার দরকার নেই থাকলে সে যুক্তিও দেয়া যায়। কিন্তু ব্যক্তি চর্চা কেন? বা ধর্ম হিসেবে কেন শুধু ইসলামই লক্ষ্যবস্তু হবে? ইসলাম মেয়েদের জীবন্ত কবরস্থ হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে আর অন্য অনেক ধর্ম মেয়েদের জীবন্ত পুড়িয়েছে।

সত্য অনুসন্ধান করা মানে বর্তমানকে অজানা আলোয় আলোকিত করার জন্য চিন্তাকে মুক্ত করে দেয়া, নির্দিষ্ট কাউকে বাতিল করার জন্য বৃত্তবন্দী হয়ে চেষ্টা করে যাওয়া নয়। তা করতে না পারলে সুচিন্তার ধারক বলে পরিচয় দেয়া কেন?