প্রায় চারশত বছরেরও পুরানো আমার এই ঢাকা শহর। মোঘল আমলের সুনজরে পড়া এই ঢাকা শহর তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধীরে ধীরে উত্থানের মাধ্য দিয়ে শহর থেকে নগর হয়েছে, নগর থেকে মহানগর, কেউ কেউ আবার আদর করে মেগা সিটি বলাও শুরু করেছে। মেগা সিটি হয়তো বলাই চলে। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি সম্পন্ন নগরের মধ্যে অন্যতম এই ঢাকা সিটি। আয়তনের তুলনায় এই নগরের জনসংখ্যা শুধুমাত্র অত্যধিক নয়, বলা চলে মাত্রাতিরিক্ত। প্রায় ২৭০ ঘন কিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই মেগা সিটির অবস্থান।
ঢাকা উত্তরের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ৬ লাখ ২৭ হাজার ১৭ জনে আর দক্ষিণের জনসংখ্যা হবে ৭৫ লাখ ৫৮ হাজার ২৫ জন। দুই সিটি কর্পোরেশন মিলে ঢাকার জনসংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ৮১ লাখ ৮৪ হাজার ৪১। ঘনত্ব ৬৭৩৪ জন প্রতি বর্গ কিলোমিটারে। মোট আয়তন, মোট জনসংখ্যা এবং তার ঘনত্বের সংখ্যা দেখেই বুঝা যায় এই ব্যাপকতাকে ম্যানেজ করা কি দুঃসাহসিক কাজ। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে ঢাকা নগরের স্থায়ী বসবাসরত বাসিন্দা ছাড়াও প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট লাখ লোক প্রতিদিন ঢাকা নগরে বিভিন্ন কাজে প্রবেশ করেন। এদের কেউ কেউ থেকে যান দুয়েকদিনের জন্য অথবা চলে যান সন্ধ্যায় অথবা রাতে।
বর্তমান সরকার এই বিশালত্বের কথা চিন্তা করেই ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দুভাগে ভাগ করে কাজের সুবিধা আনার প্রচেষ্ঠা চালিয়েছে। আমরা যারা ঢাকা শহরের বাসিন্দা তারাই শুধু উপলব্ধি করতে পারি ঢাকা শহরে বাস করা আজ কতো টা চ্যালেজিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লোকসংখ্যার আধিপত্যে রাস্তাঘাট শুধু লোকে লোকারন্য, শুধুমাত্র এই প্রতিদিনের লোকারন্য নিয়েই যদি মহানগরের সমস্যা তুলে ধরে যায় তাহলেই এক ইতিহাস লেখা যায়। এবং প্রতি সমস্যা অন্যটির সাথে সংযুক্ত। আমাদের নগর ব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো অসামঞ্জস্য হচ্ছে এই বিশাল চলমান জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেটের অপ্রতুলতা। এটাকে অপ্রতুলতা না বলে একেবারে বিপর্যয় কর অবস্থা বললেই অনেক মানানসই হয়।
একজন ভদ্রলোক গাবতলী থেকে এসে ফার্মগেটে নেমে তার প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেবার কোন সুযোগ পান না। এর পর শুরু হয় তার পাবলিক টয়লেট খোজার আপ্রান প্রচেষ্টা। দুর্ভাগ্যক্রমে যদি বড়ো ডাক হয় তাহলে বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। হয় কোন মার্কেটে বা ওভার ব্রীজ পেরিয়ে পার্ক পার হয়ে একেবারে চক্ষু হাসপাতালের কাছে এক ভাংগা চোরা পাবলিক টয়লেট। সেক্ষেত্রে সেই লোককে জানতে হবে সেই পাবলিক টয়লেটের সঠিক অবস্থান।
