আমি লজ্জিত, আমি পুরুষ বলে

কাজী রাশেদ
Published : 26 May 2015, 05:31 PM
Updated : 26 May 2015, 05:31 PM

বড়ো লজ্জা, লজ্জা পুরুষ হবার পরিচয়ে, লজ্জা এই বিচারহীন সমাজে, এই ধর্ষণ রাজ্যে একজন পুরুষ হিসাবে বেঁচে থাকার জন্যে। আজ সমাজে একজন পরুষ হিসাবে একজন অসহায় নারীর পাশে দাড়ানোর যে স্বাভাবিক প্রথা সেই প্রথা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই আমার। আমি একজন পুরুষ হবার কারণে আর কোন নারী আমাকে বিশ্বাস করবে না। কে জানে আমিই সেই ঘৃণিত ধর্ষক কিনা সেই ভয়ে! আর কোন বোন বলবে না দেখুন আমি খুব অসহায় পরেছি আমাকে সাহায্য করুন। আমারই মতো বা আমাদের মতোই ভদ্রবেশী একদল মানুষরূপী জানোয়ার প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের আশেপাশে ধর্ষণের আশায়। এই লেখাটি যখন লিখছি তখনই চোখে পড়লো এবার ট্রাকে ধর্ষণ শিরোনাম। এরই মধ্যে এক ইমাম মাত্র দশ বৎসরের এক শিশুক ধর্ষণ  করে খবরের শিরোনাম ।

বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় প্রতিদিন প্রধান সংবাদ হয়ে দাড়িয়েছে ধর্ষণ আর নারী হত্যার। আর আমরা একেকটি ধর্ষণের ঘটনার পর হুশিয়ার সাবধান বলে রাস্তায় প্রতিবাদ করছি। বক্তৃতা বিবৃতি আর সভা সেমিনারে ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবীতে আসর গরম করে ফেলছি। অন্যদিকে একের পর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে নির্বিবাদে।

আজ লেখার প্রথমেই একটি অশ্লীল গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। তাই সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এই গল্প ছাড়া আজকের প্রেক্ষাপটে অন্যকিছুই উপযুক্ত মনে হচ্ছে না। গল্পটি হলো, মনিব বানিজ্যে উদ্দেশ্যে বিশ্বস্ত চাকর গ্যাদাকে তার বাড়ী, সম্পত্তি এবং ঘরের সমস্ত কিছুর দায়ীত্ব দিয়ে বিদেশ চলে গেলেন। এদিকে চাকর গ্যাদা বিশ্বস্ততার সুযোগে মনিব পত্নীর শ্লীলতা হানির চেষ্টা চালায়, গ্যাদার এহেন হীন কর্মকাণ্ডে মনিব পত্নী চাকর গ্যাদাকে হুশিয়ার সাবধান করে দিলো। কিন্তু বিশ্বস্ত চাকর গ্যাদা মনিব পত্নীর হুশিয়ার সাবধানকে আমলে না নিয়ে সে তার শ্লীলতা হানীর সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত চাকর গ্যাদা তার মনিব পত্নীর শ্লীলতা হানী করে ক্ষান্ত হলেও মনিব পত্নী হুশিয়ার আর সাবধান ছাড়া আর কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলো না। আমাদের দেশের সরকার, বুদ্ধিজীবি, সুশীল, শিক্ষাবিদ, সচেতন নাগরিক আর নারী সমাজ প্রতিদিন ধর্ষণের বিরুদ্ধে, ধর্ষকের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের তথা সরকারের বিরুদ্ধে কখনো বা অন্যকোন ছায়া শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত হুসিয়ার সাবধান করে যাচ্ছে। প্রতিবাদ আর তথাকথিত প্রতিরোধের কথা বলে মাঠ গরম করে যাচ্ছে আর অন্যদিকে ধর্ষক গোষ্ঠি একের পর এক ধর্ষণের  ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে।

গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১২৩টি ধর্ষণের ঘটনার পরেও আজ পর্যন্ত কোন ধর্ষকের শাস্তি বা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনে সমর্থ হয়েছে এমন সুসংবাদ আমরা পাই নাই। এ পর্যন্ত ১৫ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে পরিবহনে এব্যাপারেও কোন পদক্ষেপের কথা পাওয়া যায় নাই। তাহলে আমাদের অবস্থা কি উপরের গল্পের মনিব পত্নীর অবস্থার মতোই নয় কি। আমরা প্রতিনিয়ত রাস্তা ঘাটে ধর্ষিত হচ্ছি। নির্যাতিত হচ্ছি রাস্তাঘাটে, ফুটপাতে বা অফিস আদালতে। শিল্প কারখানার কথা তো বাদই দেওয়া যাক। ঘটনাও ঘটছে, প্রতিবাদও হচ্ছে কিন্তু ফলাফল শুন্য। রাষ্ট্রের সবচেয়ে উপর থেকে শুরু করে নিন্ম বেতন ভোগী পুলিশ পর্যন্ত তোতা পাখীর মতো একই বুলি আওড়াতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠছে। আমরা দেখছি, অপরাধী যেই হোক শাস্তি তাকে পেতেই হবে। দেশে আইনের শাসনের ঊর্ধ্বে নয়। তারপর কিছু হইচই এবং যথানিয়মে চুপচাপ। এরপরে আবার একটি ঘটনা আবার হুসিয়ার সাবধান, মিটিং মিছিল আর সেমিনার।

