ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো

কাজী রাশেদ
Published : 7 March 2015, 07:33 AM
Updated : 7 March 2015, 07:33 AM

চুয়াল্লিশ বছর পরে এসেও বাঙালির জীবনে সাতই মার্চ আজো সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে। ৭৫এর শোকাবহ হত্যাকান্ডের পর বাঙালিকে আবার পিছনের দিকে নিয়ে যাবার যে প্রক্রিয়া সামরিক শাসকেরা করেছিলো তারই ধারাবাহিকতায় আজ বাংলাদেশ জঙ্গীগোষ্ঠির উত্থানের সম্ভাবনাময় দেশে পরিনত হয়েছে। জামিল আক্তার রতন থেকে শুরু করে হুমায়ন আযাদ স্যার হয়ে অভিজিতে এসে ঠেকেছে এই গোষ্ঠীর হামলা। আজ আবার ঘরে ঘরে দুর্গ করার সময় এসেছে এই গোষ্ঠীকে মোকাবেলা করার জন্যে।

বাংলা নামের এই দেশটিতে হাজার বছরের ইতিহাসে অনেক নেতা- উপনেতার জন্ম হয়েছে ঠিকই কিন্তু এদেশের আম জনতার মেজাজ মর্জি, ইতিহাস ঐতিহ্য আর ভাবগতিক বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো নেতার অভাব সবসময়েই ছিলো। ১৯৭১ সালের সাতই মার্চের ভাষন সে কথাই বার বার আমাদের মনে করিয়ে দেয়। সেন বংশ থেকে শুরু করে আজ অবদি অনেক জাতীয় নেতার নেতৃত্বে এই বাংলা শাসিত হয়েছে বা শোষিত হয়েছে কিন্তু এই দেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা কে ধারন করে ঐক্যবদ্ধ করা কখনোই সম্ভব হয়ে উঠেনি। বাংলার আকাশে যেদিন মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব সিরাজ এবং বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে ছিলো সেদিনো বাংলার আপামর মানুষ সকালে তাদের নিত্যদিনের কাজে বের হয়েছিলো স্বাভাবিক ভাবেই। এর কারণ সম্ভবতঃ একেবারে তৃণমূল থেকে সাধারন মানুষের সাথে মিশে তাদের আশা আকাংখাকে বুকে ধারন করে তাদেরকে সংঘঠিত করার কাজটি বঙ্গবন্ধু বা মৌলানা ভাষানী ছাড়া আর কেউ করেননি বা করতে চাননি। আবার সেক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুও তারই নেতা মৌলানা ভাষানীকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। আর তাই বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠে ছিলেন সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্য দিয়ে।

বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক পর্যায়ে রাজনৈতিক বা বয়সের কারণে অনেক বর্ষীয়ান নেতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন কিন্তু এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এদেশের জনগনকে একতাবদ্ধ করা বা সম্পর্কিত করা তাদের পক্ষে করা সম্ভব হয়ে উঠে নি। এদেশের রাজনীতি এবং ষাটের দশকের আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন গবেষনায় বিভিন্ন গবেষক এই আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর একচ্ছত্র নেতা হিসেবে বের হয়ে আসার অনেক গবেষণা প্রকাশ করেছেন। অনেকেই এই আন্দোলন এবং অভুত্থান নিয়ে গবেষনা করে বিশ্বের অনেক নামী দামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট পেয়েছেন তবে খুব সংখ্যক গবেষকই তাঁর জনগনের কাছে গ্রহনযোগ্যতা পাওয়ার গোপন রহস্যের ব্যাপারে উদাসীন থেকেছেন। আর সেখানেই তাদের গবেষণার সীমাবদ্ধতা। কেউবা তার কারিশমা কে প্রাধান্য দিয়েছেন কেউবা তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর সংঘঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জনগনের কোন অংশকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছিলেন সে ব্যাপারে বেশীর ভাগ গবেষকই এড়িয়ে গেছেন।

বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক ও দেশ পরিচালনার জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার নীতিনির্ধারণে যেমন অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ , গবেষক আর আমলাদের সহযোগিতা নিয়েছিলেন তেমনি মাঠে তাঁর কর্মসূচী বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে যে কর্মী বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন সেই কর্মী বাহিনী ছিলেন সেইসময়ের গ্রাম্য সমাজে শিক্ষিত জন হিসেবে পরিচিত । এই কর্মী বাহিনী সরাসরি তাঁর সঙ্গে মত বিনিময় করার ক্ষমতা রাখতেন। এই কর্মী বাহিনী সরাসরি তাদের নেতার কাছে চলে যেতে পারতেন। সেই সাথে এই কর্মী বাহিনী যেহেতু সেই সময়ের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ সেহেতু তারা সমাজের ভিতর থেকে একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার কাজটি অত্যন্ত সুক্ষ ভাবে করে গেছেন।

১৯৬৬ সালে যখন বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের মুক্তির সনদ ৬ দফা উত্তাপন করলেন তখন এই কর্মী বাহিনীই সারা বাংলাদেশে এই ছয় দফার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায়। বিদ্যুৎ গতিতে ছয় দফ এই দেশের মানুষের প্রানের দাবীতে পরিনত হয়েছিলো। ছয় দফার প্রত্যেকটি দফা এদেশের সাধারন মানুষের মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো। আর তাই ৭০ এর নির্বাচনে এদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে কোন দেরী করে নি, আবার নির্বাচনে জয়লাভ করেও যখন পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলা তথা তৎকালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা দিচ্ছিলো না তখন এইদেশের মানুষ বিনা দ্বিধায় রাস্তায় নেমে এসেছিলো।

এদেশের সাধারন মানুষের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা বুঝতেন বলেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এদেশের প্রত্যেকটি মানুষের মনের কথা গুলো বলতে পেরেছিলেন। এই ভাষনের কথা তিনি কাউকে বলেন নাই। কি বক্তব্য তিনি দিবেন সে বিষয়ে কোন আভাষ তিনি সেদিন দেন নি। কি বলতে পারেন বা কি নির্দেশ আসছে তাঁর কাছ থেকে, ভাষনের প্রত্যেক পংক্তি না শোনা পর্যন্ত জানতে পারা যায় নি।

বাংলা ও বাঙ্গালীর হাজার বছরে ইতিহাস ঐতিহ্য, আন্দোলন সংগ্রাম, শোষন বঞ্চনা, জয় পরাজয় এবং সর্বোপরি কখন কি করতে হবে সব তিনি বলেছিলেন সেই সাতই মার্চের বক্তৃতায়।

অথচ সেই বক্তৃতায় কোথাও ছিলো না কাউকে মেরে ফেলার বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে দাবী আদায়ের কথা। ছিলো না কোন হটকারী নির্দেশ। সেইসময় তিনি বিহারী-বাঙালি সবাইকেই আহবান জানিয়েছেন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের। আবার বলেছেন তিনি যদি হুকুম দিতে না পারেন তাহলে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার।

একটি জাতির মেজাজ মর্জি বুঝে লাখো লাখো মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে দিক নির্দেশনা মুলক ভাষন পৃথিবীতে খুব নেতাই দিতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু হলেন সেই ক্ষণজন্মা নেতাদের অন্যতম। এতো বছর পরেও সাতই মার্চের ভাষন বাঙ্গালীর জীবনের দিক নির্দেশক হিসেবে আজো প্রাসঙ্গিক হয়ে বিরাজমান। এদেশে যখন গনতন্ত্র উদ্ধারের নামে মানুষ পোড়ানোর উৎসব চলে, যখন বাক স্বাধীনতায় শুধু হস্তক্ষেপই নয় কুপিয়ে হত্যা করা হয়, যখন যুদ্ধাপরাধীরা বিদ্রে দোষী সাবস্ত হবার পরেও ভি চিহ্ন দেখিয়ে এদেশের মানুষ্কে বিদ্রুপ ক্রার সাহস দেখায় তখন আবার সাতি মার্চের ভাষন আমাদের ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার প্রেরনা যোগায়।