অন্যদিকে যদি ছোট ডাক হয় তখন হাতের কাছে পাবলিক টয়লাট না পেয়ে রাস্তার ধারেই কাজ ছেড়ে নেন। এই রাস্তার ধারে কাজ ছেড়ে নেওয়ার কারণে ঢাকা শহরের পরিবেশ আজ দুর্গন্ধ পুতিময় হয়ে গেছে। এমন কোন রাস্তা নেই, এমন কোন দেওয়াল নেই ঢাকা শহরের যেখানে মানুষের মুত্রত্যাগ দেখা যাবে না।
ফার্মগেট এলেকায় চক্ষু হাসপাতাল এর কাছে নির্মানাধীন পাবলিক টয়লেট ছাড়া একদিকে শাহবাগ মোড়, অন্যদিকে মহাখালী বাস স্ট্যান্ড অন্যদিকে আসাদ গেট এবং শ্যামলী পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোন পাবলিক টয়লেটের কোন অস্তিত্ব চোখে পরে না। যার ফলে কোন কোন সময় নগরের প্রধানতম জায়গাতেও সাধারন মানুষ উপায়ন্তর না দেখে নিজেদের প্রাকৃতিক কর্ম সেরে নিতে দ্বিধা করে না।
শাহবাগ অঞ্চলে একটা পাবলিক টয়লেট ছিলো। গত বছর খানেক ধরে সেই টয়লেট টি বন্ধ। অথচ শাহবাগ এলাকাটি প্রায় সবসময় জনসমাগম থাকে। আজকাল প্রায় কোন না সংঘঠন শাহবাগের প্রজন্ম চত্ত্বরে সমাবেশ করে থাকে। সমাগমের এই বিরাট অংশ মলমুত্র ত্যাগের জন্য বাধ্য হয়ে রাস্তা, দুই পার্ক এবং বিভিন্ন স্থাপনার দেয়ালে প্রাকৃতিক কর্ম সেরে পরিবেশের বারোটা বাজাচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণে মোট ৯৬ টি পাবলিক টয়লেট আছে। অপরদিকে উত্তরে মাত্র ২৫ টি পাবলিক বিদ্যমান। উত্তরের ৮২.৬৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় মাত্র ২৫ টি পাবলিক টয়লেট বিদ্যমান। এর মধ্যে আবার কিছু নির্মানাধীন। ওথচ লোক সংখ্যার দিক থেকে ঢা উত্তরের লোকসংখ্যা প্রায় দিগুন।
শহরের অভিজাত এলাকাগুলোতে পাবলিক টয়লেটের অপ্রতুলতা আরো ব্যাপক। বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন কিছু কিছু জায়গায় পাবলিক টয়লেটের উন্নয়নে হাত দিয়েছে কিন্তু তা অনেক চাহিদার তুলনায় একেবারে নগন্য যা আগেই বলেছি।
মহাখালী নগরের ব্যস্ততম অঞ্চলের মধ্যে একটি। এখানে একটি পাবলিক টয়লেট আছে কিন্তু এতোই জীর্ণ শীর্ণ এবং পরিসরে ছোট তা অনেকসময় ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পরে।
উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় একটি, আজমপুরে এবং জসিমউদ্দীন মোড়ে একটি পাবলিক টয়লেট দৃশ্যমান।
গুলিস্তান এলাকায় এবং পুরানো পল্টন এলাকায় দুটি পাবলিক টয়লেট থাকলেও অবস্থা তথৈবচ। যার ফলশ্রুতিতে সাধারন মানুষের প্রাকৃতিক ডাকে টয়লেটের অভাবে বা অপর্যাপ্ততায় যেখানে সেখানে বসে পরতে হচ্ছে।
আগে মানুষ মসজিদে যেয়েও প্রাকৃতিক কাজ সেরে নিতে পারতো কিন্তু বর্তমানে মসজিদ মন্দির গীর্জা সবই থাকে তালা বদ্ধ। শুধুমাত্র নামাজের সময় মানুষ এখানকার সুবিধাটা ভোগ করে থাকে। আর অন্য ধর্মের মানুষের সেই সুবিধা ভোগ করার প্রশ্নই উঠে না।