নিজের ভিতরের পুরুষ টাকে যতক্ষন না পর্যন্ত আমরা সংশোধিত করতে না পারছি, নিজেদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অহমিকা আর লোভ লালসাটাকে সংবরন করতে ব্যর্থ হচ্ছি, ততক্ষন আমাদের সমাজের এই জানোয়ারগুলি নিজেদের জানোয়ারী বন্ধ করবে না। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রথম্ থেকেই নারীকে চিহ্নিত করেছে ভোগ আর লালসার বস্তু হিসাবে। সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো নারীকে সব বিষয়ে বঞ্চিত করে শুধুমাত্র ভোগের বস্তু হিসাবে স্থান নির্ধারণ করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই ধর্ষণ আর নির্যাতন। রাষ্ট্রের প্রধানব্যক্তি নারী হলেও সমস্ত ব্যবস্থাই রয়ে গেছে পুরুষতান্ত্রিক মনমানসিকতায়। নারী প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, কি বিরোধীদলীয় নেতাই হোক তিনি শুধুমাত্র শিখণ্ডী হিসাবেই দায়ীত্ব পালন করে চলেন। আর সমস্ত সমাজ, রাষ্ট্র বা সরকার চলে সমাজের পুরুষ তান্ত্রিক নিয়মেই। তাই আজও নারী ধর্ষিত হলে প্রমানের দায়ভাগ নারীকেই প্রমান করতে হয়। সমাজে ধর্ষক ঘৃণিত হয় না, ধর্ষিতা নারী হয় অবহেলিত আর একঘরে।

অন্যদিকে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারন মানুষ পর্যন্ত ভারত বিরোধীতার সুযোগ পেলে হাত ছাড়া করতে চায় না। সে যত বড়ো রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীই হোন না কেন। বিশেষ করে একপক্ষের রাজনীতিই হলো ভারত বিরোধিতা করা। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এই সব রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্ষমতায় থাকেন তখন ভারতের মোসাহেবী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সারারাত- সারাদিন ধরে ভারতীয় চ্যানেলের সিরিয়াল দেখে সকালে উঠে ভারত বিরোধীতা যাদের অভ্যাস তারা আবার খুব সুক্ষ ভাবে ভারতের বিভিন্ন অপ ঘটনাগুলোর নকল করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেন। দিল্লির গনপরিবহনে ধর্ষণ হবার পরপরেই ঢাকায় ঘটে গেলো অনরুপ ঘটনা। যেহেতু ভারতের রাজধানীতে এই ঘটনা ঘটেছে তাই বাংলাদেশে না ঘটালেই নয়। কিন্তু দিল্লিতে এই ধর্ষণের প্রতিবাদে যে ঝড় উঠেছিলো আমরা কিন্তু তা উঠাতে পারি নাই। হয়তো দিল্লির মেয়েটি ছিলো একটু উচ্চুস্তরের অন্যদিকে আমাদের দেশের মেয়েটি ছিলো সাধারন গার্মেন্টসের শ্রমিক। আমরা আমাদের স্তরের কোন মেয়ের এই দুর্ঘটনা হয় নাই বলেই হয়তো মামুলী প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে আমাদের দায়ীত্ব শেষ করে চলেছি।

আবার কোন মেয়ে ধর্ষিত হলে প্রথমেই আমরা খোঁজ নেই মেয়েটি কী করতো, কোথায় থাকতো, এবং অতো রাতে মেয়েটি একা একা কেনো অমন জায়গায় দাঁড়িয়েছিলো এইসব প্রশ্নে নিজের সাথে আগে যুদ্ধ করে নেই। তারপরে যখন দেখি পত্রপত্রিকায় কিচু লেখালেখি শুরু হয়েছে, শাহবাগে মানব্বন্ধন হচ্ছে বা প্রেসক্লাবের শীতাতাপ কক্ষে আলোচনা সেমিনার হচ্ছে তখন নিজেও সেই শ্রোতে গা ভাসিয়ে অনেক কিছু করে ফেলেছি বলে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছি।

আসুন, পুরুষ নামক আমাদের এই হিংস্র জানোয়ারটাকে নিজেরা নিজেদের মধ্যে নিয়ন্ত্রন করি। পথে নারীরা না নেমে সকল পুরুষের আজ রাস্তায় নেমে আসতে হবে। নেমে আসতে হবে নিজেদের পশুত্বকে জলাঞ্জলি দিতে। আমরা পুরুষরা যদি আমাদের সমাজের সন্মান ধরে রাখতে না পারি তাহলে সমাজটা কুকুর বিড়ালের রাজত্বে পরিনত হবে। আর পুরুষ হয়ে উঠবে কুকুরের সমগোত্রীয়। সারমেয় এই জীবন থাকার চাইতে না থাকাই কি ভালো নয়। আসুন আর প্রতিবাদ নয়, এবার থেকে প্রতিরোধের আগুনে সকল ধর্ষকের জীবন্ত চিতা জ্বালাই এই হোক আজকের প্রতিজ্ঞা।