মলমুত্র ত্যাগ শুধুমাত্র পরিবেশকেই দুষন করে না, এইসব থেকে রোগ জীবানু ছড়িয়ে পড়ে। নগরের স্বাভাবিক বাতাস হয়ে উঠে দুর্গন্ধময়। আব্র যেহেতু মানুষ রাস্তাঘাটের পাশে বাধ্য হয়েই বসে পড়ে সেহেতু ফুটপাত ধরে চলাচলকারি পথচারীরা বিব্রত হয়ে পরে প্রায়শই। পরুষ মানুষ লাজলজ্জার মাথা খেয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই রাস্তাঘাটের পাশে আশ্রয় নেয় কিন্তু মহিলাদের তো সেই অবস্থা বা সুযোগ নেই। সেখানে অনেক বিড়ম্বনার শীকার হতে হয় ঢাকা নগরের মেয়েদের।
আমাদের নগর জীবনের অনেক সমস্যা আছে। সেইসাথে আমাদের সরকার এবং নগর কতৃপক্ষের অনেক আর্থিক সীমাবদ্ধতাও বিদ্যমান। যানজট, ফুটপাত দখল, পার্ক দখল, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, রাস্তা ঘাটের উন্নয়ন, পানি সংযোগ, গ্যাসের নিশ্চয়তা, দলীয়বাজি বা টেন্ডারবাজীসহ অনেক অনেক সমস্যা বিদ্যমান। আমাদের নগর কতৃপক্ষগলো ঠিক যেনো আমাদের নিন্মবিত্ত বা নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবার গুলোর মতো। শত ছিদ্রের মাঝে কোনটা বন্ধ করবে তাতেই দিশেহারা অবস্থা।
তারপরেও আমি মনে করি নগরে নাগরিক সুবিধাগুলো মধ্যে পাবলিক টয়লেট স্থাপন অন্যতম প্রনিধানযোগ্য। এর সাথে জড়িয়ে আছে নাগরিক সুবিধা, জন স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উন্নয়ন সাধন। দুই সিটি কর্পোরেশন কতৃপক্ষ ইদানীং কিছূ নতুন পাবলিক টয়লেট বানানোর উদ্যোগ গ্রহন করেছেন কিন্তু তা একেবারেই চাহিদার তুলনায় সামান্য।
ঢাকা উত্তরের আয়তন ৮২.৬৩ বর্গ কিলোমিটার পক্ষান্তরে ঢাকা দক্ষিনের আয়তন প্রায় ১৮৭.৩৭ বর্গ কিলোমিটার। উত্তরের জন্য নতুন পুরাতন মিলিয়ে পাবলিক টয়লেট আছে ২৫ টি এবং ঢাকা দক্ষিনের জন্য আছে ৯৫ টি পাবলিক টয়লেট যে কথা আগেই বলেছি। জনসংখ্যার তুলানায় এই পাবলিক টয়লেটএর সংখ্যা নিতান্তই কম। উপরুন্ত পাবলিক টয়লেটের অবস্থান এবং পরিবেশ চিন্তা করলে মহিলাদের ঐসব টয়লেট ব্যবহারের কথা চিন্তা তো দুরের কথা পুরুষ মানুষও ঢুকতে একবার চিন্তা করে নেয়।
ঢাকা শহরের কাজের জন্য প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশ লক্ষাধীক মানুষ কাজের জন্য প্রবেশ করেন। এদের প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেবার মতো পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা যদি না করতে পারা যায়, সিটি কর্পোরেশনের সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড মুখ থুবরে পরবে শুধুমাত্র যেখানে সেখানে মানুষের মলমুত্র ত্যাগের কারণে। আমরা দুই সিটি কর্পোরেশনের দুই আধুনিক মানসিকতা সম্পন্ন সিটি মেয়রের কাছে আবেদন করবো ঢাকা নগরীতে পর্যাপ্ত এবং দৃশ্যমান পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা করবেন। সেই সাথে পাবলিক টয়লেট গুলোর পরিবেশ, পরিচ্ছন্নতা যেনো মানুষের ব্যবহারের অনুকুলে থাকে সে ব্যবস্থারো অনুরোধ করছি। এক্ষেত্রে আপনাদের সদয় দৃষ্টি আকর্ষন করছি যে প্রায় পাবলিক টয়লেট গুলো স্থানীয় মাদকাসক্ত যুবকদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার হতে দেখা যায়।এব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করবেন এই প্রত্যাশা রইলো নগর বাসীর পক্ষ হতে